somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশে চাদঁ ছিল না সেদিন।

২০ শে মার্চ, ২০১০ বিকাল ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশ ভাগের পর ভারত থেকে এসে দাদা বরদাকান্তের রাজবাড়ীটা কিনে ছিলেন। আমার তখন জন্ম হয়নি। ভারতে থাকার স্মৃতিও আমার নেই। আমার ছোটবেলা - বড় বেলা সব এই বরদাকান্তের রাজবাড়ী ঘিরেই। মোটামুটি বিঘে পাঁচেক জমির উপর বাড়ী। বেশ পুরনো। আদি বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা যেখানে আছি এটা নাকি রাজার কাচাঁরি ঘর ছিল। আমাদের আগে যারা এখানে ছিল তারা বোধহয় সংস্কার করেছে। বাড়ির পাশে বিশাল পুকুর। বাধাঁনো ঘাট এখনও অক্ষত। আর এমন কোন গাছ নেই যে নেই। সকাল বেলায় উঠে আমড়া গাছে কাছে গিয়ে প্রথম ঢিলটা মারতেই তবারক মিঞা দেখি ছুটে আসছে আমার দিকে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে -
: আম্মাজান ওরা আসতেছে। পালান।
এই কথা বলে সোজা বাড়ীর ভিতর ধুকে পড়ল। ঘটনার আক্মসিকতায় আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে গেছি। ঘরে ঢুকে দেখি সবার আতংকগ্রস্ত চোখ। মা' দরজা বন্ধ করল। বাবা তবারক মিঞা জিজ্ঞাসা করছে
: কে নিয়ে আসছে।
: সামসু মুন্সি। তারে সাথে দেখছি। আপনি পালান।
খালু ভয় পেয়েছে সবচেয়ে বেশী। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল
: কোথায় পালাবে
: জংলার দিকে যান।
: ছেলে দুটোকে যুদ্ধে পাঠানোর দরকার কি ছিল
: আহ! ও প্রসংগ এখন থাক।
: থাকবে কেন। এখন মরার জন্য অপেক্ষা করব।
: রেনু তুমি মেয়ে আর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে জংলার দিকে যাও।
: জংলার দিকে সাপ আছে।
: গাধাঁর মত কথা বলছ কেন?
: দুলাভাই, আমরা কোনদিকে যাব।
: তুমিও যাও ওদের সাথে। সবাই যাও।
: আপনি যাবেন না।
: না।
: আপনাকে যাইতে হইব।
: আমার জন্য ওরা আসছে। আমাকে পেলে ওরা আর জংলার দিকে যাবে না। আমার জন্য সবাই বেঘরে প্রান হারানোর দরকার নেই।
এ সময় কান্নার রোল উঠল। মা আর কাশেমের মা এক সাথে কাদঁছে।আমার চোখ বেয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে। বাবার হাত চলে যায় মা'র মাথায়।
:::::::::::::::
কিছুক্ষনের মধ্যে রাজাকাররা আমাদের বাড়িটা ঘিরে ফেলল। আমরা দূর থেকে সবই দেখছি। বাবাকে একজন লাথথি মারতে মারতে পুকুর ঘাটে নিয়ে আসছে। ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে ততক্ষনে। তাই নিয়ে বেশ উত্তেজনা। চোখের সামনে পুড়ছে আমাদের বাড়ী। যার অনেক স্মৃতি এখন চোখের সামনে আসছে না। ঠিক এসময় দুটো গুলির শব্দ। দেখি পুকুর ঘাটের পশ্চিম পাশে তবারক মিঞা আমাদের দোনালা বন্দুক হাতে। একটা লোক সাথে সাথে শুয়ে পড়ল। সবাই মূহর্তে পজিশন নিয়ে ফেলেছে। মিনিট দুই যুদ্ধ চলল। এক সময় দেখি বাবা আর তবারক মিঞা পাশাপাশি। কিন্তু আমার ধারণার বাইরে কাজটা ঘটল তখন। বাবা আর তবারক মিঞা কে জবাই করা হচ্ছে। জ্যান্ত জবাই। মা মুর্চ্ছা গেছে অনেক আগেই। কাশেমের মা প্রানপনে হাত দিয়ে আমার চোখ ঢেকে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু দৃশ্যটা আমার মনে সেই থেকে আজ অবধি গেথে গেছে। বাবাকে পুকুর ঘাটে তিন জন ফেলিয়ে জোরে চেপে ধরেছে। সামসু মুন্সি গলায় ছুরি চালাচ্ছে। রক্ত আর রক্ত। আমার চরম ভীতু খালু দৌড় দিয়ে সামসু মুন্সিকে এক লাথি মারল। কে যেন পিছন দিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে খালুর মাথায় মারল। তারপর সেই একই কায়দায় খালুকেও বলি দেওয়া হল। আমি বমি করে ফেলেছি কখন ঠিক মনে নেই। তবে আশ্চর্য আমি পুরো দৃশ্যটাই দেখছি। মা'র মত মুর্চ্ছা জায়নি। ঘন্টা দুয়েক পরে ওরা চলে গেল। আমি কি করব। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা বসে আছি জংলার ধারে। কুয়াশা আর রাতের ভয়ংকর নিস্তব্দতা আমাদের ছেকে ধরেছে।
মা'র জ্ঞার ফিরেছে। আমরা একটা বাড়িতে আম্রয় নিলাম। আশ্চার্য এই বাড়ির কাউকে আমি বা মা... কেউই চিনি না। কাশেমের মা নিয়ে এসেছে। আমাদের এত অচেনা তবু কি যে আদর করে আমাদের থাকতে দিলেন। কাশেমের মামা হন তিনি। রেলের কুলি। কাশেমের মা'র কাছ থেকে সব শুনে বললেন....
: গরীবের ঘরে কোথায় থাকতে দি'। হাসেম সাহেবরে এমনে মাইরা ফেলছে। হারামজাদার দোজখেও তো জায়গা পাইবো না। আল্লাহগো আর কি দেখাইবা তুমি।
এ সব শোনার ধর্য্য তখন আমার আর মা'র নেই। মা এ নিয়ে তিনবার অজ্ঞান হয়েছে। আমি শুধু তখনো চোখের পানি ফেলিনি। এত দ্রুত এত কিছু ঘটে গেল আমি ঠিক তাল মেলাতে পারছি না। তবে শত চেষ্টা করেও গা'র কাপনি থামাতে পারছি না।
আমি ভাবছি। আর অবাক হচ্ছি। এত শক্ত করে বিধাতা কিভাবে গড়েছেন আমাকে।
এক ঘরেই গাদাগাদি করে আছি আমরা ৯ জন। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি না। ঝিঝি পোকার শব্দ ছাপিয়ে মা'র ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ কেমন জানি বেমানান লাগছে। আশেপাশে বোধহয় কোথাও শিউলী গাছ আছে। গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাবার লাশ তখনও বোধহয় পড়ে আছে পুকুর ঘাটে। যতবারই মনে হচ্ছে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠছে। কেন আমি বাবাঁকে বাচাঁতে ছুটে গেলাম না। আমি ছেলে হলে কি ছুটে যেতাম। ঘুমে দু-চোখ জড়িয়ে আসছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি আকাশে চাদঁ ছিল না সেদিন।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শেষ মুহূর্তে রাইসির হেলিকপ্টারে কী ঘটেছিল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩২

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত খুব কমই জানা গেছে। এবার এ ঘটনার আরও কিছু তথ্য সামনে এনেছেন ইরানের প্রেসিডেন্টের চিফ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনারই মেরেছে এমপি আনারকে।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন!

এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের কিছু উল্টা পালটা চিন্তা !

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১০

১।
কলকাতা গিয়ে টুকরা টুকরা হল আমাদের এক সন্ত্রাসী এমপি, কলকাতা বলা চলে তার ২য় বাড়ি, জীবনে কতবার গিয়েছেন তার হিসাব কেহ বের করতে পারবে বলে মনে করি না, কলকাতার অলিগলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×