somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ অভিবাদন

২৮ শে মার্চ, ২০১০ দুপুর ২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা যুগের শেষ হয়ে গেল। শেষ দেখতে আসা এক বৃদ্ধ স্বগতোক্তির মত বললেন, সামনে শায়িত সিরাজ চৌধুরীকে দেখে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পৌঢ় বললেন, একটা যুগ কেন, ইতিহাসের একটা অধ্যায় বলা যায়। তারপর সংশোধন করে বললো, অনেকটা অধ্যায় যা পর পর এসেছে এই দেশে। এই এলাকায়। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি দুজনের দিকে তাকালো, যেন বোঝার চেষ্টা করছে। সে তাদের দুজনের খুব কাছে। কিন্তু মনে হয় যোজন যোজন দূরত্ব তাদের মাঝখানে। সময়। তারা যা দেখেছে, যেসব কথা শুনেছে সেসব তার অভিজ্ঞতার বাইরে। সে সামনে শায়িত সিরাজ চৌধুরীকে দেখে। নিমীনিত চোখ, বুঁজে থাকা ঠোঁটে কোনো অভিব্যক্তি নেই। কেবলই নীরবতা আর শান্তি। প্রশান্তি বলতে কী বোঝায় তা মনে হয় একমাত্র এমন অবস্থায় একজনকে দেখলেই উপলব্ধি হয়।
তাঁর জন্য কেউ কাঁদে না যদিও অনেকেরই মন শোকাচ্ছন্ন। অনেক বয়স হয়ে গেলে পরিচিতদের কাছে চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত মনে হয় না যার জন্য হঠাৎ জেগে ওঠা শোকের দমকে কান্নার মত কিছু দেখা দেয় না। শুধু কোথায় একটা আফসোস থাকে, সে শূন্যতা হলো তার জন্য, যে কথক চলে গেল তার কথা ভেবে। এই এলাকায়, নিজ গ্রামে সিরাজ চৌধুরী একজন চারণ কবির মত ছিলেন যার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যের কাছে তার আকর্ষণ ছিল। তারা আসরে আসতো তার কাছে, শুনতো তার অভিজ্ঞতার কথা, চিন্তা ও ধারণা বিষয়। অন্য দশজনের মত ছিলেন না তিনি, তার ভাবনাগুলোও ছিল অসাধারণ। বিশাল বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিন্তু সাধারণ নয় বলেই অ-সাধারণ। তিনি বিশাল কোনো সৃষ্টির সঙ্গে, কর্মযজ্ঞে জড়িত ছিলেন না। বর্তমানে তেমন কিছু করার স্বপ্ন ছিল, সেই সঙ্গে চেষ্টাও কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। চিরজীবন অপেক্ষা করে গিয়েছেন। ভাঙনের জন্য শোক প্রকাশ করেছেন, যে ভাঙন তিনি প্রতিহত করতে পারেননি। সেটা ছিল তার পরাজয়। কিন্তু এর জন্য কোনো লজ্জা ছিল না তার। সারা জীবন মাথায় থাকা ভাঁজকরা খাকি টুপি পরে হেঁটেছেন। সেটাই ছিল তার আদর্শ। আর স্বপ্নভঙ্গের প্রতীক। তাকে তিনি পতাকার মত নিয়ে ঘুরেছেন যখন যেখানে গিয়েছেন। অথচ তখন সেই টুপি পরে থাকা ছিল অনর্থক, প্রায় হাস্যকর। যা হলো না, হতে পারলো না, তার কথা প্রচার করে কী লাভ হতো তা তিনিই জানতেন।
আমরা যখন চল্লিশ বছর আগে এই গ্রামে আসি সীমান্ত অতিক্রমের জন্য সিরাজ চৌধুরী আশ্রয় দিয়েছিলেন। একবার না, কতবার আসা-যাওয়া করেছি প্রতিবারই। থাকতে দিয়েছেন। খেতে দিয়েছেন। কেউ আহত হয়ে ফিরে এলে অথবা অসুস্থ মুহূর্তে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। খুব সহজ ছিল না সেই কাজ। শত্রুসেনাদের ক্যাম্প কাছেই ছিল। তার উপর ছিল প্রথমে তাদের চর, যারা খবরা-খবর নিতো আর পাঠাতো ক্যাম্পে। কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে আমরা কয়জন রক্ষা পেয়েছি। সিরাজ চৌধুরী কিভাবে নিজে রক্ষা পেতেন, শত্রুর সন্দেহ দূর করতেন তা ভেবে আমরা অবাক হতাম। অবশ্য তার চেহারায়, কথা-বার্তায় ছিল এমন আভিজাত্য আর মর্যাদার পরিচয়, অজানা অচেনা লোককে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু শত্রুসেনারা এমন কত অভিজাতদর্শন লোককে মেরে ফেলেছে তার হিসাব নেই। কী জাদু জানতেন সিরাজ চৌধুরী, যা তাকে সন্দেহের উর্ধ্বে রেখেছে?
তবে খুব সহজে যে তিনি সব সময় পার পেয়ে যেতেন তা নয়। মাঝে মাঝে বেশ হেনস্তা হয়েছেন, প্রায় শাস্তি পাওয়ার মত। শোনা যায় মারার জন্যও নেয়া হয়েছিল তাকে একবার। তিনি শত্রু ক্যাম্প থেকে ফিরে এসেছেন হাসিমুখে, অভয় দিয়েছেন গ্রামের মানুষকে। বলেছেন চিন্তা না করতে। কিন্তু যারা ঝুঁকি নিতে চায়নি তারা হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প বসানোর আগেই চলে গিয়েছে ঘর-বাড়ি ফেলে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্তের ওপারে। তাদের কারও কারও সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে শরণার্থী শিবিরে। বেশ কষ্টের জীবন ছিল তাদের। দেখা হলেই নিজ গ্রামে ফেরার কথা বলত। কিন্তু শত্রুসেনার ক্যাম্প রয়ে গিয়েছে শুনে তারা সাহস পায়নি। বেশির ভাগই তারা ছিল হিন্দু, আর সেই জন্য তাদের নিরাপত্তাহীনতাবোধ ছিল বেশি। তারা জানতো শত্রুসেনাদের রাগ বেশি করে হিন্দুদের ওপরই। এক, তারা বিধর্মী বলে। দুই, তারা ভারতের চর সন্দেহে। মুসলমান, যারা তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই শুরু করেছে তাদেরকে প্রায় হিন্দু বলেই মনে করতো তারা। কলেমা পড়ে, কোরান দেখিয়েও রক্ষা পায়নি অনেকে। একথা আমরা জানতাম। আবার এমন ঘটনার কথাও শুনেছি যেখানে হিন্দু পরিবারের সবাই মুসলমান হয়ে গিয়েছে, নামাজ পড়ছে, কোরান রাখছে মাথার কাছে। প্রহসনের মত মনে হয়েছে সমস্ত ব্যাপারটা। ধর্ম নিয়ে কত কিছু করা যায় সেই কথা ভেবে অবাক হয়েছি আমরা। সিরাজ চৌধুরী আমাদের মনের ভাব বুঝতে পেরে বলেছেন, ধর্মের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত জীবনে। সমাজ গঠনে, রাষ্ট্র চিন্তায় ধর্মকে স্থান দেওয়া যায় না। তাহলে মানুষে মানুষে বিভেদ গড়ে তোলা হয়। ঐক্য থাকে না। তারপর থেমে বলতেন, পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের নয়। আমার কাছে পৃথিবীর ইতিহাস হলো মানুষে মানুষে ঐক্য আর অনৈক্যের সংগ্রাম।
আমরা তার মাথায় শ্বেতশুভ্র খাকি টুপি দেখে বলতাম, এটা কী ঐক্যের প্রতীক? তিনি আহত হবার মত দুর্বল হয়ে দুঃখের সঙ্গে বলতেন, না। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। কিন্তু প্রথমে তাই ছিল।
আমরা প্রশ্ন করেছি, আপনি কী প্রথম দিকের কথা ভেবেই এখনো এই টুপি পরে যাচ্ছেন।
একটা হাফ ফেলে তিনি বলতেন, হ্যাঁ। যখন সবার মধ্যে ঐক্য ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে তারা ভাগ হয়ে যায়নি। আমাদের একজন তখন বলেছে, তাহলে আপনার মাথায় এই টুপি পরাজয়ের প্রতীক।
তিনি চুপ করে যেতেন। তারপর মুখ উজ্জ্বল করে বলতেন, তা হবে কেন? আমার এবং আমার মতো যারা চিন্তা করেছে তারা যে ভুল করেনি, তার প্রমাণ তো তোমরাই। সে কেমন? আমাদের কেউ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেছে। বুঝাতে পারছ না, খুব সহজ। এই যে তোমরা পাকিস্তান নামে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছো এর পেছনে কোন আদর্শ কাজ করছে? ধর্মীয় চেতনা? মোটেও না। তোমরা ভাল করেই তা জানো। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের যে ধারণা তোমরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছো।
আমাদের একজন তখন বলেছেন, কিন্তু আমরা জয়ী হয়ে ভারতের সঙ্গে যোগ দেবো না। স্বাধীন সার্বভৌম হয়েই থাকবো।
সিরাজ চৌধুরী বলেছেন, তা থাকবে। কিন্তু তোমাদের নতুন রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। জাতীয়তাবাদীই হবে সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি। আমার এই টুপির মধ্যে সেই রকম আদর্শের কথা বলা আছে।
আমরা তখন সেই একাত্তরে বিশ-একুশ বছরের যুবক। তার বয়স ছিল বোধহয় পঞ্চাশের কাছাকাছি। গ্রামের বাড়িতে তিনি থাকতেন তার মেয়ে রানীকে নিয়ে। রানী আমাদের বয়সীই হবে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বিধবা হয়ে বাবার সঙ্গে থাকে। সিরাজ চৌধুরীর মুখে শোনা তার আরো বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। রানী রাজি হয়নি। বলেছে, বাপ একা থাকে। মা নাই। ভাই শহরে পরিবার নিয়ে থাকে, সময় পায় না গ্রামের আসার। বাপকে দেখাশোনার জন্য তাকে থাকতে হয় বাপের সঙ্গে। শুনে সিরাজ চৌধুরী জোর করে আর বিয়ে দেননি।
রানী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমাদেরও দেখাশোনা করেছেন। রান্না করে খাইয়েছে। অসুস্থ হলে সেবা-শ্রশুষা করেছে। আহত হলে নার্সের মত কাজ করেছে। ফাস্ট এইড বক্সটা তার কাছেই থাকতো। সে কী আমাদের কারো প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল? বোঝা যায়নি। বেশ রহস্যময়ী নারী ছিল সে ঐ বয়সেই। মনে হতো অভিজ্ঞতায় সে আমাদের অনেককে পেছনে ফেলে গিয়েছিল। প্রয়োজনে বেশ মুরুব্বীর মতো ব্যবহার করতো সে। আদেশ দিত কোমরে শাড়ি জড়িয়ে। শহরের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেদের গ্রামের একটা প্রায় অশিক্ষিত মেয়ে বেশ কর্তৃত্বের সঙ্গে শাসন করতো। আমরা বেশ মজা পেতাম। সিরাজ চৌধুরী হেসে বলতেন, মা আমার বড় গিন্নী। আমাকেও শাসায়।
০ দুই ০
উপজেলায় খবর দেওয়া হয়েছে। থানার ওসিকেও। তাদের আসার অপেক্ষায় সবাই। সিরাজ চৌধুরী শুয়ে আছেন আম গাছের নিচে, পাশে বড় পুকুর। মার্চ মাসের গরমে সেই পুকুরের উপর দিয়ে ভেসে আসা বাতাসে শীতল স্পর্শ। আমরা কয়জন শহর থেকে এসে পৌঁছেছি খবর পেয়ে। সমবেত মানুষের মধ্যে এই গ্রামের বাসিন্দাই বেশি। তারা একটু পর বিশ্রাম করতে থাকে। তারা কাজ ফেলে এসেছে। বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না। আবার শেষ পর্যন্ত না দেখে, অংশ না নিয়ে চলে যেতেও পারছে না। কেউ বলছে না থাকতে, নিজের মনের তাগিদেই তারা দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টিতে দেখছে সিরাজ চৌধুরীকে। যারা প্রবীন তাদের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি রয়েছে হয়তো সিরাজ চৌধুরীর জন্য। তার মতাদর্শ সবাই গ্রহণ করেনি। কিন্তু তিনি যে একজন সৎ মানুষ, তার বিশ্বাসে আন্তরিকতা ছিল এটা তারা স্বীকার করে। যারা তাকে দেখেছে গত দশ-পনের বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ যারা নবীন প্রজন্মের তাদের কাছে তার চিন্তা-ভাবনা অনেকটাই অজানা। তবে তিনি যে কিংবদন্তীর মত হয়ে গিয়েছেন এটা তারাও উপলব্ধি করতো।
দেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল, তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বড়ই ক্ষীণ। বছরে একবার দেখা হয় কি হয় না এমন। শেষের দিকে তিনি বলতেন, তোমরা যে আদর্শের জন্য লড়াই করেছো, আমার এই টুপিটা যার প্রতীক সেই ধর্মনিরপেক্ষতা মনে হচ্ছে আর টিকলো না এই রাষ্ট্রে।
আমাদের কেউ তখন বলেছে, কেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছেন। তারা সেই আদর্শ ত্যাগ করেন নাই।
তিনি ম্লান হেসে বলতেন, তা বলছেন কিন্তু সংবিধানে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান কোথায়। তারা সে সম্বন্ধে কিছু বলছেন না। মানেটা কী দাঁড়ালো?
আমরা তখন নিরুত্তর থেকেছি। অশীতিপর সিরাজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বিব্রতবোধ করেছি।
তার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে আমরা হঠাৎ অপরাধ বোধ করেছি। আমরা ছিলাম মাত্র কয়েকজন। তিন জন ব্যবসা করি। থাকি ঢাকায়। একজন অধ্যাপনা রাজশাহীতে। একজন কানাডা প্রবাসী। গিয়েছিলাম সিরাজ চাচাকে (সেই নামেই ডাকতাম তাকে) দেখতে এবং সেই একাত্তরে সীমান্তে যেসব জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সেখানে গিয়ে স্মৃতিচারণ করতে। তার পরিবর্তে মুখোমুখি হলাম সিরাজ চাচার প্রশ্নের। আমরা সবাই ইতস্তত করেছি। তারপর আমি বলেছি, আমরা কেউ রাজনীতি করি না। এই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতিবিদরা দিতে পারেন।
সিরাজ চাচা প্রায় ভর্ৎসনার স্বরে বলেছেন, কিন্তু তোমরা এই দেশ স্বাধীন করার জন্য একদিন যুদ্ধ করেছিলে। তোমাদের সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ মারা গিয়েছে। তিরিশ লক্ষ লোক শহীদ। কারো কিছু করার নেই? তার স্বরে ক্ষোভ জমেছিল।
০ তিন ০
উপজেলায় যারা গিয়েছিল তারা ফিরে এসে জানায় যে, নির্বাহী অফিসার এবং থানার ওসি দুজনই ঢাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নির্দেশ চেয়েছে তারা এক্ষেত্রে কি করবেন। তারা বলেছেন, সিরাজ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এমন প্রমাণ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করলেই কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় না। তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা হবে বেসুমার। তার গ্রামের লোকের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা ঢাকায় বিষয়টি জানিয়েছে। নির্দেশ পেলে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নিবে।
মসজিদের ইমাম সাহেব বলেন, এতক্ষণ লাশ রেখে দেয়া যায় না। লাশের ওপর অত্যাচার হয়। আর দেরি না করে লাশ দাফন করা প্রয়োজন।
তখন আমরা যারা একাত্তরে এ গ্রামে এসে থেকেছি এখান থেকে অপারেশন চালিয়েছি তারা একে একে বলি যে, সিরাজ চাচাকে মুক্তিযোদ্ধাই বলতে হয়। কেননা তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তার বাড়িতে অস্ত্র থাকতো। তিনি অস্ত্র চালাননি ঠিকই, কিন্তু হানাদারদের বিরুদ্ধে হামলায় সাহায্য করেছেন। একবার না বহুবার। এই অংশগ্রহণের জন্য তাকে তার একমাত্র মেয়েকে হারাতে হয়েছে। সুতরাং সিরাজ চাচাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা উচিত। পুলিশ এসে আকাশের দিকে রাইফেল তাক করে গুলিবর্ষণ করে শ্রদ্ধা জানাক। তার দেহ ঢেকে দেওয়া হোক জাতীয় পতাকায়।
আমাদের কথা শুনে সমবেত মানুষের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। অনেকেই মাথা নেড়ে সমর্থন জানায়। ইমাম সাহেবকে অধৈর্য দেখায় এবং কিছুটা বিরক্তও। তিনি সবার দিকে তাকান।
হ্যাঁ, যুদ্ধের সময়ই রানী মারা যায়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। তার কথা বলতে গেলে সময় নেবে। তাছাড়া নিস্পৃহ হয়ে আবেগহীনভাবে সেই কাহিনী বলাও খুব সহজ হবে না। মর্মান্তিক সেই ঘটনা। মনে পড়লেই আমরা বেদনায়, শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এই এতোদিন পরও। রানীর মৃত্যুর স্মৃতি আমাদেরকে তাড়া করে ফেরে। তাকে ভুলতে চেষ্টা করেও আমরা ভুলতে পারি না। অথচ তার সঙ্গে আমাদের কতদিনেরইবা পরিচয় বা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমরা রানীর জন্যই এই গ্রামে ফিরে ফিরে আসতাম। এখন পেরেছি সময় করতে। সিরাজ চাচা অবশ্যই না করত কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিল রানীর স্মৃতির ডাক।
আমি কখনো কখনো ভাবি রানী বেঁচে থাকলে কী করতো সে এখন? সে কী আবার বিয়ে করে ঘর-সংসার পাততো? গ্রামেই থাকতো না শহরে চলে আসতো? তার ক’টা ছেলেমেয়ে হতো বিয়ে করলে? তারা কী করতো এখন? পড়তো, কাজ করতো? আমার মত রানীরও বয়স হতো ষাট। কেউ জানে না আমি একদিন গোধূলির আলোয় পুকুরের ঘাটে বসে রানীকে বলেছিলাম তাকে ভালবাসি। সে কিছু বলেনি। শুধু হেসেছিল, তারপর তাকিয়ে ছিল পুকুরের দিকে। যেখানে শাপলা ফুল ফুটেছিল। ফড়িং উড়ছিল, লতা, গুল্ম ভাসছিল পানির ওপর।
সমবেত মানুষের মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা যায়। তারা সামনে তাকিয়ে আছে। কারো অপেক্ষা করছে। তাহলে কী পুলিশের দল ওপরের নির্দেশ পেয়ে এসে গেল? কিছু পর যাদের দেখা যায় তারা চমকে দেয় সবাইকে। পুলিশ না? ময়লা, ভাঁজহীন প্যান্ট-শার্ট পরা, মুখে গিজগিজে দাড়ি নিয়ে প্রায় মার্চ করে আসছে পাঁচজন। তাদের কাঁধে রাইফেল। আরো সামনে এসে গেলে দেখা গেল তাদের বয়স তিরিশের নিচে হবে। সবাই একটু শীর্ণ, চোখে ধকধক করছে দৃষ্টি আগুনের শিসার মত। তারা এসে সিরাজ চাচার লাশ দেখে, সমবেত মানুষদের দিকে তাকায়। তারপর বলে, আমরা এসে গিয়েছি। চলেন যাওয়া যাক। আমাদের সময় হয়ে আসছে। কেউ কেউ তখন রাস্তার দিকে তাকায়। যেন তারা প্রতীক্ষা করে। পাঁচজন আগুন্তুকের একজন বলে, পুলিশ আসবে না। সশ্রদ্ধ সালাম দেবে না গুলি ছুঁড়ে। আমরা দেবো। চলুন যাওয়া যাক। দেরি করবেন না। সময় নেই।
মন্ত্রমুগ্ধের মত কয়েকজন এসে সিরাজ চাচার খাটিয়া তুলে নেয় কাঁধে এবং রওনা হয় গোরস্তানের দিকে। বাঁশ ঝাড়ের পাশেই সেটা। একটু হেঁটে গিয়ে পৌঁছাল সবাই। কেউ কথা বলছে না, ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছে যেন। কবর খোড়াই ছিল। একজন বললেন, তার মেয়ে রানীর কবরের পাশে। আমি আগাছা ভরা, শুকনো বাঁশ পাতায় ঢাকা উঁচু মাটির ঢিবির দিকে তাকালাম। রানী। চমক ভাঙ্গলো। উচ্চ গলার নির্দেশ শুনে। দলপতির স্বরে গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম। তার আদেশে বাকী চারজন আকাশের দিকে রাইফেল তাক করে ধরলো। তারপর গুলি করলো কয়েক রাউন্ড। সবাই তখন সটান দাঁড়িয়ে। কয়েকজন কবরের নিচে নেমেছে। তারা অন্যদের হাত থেকে লাশ নিচে নামালো। মাটি চাপা দেওয়া শেষ হবার আগেই পাঁচজন সশস্ত্র মানুষ দ্রুতবেগে চলে গেল। খালি মেঠো রাস্তা দেখে মনেই হলো না কেউ এসেছিল।
মাগরিবের আগে এল একদল পুলিশ। বোঝা গেল বেশ ব্যস্ত হয়ে এসেছে। প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসাবাদ করলো গ্রামের মানুষকে। ধমকও দিল কয়েকবার। তারা খুব বিরক্ত আর ক্ষুব্ধ হয়েছে বোঝা গেল। তারপর যেদিকে সশস্ত্র পাঁচজন চলে গিয়েছে সেই দিকে দ্রুত হেঁটে গেল। একটু পর খালি মেঠোপথ দেখে মনেই হলো না পুলিশ এসেছিল।

দৈনিক ইত্তেফাক স্বাধীনতা দিবসঃ২০১০ সংখ্যা
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেলা ব‌য়ে যায়

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩০


সূর্যটা বল‌ছে সকাল
অথছ আমার সন্ধ্যা
টের পেলামনা ক‌বে কখন
ফু‌টে‌ছে রজনীগন্ধ্যা।

বাতা‌সে ক‌বে মি‌লি‌য়ে গে‌ছে
গোলাপ গোলাপ গন্ধ
ছু‌টে‌ছি কেবল ছু‌টে‌ছি কোথায়?
পথ হা‌রি‌য়ে অন্ধ।

সূর্যটা কাল উঠ‌বে আবার
আবা‌রো হ‌বে সকাল
পাকা চু‌ল ধবল সকলি
দেখ‌ছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙালী মেয়েরা বোরখা পড়ছে আল্লাহর ভয়ে নাকি পুরুষের এটেনশান পেতে?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:২০


সকলে লক্ষ্য করেছেন যে,বেশ কিছু বছর যাবৎ বাঙালী মেয়েরা বোরখা হিজাব ইত্যাদি বেশি পড়ছে। কেউ জোর করে চাপিয়ে না দিলে অর্থাৎ মেয়েরা যদি নিজ নিজ ইচ্ছায় বোরখা পড়ে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×