somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী-শেষ

০১ লা মার্চ, ২০১০ রাত ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি আর টারজান কাছ থেকে আমার ফুফুর চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার দৃশ্য দেখছি। সবাই কাঁদছেন; স্রেফ আমি আর টারজান কাঁদছি না। আব্বা হু হু করে কাঁদছেন। তাঁর একমাত্র বোন দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। আমাদের তল্লাটে আব্বাই এখন সবচে' বয়সী। আজ্রাইলের পরবর্তী টার্গেট সম্ভবত তিনিই!
কবরে শুইয়ে দিয়ে ফুফুর মুখটা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফুফুকে ফর্সা লাগছে। চেহারায় হাসি হাসি ভাব। এটা আল্লাহর অশেষ রহমত। জানাযার পর যাদের চেহারা ফুটফুটে থাকে তাঁদের নসিবে বেহেশত থাকে; আর যাদের পাপের বোঝা ভারি, তাদের চেহারা ও-সময় মন্দা হয়।
চেহারাটা দেখে সবাই আলহামদুলিল্লাহ পড়েছেন। নাসের ভাইয়ের চেহারাও ভাল হবে। আমার জানামতে, তিনি ইচ্ছাকৃত কোনও অপরাধ করেননি। তাঁর অপরাধের মধ্যে যেটা আমি দেখেছি, তিনি টাকা ধার করে দিতে চাইতেন না, তিনি একটু কিপ্টা ছিলেন।
জানাযার পর আমি নিজ হাতেই একজন নেক্কারকে কবর দেব। এর বদৌলতে কেয়ামতের দিন তিনি আমার জন্য সুপারিশ করবেন। ফুফুর জানাযার মতো ভিড় তখন থাকবে না। এখন ফুফুর ঝি-জামাইদের উৎপাত চলছে, তখন তাঁরা আসবেন না।
ফুফুর কবরের চারপাশে দাঁড়িয়ে সবাই শেষ মুনাজাত করছেন। টারজানও হাত তুলেছে। ফুফুর রুহের মাগফেরাত কামনা করে আমাদের জামে মসজিদের ইমাম সাহেব লম্বা মুনাজাত ধরেছেন। হুজুর মুনাজাতটা আরও ছোট করতে পারতেন। একই কথাকে তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলছেন। বিরক্ত লাগছে।
টারজান কুট করে হেসে দিয়েছে। সে বলল, 'আঙ্কেল, ইমাম সাহেব আমার আম্মুর নাম বলছে।'
'চুপ।'
সে আবার হাতের দিকে তাকিয়ে মুনাজাতে মন নিবদ্ধ করেছে। তাকে এ-সময় চুপ বলা উচিত হয়নি। ভাগ্যিস, চুপ শুনেও সে কাঁদেনি। এ-সময় কাঁদলে একটা দৃশ্য তৈরি হত। সবাই আমাদের দিকে তাকাত। কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করত, 'দিদার, তুমি কি জানাযায় আসনি?'
এবার অন্য জানাযার প্রস্তুতি। আমি টারজানের হাত ধরে ঘরের দিকে যাচ্ছি। আব্বা, ভাইসাবরা, আরও অনেক লোক আমাদের ঘরের দিকে যাচ্ছেন। এখনও অনেক লোক আছে। ইনশাআল্লাহ, নাসের ভাইয়ের জানাযায়ও অনেক লোক হবে।
টারজানকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার আম্মুর নাম কী?'
'বলব না।'
'কেন বলবে না!'
'আমাকে চুপ বলেছেন কেন?'
'দুঃখিত, আর বলব না।'
'কসম খান।'
'খোদার কসম, বলব না। এখন আম্মুর নাম বল।'
'জান্নাতুল ফেরদৌস।'
'তোমার আম্মুকে তোমার আব্বু কী ডাকতেন?'
'জুন্নু।'
'তোমার আব্বুকে আম্মু কী ডাকতেন?'
'নুসু।'
জুন্নু ও নুসুর মধ্যে চমৎকার মিল ছিল। শিল্পবোধও ছিল দু'জনের মাঝে। ডাকনাম দু'টি থেকে এটা বোঝা যায়। শিল্পীযুগলের একজন কিছুণ পর চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন। ভাবির কপালে আরও একজন শিল্পী যে আল্লাহ জুটিয়ে দিতে পারবেন না, এমন নয়।
এতণ রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি খেলা ছিল। জানাযার জন্য কফিন কাঁধে নেওয়ার পরপরই এক পশলা বৃষ্টি নামল। আমি দৌড় দিয়েছি কবরটা ঢেকে দিতে। টারজানও আমার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে।
'আঙ্কেল, আম্মু আম্মু...'
'কী, কী হয়েছে তোমার আম্মুর?'
টারজান ভাল করে বলতে পারছে না। আমি যা বুঝেছি, ভাবি বেহুঁশ হয়েছেন। যে-স্বামী ছাড়া ভাবি একদিনও থাকতে পারতেন না, সে-স্বামী চিরদিনের জন্য চোখের আড়াল হচ্ছেন, বেহুঁশ হতেই পারেন। আমি কবরের দিকে ছুটছি।
টারজান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে, 'আম্মু কথা বলতে পারছে না।'
আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, 'কিছুক্ষণ পর পারবে।'
কবরের ওপর একটি পলিথিন ঢেকে দিয়ে আমরা ভিজতে ভিজতে ঘরের দিকে ফিরছি। টারজান আমার গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে লাগিয়ে হাঁটছে আর কাঁদছে। এখন আমি তাকে কাঁদতে নিষেধ করছি না। চিরবিদায়ের সময় এক অবুঝ শিশুর কাছে অন্তত একফোঁটা অশ্রু পিতৃত্বের দাবি! পিতার মৃত্যুতে সে একফোঁটা অশ্রুও বিসর্জন দেয়নি- এটা বড় হলে তাকে পীড়া দিতে পারে!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'টারজান, তুমি কি আম্মুর জন্য কাঁদছ?'
'হুঁ।'
'তোমার আম্মু কোথায়?'
'রান্নাঘরের পেছনে শুয়ে আছে।'
'মাটিতে শুয়ে আছে?'
'হ্যাঁ।'
দ্বিতীয় জানাযাও পড়াবেন ইমাম সাহেব। জানাযার আগে ইমাম সাহেবের কিছু জরুরি কথা আছে। এখন মুনাজাতের মতো বক্তব্যও যদি লম্বা হয়, পলিথিনের ফাঁক দিয়ে কবরে পানি ঢুকতে পারে।
আমি বললাম, 'হুজুর, বক্তব্য লম্বা করবেন না। কবরে পানি ঢুকবে।'
ইমাম সাহেব বললেন, 'লম্বা হোক, বেঁটে হোক, জরুরি কথাগুলো বলতে হবে।'
তিনি বলতে শুরু করলেন, 'নাসের আহমাদ চৌধুরীর অকাল মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তিনি খুব অমায়িক ও উদার মনের লোক ছিলেন। সাধ্যমতো, মানুষকে তিনি অকাতরে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাদের জানামতে, তাঁর এই সংপ্তি জীবনে তিনি কারও সঙ্গে ইচ্ছাকৃত অন্যায়ে লিপ্ত হননি। প্রতিশ্রুতিকে তিনি কঠোরভাবে পালন করতেন। তাঁর সংপ্তি জীবন থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছুই আছে।'
এ-সময় এ-সব বেহুদা কথার মানে হয় না। আমার গা খিতখিত করছে।
আমি বললাম, 'হুজুর, বৃষ্টি বাড়ছে, সবাই ভিজছেন।'
ইমাম সাহেব বললেন, 'আমার কথার সামান্য বাকি আছে। নাসের আহমাদ চৌধুরীর সঙ্গে কারও যদি আর্থিক লেনাদেনা থাকে তা তাঁর আত্মীয়-স্বজনের কাছে জানাবেন।
আমি বললাম, 'তাঁর কাছে কারও পাওনা থাকলে টাকাগুলো কে দেবে?'
ইমাম সাহেব বললেন, 'তাঁর ওয়ারিশরা দেবে।'
'নাসের ভাইয়ের ওয়ারিশ কে?'
'তার স্ত্রী-পুত্র।'
'তার স্ত্রী-পুত্র কোথা থেকে টাকা দেবে?'
ইমাম সাহেব বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে বললেন, 'আমরা এখন সালাতুল জানাযা আদায় করব।'
আমি ইমাম সাহেবকে বললাম, 'জানাযা নামাজ নয়, দোয়া। সুতরাং 'সালাতুল জানাযা' কথাটা ভুল।'
তিনি আমার কথাটা শোনেও না-শোনার ভান করলেন।
'ফালতু, রাজনীতি করে'- আমি বিড়বিড়িয়ে বললাম।
অন্যসময় বৃষ্টি হলে তুষির জন্য আমার মনটা হু হু করে কাঁদে। আজ মনটা কাঁদছে অন্য কারও জন্য। মনটা বারবার দু'জায়গায় গিয়ে পতিত হচ্ছে। একটা ভাবি, অন্যটা টারজান।
আমি টারজানকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার আম্মুর পাশে কি কেউ আছে?'
'না।'
'তুমি কাউকে বলনি, তোমার আম্মু মাটিতে শুয়ে আছে?'
'না।'
জানাযার জন্য ইমাম সাহেব হাত তুলছেন। আমি টারজানকে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। আমার ধারণা, সবাই লাশের পিছু পিছু চলে এসেছে আর ভাবি বেচারি বেহুঁশ পড়ে আছেন। দ্রুত চিকিৎসা না হলে তিনিও মারা যেতে পারেন।
টারজান বলল, 'আঙ্কেল, আব্বুকে কবর দেওয়া হবে না?'
'হবে।'
'আপনি কি আম্মুর কাছে যাচ্ছেন?'
'হ্যাঁ।'
'আম্মুও কি মারা যাবেন?'
'না।'
'তাহলে আব্বু মারা গিয়েছেন কেন?'
টারজান আমার সঙ্গে দ্রুত হাঁটতে পারছে না। আমি তাকে কোলে তুলে নিয়েছি। জানাযা চলছে, অথচ আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছি। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তবু আমি লজ্জিত হচ্ছি না।
বাড়ি গিয়ে দেখি, রান্নাঘরের মেঝেতে ভাবি পড়ে আছেন। আশেপাশে কেউ নেই। সম্ভবত তিনিও নাসের ভাইয়ের পথ ধরছেন। সেটা হলে স্বামীহারা এই নারীর জন্য ভালই হত। টারজানকে দেখভাল করার জন্য আমি আছি।
বৃষ্টিময় বিকেল, অথচ দৃশ্যটা সন্ধ্যার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই অন্ধকারে কবরের জলকাদায় নাসের ভাইকে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আমার মা-ও নাসের ভাইকে শেষ বিদায় জানাতে গেছেন। আমি 'মা' 'মা' করে চিল্লাচ্ছি। নিজের শব্দগুলো নিজের কাছেই ফিরে আসছে।
টারজানকে বললাম, 'তোমার দাদিকে ডাক।'
ছেলেটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝুমঝুম বৃষ্টিকে উপো করে মসজিদের দিকে দৌড় দিয়েছে। সে যদি জানত, আমি তার আম্মুর মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে মৃত্যুটা নিশ্চিত করব, সম্ভবত যেত না।
আমার আম্মা দৌড়ে এসেছেন। ভাবির মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। স্বামীর শোকে মুহ্যমান ভাবির নিশ্চিত মৃত্যুটা আমি, টারজান, আমার আম্মা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।
আম্মাকে বললাম, 'আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।'
এই অজপাড়া গাঁয়ের একমাত্র ভরসা 'বাদল ডাক্তার'। তিনি হাতুড়ে ডাক্তার। ঠেকে ঠেকে শিখেছেন। গ্রামে তাঁর এখন অনেক নামডাক।
ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। টারজানও আমার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। সে 'মা' 'মা' বলে কাঁদছে। এই ছেলেটা বাবার স্নেহ তেমন পায়নি। স্কুল মাস্টারির পর যে সময়টা পেতেন, তাতে ঘরে ঘরে গিয়ে টিউশনি করতেন বাবা। স্ত্রী-পুত্রের জন্য জীবনে যুদ্ধ করেছেন বেচারা। মা তাকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন।
আমি টারজানকে বললাম, 'তোমার কাছে কি প্লেন আছে?'
'আছে।'
'রেলগাড়ি আছে?'
'না।'
'আমি তোমাকে রেলগাড়িতে চড়াব। চড়বে?'
'হুঁ।'
টারজান আমার হাত ধরে টান দিয়েছে, 'আঙ্কেল, আব্বুকে কবর দেওয়া হচ্ছে।'
'তোমার আব্বুকে দেখবে?'
'দেখব।'
আমরা খোলা আকাশের নিচে ঝরঝর বৃষ্টিতে ভিজছি। সে আমার মতো হাঁটতে পারছে না। আমি তাকে কোলে নিয়ে কবরের দিকে যাচ্ছি।
টারজানের হয়ত মনে নেই, তার মা মারা যাচ্ছেন। আমারও সম্ভবত মনে নেই। যদি থাকত, নাসের ভাইকে দেখার জন্য আমরা সেদিকে যেতাম না। টারজান তার দাদাকে বলল, 'আমি আব্বুকে দেখব।'
আমার আব্বা কবরে উত্তর-দণি শুইয়ে দিয়ে নাসের ভাইয়ের চেহারাটা একবার আমাদের দেখালেন। টারজান বলল, 'আরও দেখব।' আব্বা আবারও দেখালেন। ফুফুর মতো তাঁর চেহারাটাও জ্বলজ্বল করছে। আব্বা বাঁশের চালাটি নাসের ভাইয়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বললেন, 'বিসমিল্লাহি ওয়ালা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ।'
আমরা ডাক্তারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। টারজান বলল, 'আব্বু কি বেহেশতে যাবে? '
আমি বললাম, 'হ্যাঁ, যাবে।'
'বেহেশতে কি আল্লাহ মারে?'
'না, দোজখে গেলে মারে।'
'আঙ্কেল, বেহেশতে গেলে কী হয়?'
'বেহেশতে গেলে আপেল-কমলা খাওয়া যায়।'
'আপেল-কমলা আমার ভাল লাগে না।'
'তোমার কী ভাল লাগে?'
'চুইংগাম।'
'দোকান থেকে তোমাকে চুইংগাম কিনে দেব।'
ডাক্তার বাবু নেই। তিনি খন্দকার পাড়া গিয়েছেন। চার-পাঁচটা পাড়া নিয়ে খুবই ব্যস্ত তিনি। আমরা চেম্বারে বসে আছি। টারজানের জন্য এক প্যাকেট চুইংগাম কিনেছি।
সে আমাকেও একটা চুইংগাম দিয়েছে। আমি খাচ্ছি না। পকেটে রেখে দিয়েছি।
'আঙ্কেল, এটা আপনি কার জন্য রেখেছেন?'
'তুষির জন্য।'
'তুষি কে?'
'তোমার আন্টি।'
'আপনি তাকে চেনেন?'
'চিনি।'
'আম্মুর মতো সেও কি আমাকে মারবে?'
'না, মারবে না। তোমাকে টারজান বলে ডাকবে। টারজান ডাকলে কি ভাল লাগে?'
'হ্যাঁ।'
'আমি ছাড়া কেউ কি তোমাকে টারজান ডাকে?'
'না।'
'আচ্ছা, তোমার আসল নাম কী?'
'আবিদুন নাসের।'
'আমাকে আরেকটা চুইংগাম দাও।'
'না, এটা আম্মুর জন্য।'
আমার এখন মনে হচ্ছে, টারজান তার ইচ্ছেটা পূরণের জন্য মাকে একটা চুইংগাম খাওয়াতে পারলে ভাল হত। মাতৃ-পিতৃহারা হওয়ার আগে এটা সম্ভবত তার শেষ ইচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, কোথাও যেন একটা মারাত্মক ভুল করেছি আমি।
শেষ মুনাজাতটা ধরতে পারলে ভাল লাগত। মুনাজাতব্যাপী আমি একটি কথাই বলতাম, 'খোদা, টারজানকে তুমি মানুষ কর আর ভাবিকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব কর।' ভাবির জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করলে অতিরিক্ত কিছু হবে না। তাঁর শাহাদাতের মওত হবে।
ডাক্তার এসেছেন। টারজান আমার বোগলে ঢুকে যাচ্ছে। সে ডাক্তারকে ভয় পায়। বাদল ডাক্তার তাকে ভয় দেখান। টারজান ডাক্তারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, 'আঙ্কেল, সে কি আমার ওটা কেটে ফেলবে?'
আমি বললাম, 'আমি আছি, কাটবে না।'
'আপনি না থাকলে কি কাটবে?'
'আমি থাকব।'
'ওটা কাটতে চাইলে আব্বুকে বলে দেব।'
আমি টারজানের কথায় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। অবুঝ ছেলেটা বেমালুম ভুলে গেছে, এ-ই ণিক আগে সে বাপকে কবরস্থ করার দৃশ্যটা দেখে এসেছে।
ডাক্তারকে ভাবির কথা বললাম। বিষ প্রতিরোধকও সঙ্গে নিতে বললাম। তিনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। আমরা ভিজে ভিজে যাব। ডাক্তার ছাতা নিয়ে যাচ্ছেন।
ডাক্তার আসার আগে আম্মা অনেক কিছুই করেছেন। দেখছি, ভাবি উঠে বসেছেন, বমি করছেন। আম্মা তাঁকে পায়খানা খাইয়ে দিয়েছেন বমি করার জন্য। চিকিৎসাবিজ্ঞান সেটা কিভাবে দেখে জানি না, তবে যতটুকু জানি, বিষ খাওয়ার পর বমি হয়ে গেলে বিষ বেরিয়ে আসে। নিশ্চিত বমির জন্য পায়খানার চেয়ে উত্তম কোনও জিনিস নেই।
বাদল ডাক্তারও আম্মার 'ডাক্তারিতে' সায় দিয়েছেন। ভাবি এ-দিক ও-দিক দেখছেন। আমার দিকেও দেখছেন তিনি। তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। আমার মনে হয়, বিষ ভিতরে তেমন ঢুকতে পারেনি।
বাদল ডাক্তার টুকটাক কী পরীা-নিরীা করছেন। তিনি আশ্বস্ত করলেন, তেমন সমস্যা হবে না। একটা সাদা কাগজে কয়েকটা অষুধের নামও লিখলেন তিনি।
আম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'নাসেরের দাফন হয়েছে?'
'হয়েছে।'
'তুমি সারাদিন কিছু খেয়েছ?'
'খাইনি, এখন খাব।'
টারজান মায়ের কাছে গিয়ে বসেছে। মা শাড়ি দিয়ে ছেলের মাথাটা ধীরে ধীরে মুছে দিচ্ছেন। তিনি আমার আম্মাকে বললেন, 'ছোট মা, আবিদ মনে হয় কিছু খায়নি।'
ডাক্তার বাবু চলে যাবেন। তাঁকে বললাম, 'রাতে আপনার সঙ্গে দেখা করব। আপনার সম্মানিটা তখনই হবে।' ডাক্তার একটু হেসে বললেন, 'কয়টার দিকে আসবেন?'
'আপনি কখন থাকবেন?'
'সেটা বলতে পারছি না। আবার খন্দকার পাড়া যেতে হবে।'
'কখন ফিরবেন?'
'জানি না। সেটাও বিষ খাওয়া রোগী; মারাত্মক অবস্থা।'
'আমি চেম্বারে অপো করব।'
প্রচণ্ড ব্যথাতুর মন আর ভঙ্গুর শরীর নিয়ে মা ছেলেকে ছোট ছোট গ্রাস পাকিয়ে খাইয়ে দিচ্ছেন। ছেলে পরম মমতায় মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে, মায়ের গালে গাল লাগিয়ে খাচ্ছে। আমি একটা অপরাধের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাচ্ছি। আমার আম্মা আমাকে বললেন, 'দিদার খেতে আয়।'
অঝোর বৃষ্টিতে সন্ধ্যাটাকে মধ্যরাতের মতো মনে হচ্ছে। টারজানকে বুকে জড়িয়ে কম্বলের ভেতর শুয়ে আছি। ভাবিও সম্ভবত শুয়ে পড়েছেন। আম্মা আর কাজের মেয়ে ফুফুদের বাড়ির সবার জন্য রাতের খাবার রান্নায় ব্যস্ত।
আমি বললাম, 'টারজান, অ-টারজান, ঘুম আসছে?'
'না।'
'কারও জন্য মন কাঁদছে?'
'হুঁ।'
'আব্বুর জন্য?'
'হুঁ। সবার আব্বু আছে, আমার আব্বু নেই।'
'আমাকে তুমি আব্বু ডাকবে?'
'ডাকব।'
আমি ভাগ্যবান! বিয়ে না করেও আদুরে নাদুসনুদুস একটা সন্তান পেয়েছি। আমি টারজানকে জড়িয়ে ধরেছি। টারজান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই কান্নাটা তার জন্য ভালই হচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বে।
আমি তাকে বিছানায় রেখে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। টারজান বলছে, 'আমিও যাব।'
আমি বললাম, 'কোথাও যাচ্ছি না আমি, এখন আসব।'
'যাচ্ছেন।'
'কোথায় যাচ্ছি?'
'ডাক্তারের কাছে।'
বৃষ্টি কমেছে। জ্যাকেট পরিয়ে টারজানকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। ভাবি টারজানকে ডাকছেন, 'আবিদ, কোথায় যাচ্ছ?'
'আমি আব্বুর সঙ্গে যাচ্ছি, ডাক্তারের কাছে।'
ভাবি বিষয়টা সম্ভবত বুঝতে পারছেন না। আর কিছু বলছেন না তিনি। আমি টারজানকে কোলে তুলে নিয়েছি। ভাবি উঠে টারজানের মাথায় টুপিটা পরিয়ে দিলেন।
আমি ভাবিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'একটু ভাল লাগছে?'
'মনে হচ্ছে পেটটা জ্বলছে।'
'এটা মনের সন্দেহ, আপনার পেটে বিষ ঢোকেনি। সামান্য ঢুকলেও বমির সঙ্গে বেরিয়ে গেছে।'
'দিদার, আমি তো বিষ খাইনি। মুখে বিষ এল কোথা হতে!'
'এ-কথা পরে জানা যাবে, আপনি এখন শুয়ে পড়–ন।'
'আমি যখন শুয়ে ছিলাম, তখন আমার পাশে প্রথম কে আসে?'
'আমরা তখন জানাযায় ছিলাম।'
'তুমি এসে কি বিষের গন্ধ পেয়েছ?'
'হ্যাঁ।'
'কেউ আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে ...'
'আপনি এখন শুয়ে পড়–ন।'
ভাবি আমার সামনে আবার বমি করলেন। সম্ভবত পায়খানা খাওয়ার কথা মনে পড়েছে। এখন বমিটা তাঁর জন্য খুবই ভাল।
ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। অন্ধকার। নাসের ভাইয়ের কবরটা দেখা যাচ্ছে না। আমি ওদিকে টর্চলাইটের আলো ফেলছি না। আব্বুর কথা মনে পড়লে টারজানের খারাপ লাগবে।
আবার বৃষ্টি নেমেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি। ডাক্তার বাবু তাঁর চেম্বারে চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, তিনি চিন্তিত।
আমি ডাক্তার বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেমন আছেন ডাক্তার বাবু?'
'মন ভাল নেই।'
'কেন?'
'একটা রোগীকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখলাম।'
'কোথায়?'
'খন্দকার পাড়া।'
'রোগীর নাম কী?'
'নাম মনে নেই, মহিলা। ফুটফুটে চেহারার এক মহিলা। ঢাকায় থাকে...'
'নামটা তুষি, তাই না?'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ।'
আমি প্রচণ্ড বৃষ্টি আর অন্ধকার ভেদ করে একটি ফুটফুটে চেহারার সামনাসামনি হওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছি। টারজান আমার হাতে টান দিয়ে বলল, 'আব্বু, আব্বু।'

সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১০ দুপুর ২:০৪
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×