আইনু জাতির ইতিহাস: মূলধারার শোষণ সত্ত্বেও টিকে থাকার এক হিরণময় অধ্যায়
আইনু; এরা জাপানের আদি অধিবাসী। দীর্ঘকাল এরা জাপানের উত্তরাঞ্চলে প্রকৃতিসংলগ্ন জীবন যাপন করছিল। জাপানিরা প্রথমে এদের ভূখন্ড দখল করে নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করে নেয় আর আইনুদের দেয় অনুর্বর ভূমি । পরে রুশরা এদের ওপর চাপায় মনুষ্যসৃষ্ট এক পদ্ধতি-যার নাম অর্থডোক্স খ্রিষ্টান ধর্ম। কাজেই আইনুদের ইতিহাস যেন সংখ্যালঘু আদিবাসীদের উপর তথাকথিত মূলধারার জনগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারের জীবন্ত দলিল ...
আইনু দম্পতি
আইনুরা এশিয়ার উত্তর প্রশান্ত মহাসারগীয় আদি অধিবাসী হলেও মূলত এরা জাপানের হোক্কাইডোতে বাস করে। এককালে এরা দক্ষিণ কামচাটকা উপদ্বীপের বাস করত। রাশিয়ার সদূর পূর্বাঞ্চল শাখালিন দ্বীপেও বাস করত। কুরিল দ্বীপ, জাপানের তোহোকু, হোনসু এসব স্থানেও আইনুরা বাস করে।
জাপানে আইনু অধ্যুষিত অঞ্চল
একটা সময় ছিল যখন আইনুদের ইউরোপীয়-উদ্ভূত মনে করা হত। এর কারণ এদের ঘন ঢেউ খেলানো চুল, পুরুষের রোমশ পেশল শরীর, ঘন দাড়ি। সা¤প্রতিক জিন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে আইনুরা ‘জুমন’ জাতির প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি। জুমনরা ছিল উত্তর এশিয়ার প্রাচীন অধিবাসী। এ ছাড়া আইনুদের মৌখিক ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে-আলাস্কার উপকূলে যে টলিনজিৎ জাতি বাস করে-তাদের সঙ্গে আইনুদের সম্পর্ক রয়েছে। তবে আইনু ভাষা অন্য ভাষার সঙ্গে সম্পর্কহীন। যে ভাষায় আজ আর কথা বলা হয় না। তবে ভাষাটিকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা চলছে।
হোক্কাইডো
ঐতিহ্যভাবেই আইনুরা খাদ্যদ্রব্য শিকার ও সংগ্রহ করত । মাছই প্রধান খাদ্য বিশেষ করে স্যামন ও হেরিং; শিকার করত হরিণ ও ভাল্লুক। এ ছাড়া তাদের টিকে থাকার কারণ ছিল বুনো উদ্ভিদ ও স্বল্প-মাত্রার কৃষিকাজ। উৎপন্ন করত বজরা বা মিলেট, গম ও সীম। আটুশ কাপড়ের পোশাক তৈরি করত।
এলম গাছ। এর ভিতরকার ছালের তন্ত দিয়েই আটুশ আঁশ তৈরি হয়। কাপড় বোনে আইনু-মেয়েরা।
আইনু-মেয়ে। আইনু-মেয়েরা সৌন্দর্য ও । ঋতুমতী হওয়া চিহ্ন হিসেবে ঠোঁটের চারপাশে গভীর সীমানাচিহ্নিত উল্কি আঁকে। ঠোঁট হাত ও বাহুতে উল্কি আঁকা মেয়েবেলায় আরম্ভ হয় ও ১৫/১৬ বছরের শেষ হয়, তখন সে বিবাহযোগ্যা হয়ে ওঠে।
আইনু সমাজে ১৬ বছরেই ছেলেদের প্রাপ্ত বয়স্ক মনে করা হয়। ছেলেমেয়ে প্রত্যেকেই কানের দুল পরে। মেয়েরা বিয়ের আগে স্বাধীনই থাকে পরে স্বামীর ইচ্ছে অনিচ্ছের অধীন হয়ে পড়ে। তবে নারীরা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে পারত এবং গ্রামীণ সালিশে মত রাখতে পারত। এছাড়া মেয়েরা মাঠে কাজ করে, কাঠ কুড়োয়, রাঁধে, কাপড় বুনে, ছেলেমেয়েদের যত্ন নেয় ও পড়াশোনা শেখায়। আইনুরা বাচ্চাদের কঠোর শাসনে রাখে, শিশুরা কাঁদলে কেউ তাকায় না। মেয়েরা শিশুদের রাখে পিঠের ঝুলিতে ।
আইনু গ্রাম
আইনু গ্রামের সবচে গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি হল শামান বা ওঝা। অসুখ সারানোই শামানদের প্রধান কাজ। শামানরা নাকি আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। অন্যান্য পশুর আত্মাও নাকি শামানদের সাহায্য করে অসুস্থদের সুস্থ করে দেয়। শামানদের কাছে সাহায্য চাইলে শামানরা সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করে, তারপর রোগীর কাছে যায় ড্রাম পিটায়, যাদুর কাঠি নাড়ায়, নাচে, অন্যান্য পশুর আত্মাদের ডাকে।
আইনু পুরুষ
সর্বপ্রাণবাদী বা অ্যানিমিষ্ট। সকল বস্তুর মধ্যে প্রাণ বা আত্মা রয়েছে। বিশ্বাস করে কেউ মারা গেলে কেবল ভৌত অংশেরই ধ্বংস হয় আত্মা মুক্তি পায় এটি ভালো কি মন্দ হতে পারে-মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাঠের ওপর অশুভ আত্মার কর্কস প্রতিচ্ছবি আঁকে। একে বলে inaos ; আজকাল এটি কাঠি কেটে তৈরি করা হয়। মাটিতে ঘরে সমুদ্রের ধারে কি রাস্তার মোড়ে কি পবিত্র বৃক্ষের পাশে পোঁতা হয়।
inaos
আইনু ধর্মের দেবতারা প্রাকৃতিক ঘটনা ও শক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আইনুরা মনে করে ভাল্লুক হচ্ছে পাহাড়ের দেবতা। খুনে তিমি মহাসমুদ্রের দেবতা। প্যাঁচারা আইনু গ্রামের রক্ষাকর্তা ।
তবে ভালুকই নাকি ওদের মাছ ধরতে শিকার করতে কাপড় বুনতে শিখিয়েছে। দেবতার সন্তুষ্টির জন্য নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপযাপন করে। এর অন্যতম হল ইয়োমানতে পরব। একটি ভাল্লুককে ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠানের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এর আত্মাকে দেবতার দেশে পাঠানো হয়। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে চলে নাচগান ভোজপর্ব। প্যাঁচা শিয়াল ও অন্যান্য প্রাণীদের নিয়েও আত্মার দেবতার দেশে ফেরৎ পার্বন করা হয় । তবে কাল্ট অভ দ্য বিয়ার বা ইয়োমানতে পরবই আইনুদের মূল ধর্মীয় উৎসব। আইনুরা বাচ্চা ভাল্লুক ধরে, মেয়েরা পালে। সেটির বয়েস ২/৩ বছর হলে বলি দেয়। পুরুষেরা রক্ত পান করে, মাথা কেটে নেয়, চামড়া ছুঁড়ে ফেলে দেয়; পরে পারিবারিক অনুষ্ঠানে চামড়াটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে । চামড়াটিকে খাদ্য ও পানীয় অফার করা হয় -যেন ওটা জীবিত।
আইনুদের ঘর।
আইনুদের ঘর হয় আয়তক্ষেত্রাকার । দেওয়াল হয় নলখাগড়া ও শুকনো দূর্বা ঘাসের। আইনুদের অঞ্চলে ৬/৭ মাস এক নাগাড়ে তুষার ঝরে। আবার বর্ষায় থাকে বৃষ্টিপাতের আধিক্য। মেঝেয় গর্ত করে আগুন জ্বালে। আগুনের ওপর থাকে জালি বা গ্রিল; তার ওপর মাছমাংস রেখে পোড়ানো হয়। দরজার পাশে থাকের পানির বালতি। লোকজন শোয় কাঠের পাটাতনে দূর্বা ঘাসের মাদুরের ওপর। আইনুরা কাপড়চোপড় পরেই নাকি শোয়। ঘরের জানলা দুটি-তার একটি পবিত্র হওয়ায় খোলা হয় না। ঘরটি চিমনীহীন, ধোঁওয়া ছাদের ছোট ফুটো দিয়ে বের হয় বলে ধোঁওয়ায় ঘর সারাক্ষণ ভরে থাকে। সুতরাং আইনুদের ঘরে সময় কাটানো সুখকর নয় বলেই মনে হয়।
আইনু শিল্প
আইনুদের অর্থনীতির কেন্দ্র মৎস শিকার। সমুদ্রে ও মিঠে পানিতে মাছ ধরে তারা । সৈকতে সংগ্রহ করে কাঁকড়া, চিংড়ি,শামুক, ঝিনুক ও কচ্ছপ। শীতকালে জমাট নদী গর্ত করে মাছ ধরে। বর্ষাকালে জাল, লোহার রড, হুক ও হারপূন দিয়ে শিকার করত। বিষ মাখানো হারপূন খুলে ফেলা যায় । (মাছ মারতে বিষের কী দরকার বুঝলাম না!)
আইনু জেলে
আইনুরা আজ থেকে ২০০০ বছর আগেই উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে নৌপথে বানিজ্যে আরম্ভ করেছিল। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার জন্য তারা ৫০ফুট দীর্ঘ পাল তোলা ক্যানৌ ব্যবহার করত। তাদের বিচরন ক্ষেত্র ছিল কোরিয়া, চিন, জাপান, কামচাটকা এবং রাশিয়ার সুদূর পূর্বাঞ্চল অবধি ।
জাপানি আগ্রাসন
১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে আইনু অধ্যুষিত ভূখন্ডে জাপানি আগ্রাসন আরম্ভ হয়। এরপর থেকে আইনুদের জীবনধারা বদলে যেতে থাকে। এরা বিদেশি পণ্যে অভ্যস্ত হতে থাকে। যেমন, কাঁচের পুঁতি, রেশম, লোহা, এবং ভাত। দামী সুতি পোষাক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ঐতিহ্যবাহী আতুশ কাপড়ের উৎপাদন কমে যেতে থাকে-যদিও তারা জাপানিদের সঙ্গে বানিজ্য করার জন্য আতুশ কাপড় তৈরি করত। বিদেশি পণ্যের জন্য আইনু গ্রামে দেখা দেয় অর্ন্তদ্বন্দ -মাছ ও পশমের জন্য আরম্ভ হয় প্রতিদ্বন্দিতা । যদিও আইনুরা একত্রে জাপানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৪৫৬, ১৬৬৯ এবং ১৭৮৯ সালে জাপানিদের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সব কটা যুদ্ধেই আইনুরা হেরে যায়। অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভে রুশরা আইনু-অধ্যুষিত কুরিল দ্বীপ ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে খ্রিষ্টান অর্থডোক্স ধর্ম চাপিয়ে দেয়!
উনিশ শতকের মাঝামাঝি আইনুসংস্কৃতি নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে থাকে। মেইজি আমলে জাপানে আমূল সংস্কার সাধন হয়েছিল। সে সময় সরকারী আদেশে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত অনেক আইনু প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ১৮৭১ সালে জাপানি সরকার আইনু মেয়েদের উল্কি ও ছেলেদের কানের দুল পরা নিষিদ্ধ করে। ১৮৮০ সালে জাতীয়তাবাদী জাপানিরা দলে দলে হোক্কাইডো দ্বীপে যেতে থাকে বসবাসের উদ্দেশ্যে; সরকার আইনুদের জমি বাজেয়াপ্ত করে জাতীয়তাবাদী জাপানিদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দেয়। অনুর্বর জমিই কেবল জুটে আদিবাসী আইনুদের কপালে। ওদের জোর করে কৃষিকাজের দিকে ঠেলে দেয়, এমন কী মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আইনুরাও নিরুপায় হয়ে মূলধারার সঙ্গে মিশে যেতে নানাভাবে চেষ্টা চালায়। বিদ্যালয়ে আইনু ভাষা নিষিদ্ধ করে জাপানি ভাষা চালু করা হয়। বৌদ্ধ ধর্ম খ্রিষ্টান ধর্ম এবং জাপানি সরকার আইনুদের সর্বপ্রাণবাদী ধর্মটি উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লাগে।
হাজার বছর ধরে আইনুরা এশিয়ার আগ্রাসনের শিকার হয়েছে, তাদের উত্তরে ঠেলে দিয়েছে। এই আগ্রাসী দলই বর্তমানকালের জাপানি। বর্তমানে প্রায় ২৫,০০০ আইনু হোক্কাইডোতে বাস করে। আরও হাজার খানের জাপানের অন্যত্র বাস করে। তবে আইনুরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আজও আইনুরা তাদের ভাষাসংস্কৃতি রক্ষায় সচেতন, আজও আইনু শিল্প বিকাশমান। আধুনিকতার প্রভাবে আইনু শিল্পীরা চিত্রকলায় বিমূর্ত ধ্যানধারণা এনেছে । ১৯৮৫ সালে আইনুরা ২৮ বছরে প্রথম ইয়োমানতে (কাল্ট অভ দ্য বিয়ার ) পরব উদযাপন করে।
তথ্য: ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন ওয়েভসাইট ও মাইক্রোসফট এনকার্টার শিসাটো ও. দুব্রিউইল এর লেখা একটি নিবন্ধ ।
ছবি: ইন্টারন্টে।
পুরনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম
ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন
ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট
আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন
ল অব অ্যাট্রাকশন
জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
চরফ্যাশন
নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।
প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন