somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবাঞ্ছিত অতিথি

২২ শে মার্চ, ২০১০ রাত ৮:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজ অনেকদিন পর, দুপুরের নির্জনতায়, প্রখর রোদের প্রবল উষ্ণতায় আর শুষ্ক সময়ের নিষ্ক্রিয় এক ক্ষণে প্রেম এসেছিলো আমার দুয়ারে।

চৈত্র-মধ্যাহ্নের এই তপ্ত-উষ্ণ বায়ু-প্রভাবিত কুটকুটে শরীর আর স্যাঁতস্যাঁতে চামড়ার আর্দ্রতাপুষ্ট অবসন্ন সিক্ত লোমের নিষ্প্রভতায় আমি শুনেছিলাম আমার সরু করিডোরের গায়ে পাতা-মচমচে পায়ের শব্দ। ধুলো পড়া মোজাইকের গায়ে পা টেনে চলা সেই ধূসর পদশব্দ যখন আমার কানে এলো, আমি তখন চুপচাপ আমার একাকী কক্ষে বিরাজমান। তার অঙ্গসঞ্চলন আমার চিরচেনা। আজ অনেক মুহূর্ত কেটে গেছে হয়তো, তবু তার সেই ধীর স্থির খুঁড়িয়ে চলা শব্দ-তরঙ্গ আমার কর্ণকুহরে অনুরণন তুলতে ভুললো না মোটেই। তার মৃদু খুক্‌খুকে কাশি আর ঢলঢলে আলখাল্লার নীরব ঘর্ষণ-ধ্বনি আমি বিস্মৃত হতে বসেছিলাম প্রায়। তার ক্ষীণকায় কৃশকায় ছায়া যখন আমার উষ্ণ-ঘরের পুরু-কাঠের দরজার তলায় এসে স্থির হোলো, আমার হঠাৎ এই গদি-আঁটা চেয়ারখানি থেকে দণ্ডায়মান হয়ে অভ্যর্থনার ঝুলি নিয়ে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হোলো খুব। অহংবোধ বা আত্মমর্যাদাহানির ভীতি বা যাই হোক না কেন, আমি তাই বসেই রইলাম। চিবুকে হাত রেখে। ঘরের দেয়াল অথবা ওটার গায়ে আটকে থাকা এক টিকটিকির দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। ওটা পালিয়ে গেলে আমার চোখ খুঁজে নিলো শূন্য-কক্ষে বেঁচে থাকা এক ক্যাকটাসের দীর্ঘদিনের যত্নে লালিত এক সূচালো কণ্টক।

- আসবো? (ফ্যাসফ্যাসে হালকা মৃদুস্বর)
- কে? (আমার মিথ্যাভিমান)
- আমি প্রেম। আসবো?

ইতস্তত আমি।
সে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো।
দরজাটা খোলাই ছিলো।

আমি এক পলক তাকিয়ে দেখলাম তাকে।
ছিঁড়ে যাওয়া পাদুকা। ধুলোয় ধূসরিত পদাঙ্গুলি। পাজামার ছিন্ন অংশ দিয়ে উদগ্র লোমশ পায়ের কিঞ্চিত দৃশ্যমান। মোটা কাপড়ের হলুদ আলখাল্লা। দুএক জায়গার ফুটো দিয়ে অন্তর্বসন দিব্যি দৃশ্যমান। লোমশ হাতে চর্মরোগের অতীত দাগ। কাঁচা-পাকা খোঁচা-খোঁচা দাড়ির আড়ালে রোদে পোড়া জড়বুদ্ধির হলদেটে উঁচু দাঁত। জটা ধরা তামাটে চুল। উৎকট গন্ধ। বামহাত জেবে ঢুকিয়ে অন্য হাতে উলের রঙচটা মাফলারটা এই গরমে আরও জড়িয়ে নিলো সে। রুক্ষ, বিত্তহীন, নিঃস্ব ও দুর্গত এক সত্তা। মৃদু ফ্যাকাসে হাসি তার আমার উদ্দেশ্যে।

এ কী হাল তার!
মনে মনে আহ্লাদিত হলাম।
চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আনমনে ভাবতে থাকলাম কিছু। সরল ছন্দিত স্পন্দনে পদযুগল নাচাতে থাকলাম।
সে ঘরময় পায়চারি করতে থাকলো। শূন্য গেলাসখানি হাতে নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। অসহিষ্ণু এই দাবদাহে গলদেশ কিঞ্চিত শুকিয়ে আসতেই পারে, কিন্তু আমার চেয়ারের পাশেই নিরালায় পড়ে থাকা জলের পাত্রটির গোপনীয়তা প্রকাশে দ্বিধাচিত্তে অপরাধবোধে ভুগতে রাজী হলাম না আমি।

- কোথায় বসবো? (শুষ্ক কণ্ঠে বিনীত জিজ্ঞাসা)
- যেখানে ইচ্ছে...

সে খুঁজে নিলো শূন্য মেঝে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা গুটিয়ে বসলো। মায়া ভরা চোখে আমার দিকে তাকালো। করুণা প্রত্যাশী দৃষ্টি।
চোখ সরিয়ে নিলাম। মানবিকতার খাতিরে আর সামাজিকতা রক্ষার্থে কিছু কথা না বললেই নয়,

- কেমন আছো?
- এই তো...চলছে...তুমি? তুমি? (আগ্রহী অনুরাগপুষ্ট স্বর)
- সবসময় ভালো।
- (বিগলিত হাসি) অনেকদিন তোমার সাথে দেখা নেই...ভাবলাম...
- কোন প্রয়োজন ছিলো না...

চুপচাপ দুপুর। বাইরের রোদের আঁচ হিলহিলিয়ে দেহের অভ্যন্তরে সেধিঁয়ে যাচ্ছে। দেহের উপর ফেলে যাচ্ছে চট্‌চটে প্রলেপ। কর্মোদ্যমহীন রক্তমাংস। অকর্মণ্য প্রাণ। নিস্তেজ সত্তা। মরা পৃথিবী।

টিকটিকিটা শুধু আবার ফিরে এসেছে। ওঁৎ পেতেছে শিকারের।

- কতক্ষণ থাকবে? (একনিষ্ঠ প্রশ্ন আমার)
- (কোনো শব্দ নেই)
- (ঘড়ি দেখার ভান করলাম) আমার একটু কাজ ছিলো...
- (চোখে প্রত্যাখানের ছায়া...অপক্ষেপ)

সে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো।
ধুলো ঝেড়ে গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে খোলা দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হোলো এক প্রাচীন উপেক্ষিত সত্তা।

হাঁফ ছেড়ে শিথিলচিত্তে হাত বাড়িয়ে কেরোসিন কাঠের তাক থেকে আমি তুলে নিলাম ‘নিঃসঙ্গতায় আত্মাহুতি’ বইটি। অজানা কোন লেখক। সংশ্লিষ্টতা, সম্পৃক্ততা, সংসৃষ্টতা প্রয়োজনীয় শুধু এখন। হোক সেটা জড়বস্তুর সাথে। অধ্যয়নরত মানস শুধু ক্ষণে ক্ষণে তাকায় শূন্য মেঝের দিকে। দেয়ালে আগন্তুকের পিঠের ঘাম শুকোয়নি এখনো।

দরজাটা সে খোলা রেখে গেছে।
একরাশ বিরক্তি শুধু আমার ভাবলেশহীন দুইচোখে।


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১০:০৬
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×