somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালবাসার ক্যান্সার - ১

০৮ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৮:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাঁটছি বত্রিশ বছর আগের করিডোরে....

জানুয়ারীর ২৩ তারিখ । ঠিক দু’দিন পরে দু’মাসের ছুটি শেষে ফিরে যাব অটোয়ায় । নিজের আবাসে নাকি প্রবাসে ? ঠিক জানি না । যে দেশে আজ এগারোটা বছর কাটিয়ে দিলাম, তাকে আর কতকাল প্রবাস বলব ঠিক জানি না, তবে এখনো নিজের দেশ (পশ্চিমারা যাকে “হোম” বলে) বলতে ভেতরে কোথায় যেন ভীষণ টান লাগে । সে যাক, আমরা দু’বোন হাঁটছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোর ধরে । আউটডোরের গেট দিয়ে ঢুকে শীতের সন্ধ্যা নেমে আসা হাসপাতালের টিমটিমে টিউবলাইটের আলো আঁধারির মধ্যে আমরা যাচ্ছি কেবিনের দিকে । টিউবলাইটগুলো আলোর চেয়ে অন্ধকার ছড়ানোর কাজটাই বেশি করছে । দেয়ালে পানের পিকের দাগ, মেঝেতে রক্তের ছাপ.... করিডোরের এখানে ওখানে রোগীর আত্মীয় স্বজনের জটলা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি । পর্দার ফাঁক গলে ওয়ার্ডের ভেতরের পরিবেশ খুব ভাল মনে হয় না । অবশেষে লিবরার বাবার কেবিনের দরজায় কড়া নাড়তেই খালাম্মা এসে খুলে দিলেন (লিবরা অটোয়ায় আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু । বাবার চিকিৎসার জন্য ও খুব শিগগিরই দেশে আসবে । আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন ওর বাবার কিছু মেডিকেল রিপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে যাই ।) গোটা কেবিনের ম্রিয়মাণ আলোতে, নিষ্প্রভ দেয়ালে, অপরিচ্ছন্ন মেঝেতে, শক্ত বিছানার কাঠিন্যে- সবকিছুতে কেমন বিষণ্ণতা ঝুলে আছে । বিষণ্ণতার অবশ্য আরো কারণ আছে, লিবরার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে ।

ওঁকে প্রথমে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল । সেখানে বোর্ড মিটিং করে ডাক্তাররা জানিয়েছেন রেডিওথেরাপী দিতে হবে । ঢাকায় রেডিওথেরাপীর ব্যবস্থা যেহেতু শুধুমাত্র ডিএমসি ও অন্য একটি প্রাইভেট হাসপাতালে আছে, তাই ডাক্তারের পরামর্শ মত ডিএমসিতে ভর্তি করা হয়েছে । কিন্তু এখানে ভর্তি করার পরে ভীষণ দুর্বিপাকে পড়েছে পরিবারটি । নানান অব্যবস্থায় হতাশ হয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ওঁকে ব্যাংকক নিয়ে যাওয়া হবে চিকিৎসার জন্য ।

শীতের রাত নেমে আসা করিডোর ধরে আমরা দু’বোন বের হয়ে আসি হাসপাতাল থেকে । আমরা কেউ কিছু বলি না, চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটি । দু’জনেই জানি আমরা ফিরে গেছি বত্রিশ বছর আগে ফেলে আসা ১৯৭৮ এর আট মাস সময়ে । আমার বয়স তখন সাত বছর । আমার বোনটি, যাকে আমি ছোট’পা ডাকি (কারণ আমাদের একটি বড় আপা ছিল), সে সদ্য কলেজ পাশ করে জাহাঙ্গীর নগরে ভর্তি হয়েছিল । সেই আট মাস এই হাসপাতালটি আমাদের বাড়িঘর হয়ে গিয়েছিল । আমাদের বড় আপা ওভারিয়ান ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে করে আট মাসের মাথায় মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে চলে গেল না ফেরার দেশে । তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী ছিল । কৈশোরে বিয়ে, স্বামীর কর্মস্থল (তৎকালীন) পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া আবার ফেরা ইত্যাকার নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে পড়াশুনা করার অদম্য আগ্রহ ছিল তাঁর । উনত্রিশ বছর বয়সের জীবনে সে ছিল পরিবারের “বাতিঘর” । অথৈ সমুদ্রে নিকষ অন্ধকারে জাহাজ যেমন করে দূরে বাতিঘরের আলো দেখে লক্ষ্য স্থির করে, বড় আপাকে দেখেও আমরা সবাই জানতাম কতদূর পথ পাড়ি দিতে হবে ।

সেই বয়সে সব কিছু বুঝে উঠিনি, মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনো দেখিওনি, চিরতরে চলে যাওয়া, কখনও আর না ফেরা.....বোধের অধরা সেই সময়েও পরিবারের সবার অসহায়ত্বটুকু কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলাম । হাসপাতালের করিডোরে সবার দীর্ঘ পায়চারি, ঝুলে পড়া কাঁধ, বিষণ্ণ চাহনি, দু’চোখের পাতায় জমে ওঠা তিরতিরানো অশ্রুকণা, কেউ কাউকে কোন “আশা” দিতে না পেরে নির্বাক তাকিয়ে থাকা......এ সবকিছু কেমন করে যেন আমার পাঁজরে লেগে আছে । আজ অনেকদিন পরে সেই করিডোরে হাঁটতে গিয়ে আমি তা টের পেলাম ।

চলবে...
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×