somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাদাত হোসাইন
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

আমার মায়ের সোনার নোলক... আমার মায়ের জামদানী...

২৪ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক.
আমার বাবা শক্ত সামর্থ্য নীরোগ ধরনের মানুষ।
তেমন কোন রোগবালাই তার হয়েছে বলে মনে পড়েনা। ধবধবে ফরসা মেদহীন শরীরে চওড়া বুকের ছাতি। বাবা প্রীতি বেশী বলেই কিনা জানিনা হলিউড অভিনেতা রাসেল ক্রো-কে দেখে প্রায়ই আমার বাবার কথা মনে হয়! আমরা ভাই বোনরা মিলে অনেক সময়ই মা’কে খেপাই যে তার ‘সাত জনমের ভাগ্য’ আমার বাবাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছেন। কথা সত্য না। বরং উল্টোটাই সত্যি হবার কথা। মাকে পেয়ে বাবা বর্তে গেছেন। তার শূন্য জীবন কানায় কানায় না হোক গলা অবধি পূর্ণ হয়েছে। যদিও তিনি কখনোই তা স্বীকার করেন না। নানা কারণে আমার মায়ের আক্ষেপেরও শেষ নেই। কিন্তু তিনি তা বুকে চেপে রাখতে জানেন। সেই আক্ষেপগুলো সযতেœ বাইরের আলো থেকে দূরে রাখতে জানেন। তিনি জানেন, তাকে অনেক কিছুই বুকে চেপে রাখতে হয়। ২০০৬ সালে বাবা স্ট্রোক করলেন। পুরোপুরি অবশ হয়ে গেল শরীরের বা পাশটা। স¤পন্ন ঘর থেকে মা এসেছিলেন আমার বাবার চালচুলোহীন সংসারে। তাই শখের কানের দুল, সোনার গয়না কিংবা একখানা ভালো শাড়ীর আক্ষেপ দিনের পর দিন কাঁটা হয়ে ছিল বুকের ভিতর। সেই মা আজ হঠাৎ টের পেলেন তার বুকের ভেতর আর কোন আক্ষেপ নেই, আছে অসুস্থ স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা, গভীর মমতা আর প্রার্থনা।

বাবার সুস্থতা ছাড়া তার আর কিছু চাওয়ার নেই, কিচ্ছুনা!

২.
২০০৬ সালের ঈদ। আমাদের ঘর জুড়ে শ্মশানের অন্ধকার।

ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বাবা অসুস্থ। এই প্রথম ঈদ, আমাদের কারো নতুন জামা হবেনা! আমার সাত বছরের ছোট বোন যেন এই কদিনেই জীবন অভিজ্ঞতার বয়সে অনেক বড় হয়ে গেছে। সে ঈদ নিয়ে কোন কথা বলেনা। তার গত বছরের ঈদের জামাটা সে মা’র কাছে নিয়ে বলে, ‘দেখছো মা, জামাটা এখনো কত্ত সুন্দর! এইবার ঈদেও দিব্যি চলে যাবে!!’
মা আমার বোনকে বুকের সাথে চেপে রাখেন। নিজের ঠোট কামড়ে চেপে রাখেন আকণ্ঠ ঊথলে ওঠা কান্না। যেমন করে চেপে রেখেছিলেন জীবনের সকল না পাওয়ার আক্ষেপ। সারাদিন মুখ হাসি হাসি করে রাখেন। মধ্যরাতে যখন সবাই গভীর ঘুমে তখন সেই হাসিমুখী মা অন্ধকারে জায়নামাজ পেতে বসেন।

তার বুকের ভেতর চেপে থাকা কান্নারা মুক্তি পায় প্রার্থনায়।


৩.
জীবনের প্রথম চাকুরীর টাকায় মা’র জন্য শাড়ী কিনলাম।

সবুজ জমিনে লাল পাড় জামদানী শাড়ী। সেই শাড়ী মা পড়লেন না। সারাটা সময় দু’হাতে বুকে চেপে ধরে রাখলেন। ক্ষণে ক্ষণে তার চোখের জলে ভিজে শাড়ির লাল পাড় আরো লাল হয়ে উঠলো, সবুজ হয়ে উঠলো গাঢ় সবুজ। যেন একটুকরো বাংলাদেশ! দিনশেষে মা তার জং ধরা পুরনো ট্রাংক খুললেন। ন্যাপথেলিনের গন্ধ ভরা সেই ট্রাংক থেকে মা একখানা যত্নে ভাজ করে রাখা শাড়ি বের করলেন। জামদানী! প্রায় ত্রিশ বছর আগে নানা মাকে জীবনে প্রথম শাড়ী কিনে দিয়েছিলেন। সেই শাড়ির নিচ থেকে আরো একখানা শাড়ী বেরুলো। সেটিও জামদানী! পঁচিশ বছর আগে বিয়ের সময় বাবা মাকে দিয়েছিলেন। মা তিনখানা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছেন। বাবা, স্বামী, সন্তানের তিন উপহার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসায় মোড়ানো উপহার। তিনখানা জামদানী! তিন সময়ের, তিন জীবনের। কিন্তু উপহার একই। সেই জামদানী। আমার মায়ের জীবনের আরাধ্যতম তিন মুহূর্তের স্মারক।

আর জামদানী শাড়ির জন্য?

৪.
জাতী হিসেবে আমরা আবেগপ্রবণ।

আবেগকে খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই। এই অস্থির সময়তো নয়ই। বরং অন্য যেসকল পরিচয়সমূহ জাতী হিসেবে আমাদের পরিচিতি ক্রমশই সঙ্কীর্ণ করে তুলছে, কোণঠাসা করে তুলছে তার চেয়ে এই আবেগপ্রবণ পরিচয় বরং ঢের ভালো। আবেগ হেলা ফেলা করবার মতো কোন বিষয় নয়। আবেগ শক্তিশালী পরিপুষ্ট বীজের মতো। এই ক্ষুদ্র বীজ থেকে বিশাল মহীরুহের জন্ম হয়। ইতিহাস যার জ্বলন্ত সাক্ষী। আবেগের এই ক্ষুদ্র বীজ থেকেই বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরের মত মহিরুহের জন্ম। জন্ম বাংলাদেশের। নতুন করে জন্ম বাংলাভাষার। প্রতিটি জাতীরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, ঐতিহ্য থাকে, যা বিশ্বব্যাপী তার পরিচয়কে মহিমান্বিত করে। আমাদেরও আছে। এর প্রত্যেকটিতে আমরা মিশে আছি আকণ্ঠ। কিন্তু আমাদের এই আবেগ আর ঐতিহ্যের পরিচয়ে যে সর্বনাশা আঘাত হয়ে গেল তা যেন আমার মায়ের মতো অজস্র মানুষের অগোচোরেই থেকে গেল। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন গভীর আবেগে জড়িয়ে থাকা জামদানীর মালিকনা আজ হাত ছাড়া হয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন ঢাকার তাঁতিদের নিপূণ বুননের সু² বস্ত্র ঢাকাই মসলিনের উত্তর সংস্করণই হল ঢাকাই জামদানি। যা একান্তই আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য। প্রাচীন বাংলার প্রায় ২০০০ বছরের বস্ত্রশীল্পের ফসল হলো এই জামদানী। বাংলাদেশের ঢাকা জেলা এবং এর আশেপাশেই জামদানি চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এক আইনের কারণে আমাদের জামদানী, নকশিকাঁথা, ফজলি আম বিশ্ব বাজারে পরিচিত হতে যাচ্ছে ভারতীয় পণ্য হিসেবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এক চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে ভারত অনৈতিকভাবে বাংলাদেশের এই পণ্যসমূহের পেটেন্ট নিজেদের নামে করে নিয়েছে। যার ফলে এই পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী পরিচিত হবে ভারতীয় পণ্য হিসেবে। এমনকি এর বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং রপ্তানী করতে হলে ভারতকে বাংলাদেশের দিতে হবে রয়্যালটি। আমদের হাতে এখনো সময় আছে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে হবে।

‘আমার মায়ের সোনার নোলক’ কোথাও হারিয়ে যেতে দেয়া যাবেনা।

৫.
জামদানী আমাদের। নকশীকাঁথা আমাদের। এগুলো কেবল শাড়ী কিংবা কাঁথাই নয়। এগুলো জীবনের গল্প। জীবনের বুনন। এর পরতে পরতে জীবনের কথা, এই মাটির কথা, এই মানুষের কথা। যে মাটির মানুষ তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তে, তার কথা বুকে ধারণ করে আছে, এমন কিছুর স্পর্শ চায় সেই মানুষের কাছ থেকে এই জামদানী কেউ কেড়ে নিতে পারেনা, পারবেনা।
আমার মায়ের ভালোবাসা আর মমতার্দ্র চোখের জলে যে লাল পাড় জামদানীর লালরঙ আরো গাঢ় হয়, যে সবুজ আরো সবুজ হয়, হয়ে ওঠে একটুকরো বাংলাদেশ।

সেই বাংলাদেশ কেড়ে নেয় সাধ্য কার!
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যারিস্টার সুমন দায়মুক্ত , চু্ন্নু সাহেব কি করবনে ?

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৭


দেশে প্রথম কোন সংসদ সদস্য তার বরাদ্ধের ব্যাপারে Facebook এ পোষ্ট দিয়ে জানিয়ে থাকেন তিনি কি পেলেন এবং কোথায় সে টাকা খরচ করা হবে বা হচ্ছে মানুষ এসব বিষয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৮










চিত্রকলার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোট বেলায় যেটুকু শিখেছিলেন গৃ্হশিক্ষকের কাছে আর পাঁচজন শিশু যেমন শেখে। সে ভাবে আঁকতেও চাননি কোন দিন। চাননি নিজে আর্টিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতা বনাম ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত বিবিধ দোষ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৪



জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতার বিবেচনায় মুমিন ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত দোষারোপ আমলে নেয় না। আমার ইসলাম সংক্রান্ত পোষ্ট সমূহে অমুসলিমগণ ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে বিবিধ দোষের কথা উপস্থাপন করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×