somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথ ও হেগেল : নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে ...

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবীন্দ্রনাথ-এর আরাধ্য জীবনদেবতা। এই জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের জীবনের কেন্দ্রে স্থিত । পক্ষান্তরে জার্মান দার্শনিক হেগেলএর কাছে বাস্তবতা হল পরম মন বা অ্যাবসালুট মাইন্ড ; রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ও হেগেল এর ‘পরম মন’ যেন একই মুদ্রা এপিঠ-ওপিঠ। তদুপরি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস এর সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে হেগেল বলেছিলেন:Being and non-being are the same. বড় রহস্যময় এই উক্তি। রবীন্দ্রনাথও তাঁর জীবদ্দশায় জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনবিষয়ক বৈষ্ণবসাধনমার্গের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করেছেন। নইলে রবীন্দ্রবাউল অভিধাটিই যে নিরর্থক হয় যায়।

আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
তাই হেরি তায় সকল খানে।।
আছে সে নয়নতারায় আলোক-ধারায়, তাই না হারায়
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে।।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস কেন বলেছিলেন, Being and non-being are the same. সে যাই হোক। হেগেল এর দার্শনিক তত্ত্বসমূহ রবীন্দ্রকাব্যে কতদূর প্রতিপন্ন হয়েছে তা নিরুপন করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য এটুকুমাত্র বলা যে-রবীন্দ্রনাথ এবং হেগেল অজস্র দুঃখ যন্ত্রণা সত্ত্বেও জীবনের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ এবং হেগেল ভাবনার ঐক্য নির্ধারন করা সম্ভবও নয়। তাঁদের চিন্তাচেতনায় পূর্ব-পশ্চিমের ফারাক, বিস্তর প্রভেদ। হেগেল ইতিহাসের ক্রমপরিবর্তন সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় কি একথা প্রযোজ্য? হেগেল মানুষের কিছু অন্ধকার প্রবণতা-যেমন প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে সম্পর্ক; এসবের প্রকট উদঘাটক; রবীন্দ্রনাথের বেলায় নির্মম বাস্তবতার প্রতি প্রাচ্যসুলভ প্রার্থনাবোধ লক্ষ করি। তবে রবীন্দ্রনাথ যে ‘সত্য’ কে সুন্দর বলেছেন তা আমরা জানি:

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।

আর হেগেল এর উক্তি:

The Real is Rational and the Rational is Real .

কী এর মানে? যা বাস্তব তাই যৌক্তিক; আবার যা যৌক্তিক তাই বাস্তব। আশ্চর্য! কেমন রবীন্দ্রভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। তবুও বলা যায়; রবীন্দ্রনাথ ও হেগেল দুটি আপাতবিরোধী সভ্যতার জাতক বলেই অভিন্ন সত্যের বিপরীতগামী পথের যাত্রী ছিলেন তারা। তারপরেও এঁরা দু’জনই দুঃখকে জয় করে জীবনের জয়গান গেয়েছেন।



হেগেল। (১৭৭০-১৮৩১)



রবীন্দ্রনাথ।

হেগেল সম্বন্ধে A History of Philosophy গ্রন্থে B.A.G Fuller লিখেছেন: ‘Man conquers nature by obeying her. But his essential victory is not the Baconian one of practical advancement. It has a deeper, spiritual sense. It is found in a triumph over his destiny, which consist in accepting with joyful resignation the renunciations his fate exacts from him . Not to rebel against life, but to love it as it is, with all its limitations and vicissitudes, is to overcome fate and to transmute it into freedom.’ (pp.303)

আর রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন গান।

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো–
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊধর্ব-পানে।।

... Not to rebel against life, but to love it as it is, with all its limitations and vicissitudes, is to overcome fate and to transmute it into freedom...এই মুক্তিচেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহাত্মা হেগেল এর যুগান্তকারী ঘোষনা:

“The owl of Minerva spreads its wings and takes flight
only when the shades of night are falling.”


রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ কবিতাটিতে যেন একই সুর উত্থিত হয়েছে।

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্ -দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা-
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ,বন্ধ কোরো না পাখা।

এভাবে বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ ও জার্মান দার্শনিক হেগেল একে অন্যের চেয়ে ভিন্নধর্মী ও সুদূর জগতে বসবাস করেও এক অভিন্ন সুরে সংগীত রচনা করে গেছেন: যে সংগীত জীবনের বিপুল জয় ঘোষনা করে। এবং সেই সঙ্গে আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে। আমরাও যেন গেয়ে উঠি-


আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০৬
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শৈল্পিক চুরি

লিখেছেন শেরজা তপন, ০১ লা জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭


হুদিন ধরে ভেবেও বিষয়টা নিয়ে লিখব লিখব করে লিখা হচ্ছে না ভয়ে কিংবা সঙ্কোচে!
কিসের ভয়? নারীবাদী ব্লগারদের ভয়।
আর কিসের সঙ্কোচ? পাছে আমার এই রচনাটা গৃহিনী রমনীদের খাটো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×