somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সীরাতুন্নবী পালনীয় না মীলাদুন্নবী : একটি প্রামাণ্য পর্যালোচনা

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দু’টি আরবী শব্দের সমন্বয়ে ‘সীরাতুন্নবী’ গঠিত-- ‘সীরাত’ ও ‘আন্-নবী’। আরবী ভাষার নিয়মে সন্ধি হয়ে হয়েছে সীরাতুন্নবী। ‘সীরাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জীবনী, চরিত, চরিত্র, অভ্যাস, অবস্থা, প্রকৃতি ইত্যাদি। পরিভাষায় কোনো মানুষের সীরাত বলতে বোঝায় তার জীবনেতিহাস। আর শুধু ‘নবী’ বললে যে কোনো নবী বুঝালেও ‘আন্-নবী’ বললে শুধু আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-কেই বুঝায়। সুতরাং এই দুই শব্দের সমন্বয়ে গঠিত সীরাতুন্নবী শব্দটির অর্থ হলো আমাদের মহানবীর ৬৩ বছরের পবিত্র জীবনেতিহাস।

সীরাতুন্নবীর ন্যায় মীলাদুন্নবী শব্দটিও ‘মীলাদ’ ও ‘আন্-নবী’ নিয়ে গঠিত। মীলাদ অর্থ জন্ম। তাই মীলাদুন্নবী মানে হলো মহানবীর জন্ম। বর্তমানে মীলাদুন্নবী শব্দের আগে একটি ‘ঈদ’ শব্দ বসিয়ে বলা হয় ঈদে মীলাদুন্নবী। ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দোৎসব। তাই ঈদে মীলাদুন্নবী অর্থ মহানবীর জন্ম দিবসের আনন্দ বা জন্মোৎসব।

সীরাতুন্নবী পালনীয় না মীলাদুন্নবী-- এ ব্যাপারে শরীয়া’র কয়েকটি মূলনীতি এবং সীরাতুন্নবী ও মীলাদুন্নবীর মৌলিক ও প্রকৃতিগত পার্থক্যটা খোলাসা করলে আশা করি পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে সমর্থ হবেন যে কোনটি পালনীয় আর কোনটি তা নয়।

১ম মূলনীতি: ইসলাম মানব মস্তিষ্কের চিন্তা-প্রসূত কোনো মতবাদ নয়। এর আগাগোড়া সবই আল্লাহপ্রদত্ত। তাই কোন্ কাজ ভালো আর কোনটি খারাপ, কোনটি পালনীয় আর কী বর্জনীয় তা নিরূপিত হবে একমাত্র শরীয়াহর বিচারে। আর তা হলো মহানবীর সুন্নাহ এবং সাহাবা কিরামের অনুসৃত পথ। কারণ হুযূর সা. 'মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি', এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “যে আদর্শের ওপর আমি এবং আমার সাহাবীগণ আছেন।” তাই কোনো কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতোই সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক হোক, শরীয়াহ অনুমোদিত না হলে তা সাওয়াবের কাজ বলে পরিগণিত ও পালনীয় হবে না। আরেকটি কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতোই অসুন্দর আর অনাড়ম্বর হোক, শরীয়াহ অনুমোদিত হলে তা সাওয়াবের কাজ বলেই পরিগণিত ও পালনীয়। উদাহরণত পেশাব লাগা কাপড় যতোই সুন্দর আর সাদা ধবধবে হোক তা পরে নামায জায়িয হয় না, কারণ তা শরীয়াহ অনুমোদিত নয়। কিন্তু পাক-পবিত্র হলে ময়লাযুক্ত কাপড় পরেও নামায জায়িয, কেননা তা শরীয়াহ অনুমোদিত।

প্রচলিত মীলাদুন্নবীর অস্তিত্ব পবিত্র কুরআন, হাদীস ও ফিকহের কিতাবাদির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যাওয়ার কথাও নয়; কারণ মীলাদ মাহফিলের সূচনা হয় ৬০৪ হিজরী সনে ইরাকের সুলতান আবূ সাঈদ মুযাফ্ফর এবং আবুল খাত্তাব বিন দাহিয়া কর্তৃক, তখনও সে মীলাদে ‘ক্বিয়াম’ ছিল না। ক্বিয়ামের সূত্রপাত হয় ৭৫১ হিজরী সনে। একদা মজযূব বুযুর্গ খাজা তক্বী উদ্দীন শাফিয়ীর মজলিসে রাসূল সা.’র শানে কবিতা আবৃত্তি করা হলে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। তাঁর অনুকরণে উপস্থিত জনতাও দাঁড়িয়ে যান। পরবর্তীকালে আর কখনো কোনো মাহফিলে ঐ বুযুর্গ দাঁড়িয়েছেন বলে প্রমাণ মেলে না। কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা ঐ বুযুর্গের একদিনের ঘটনাকে মিলিয়ে দেয় দেড়শো বছর আগে আবিষ্কৃত মীলাদের সঙ্গে। অতঃপর আমাদের ভারত উপমহাদেশে এর আমদানি হয় বেনিয়া ইংরেজ দ্বারা। যার প্রমাণ মেলে ঈদে মীলাদুন্নবীর কট্টর সমর্থক মৌলভী আব্দুছ ছমীর রামপুরীর লেখা ‘আনওয়ারে ছাতিআ’ কিতাবের ১৭০ পৃষ্ঠায়। তিনি লিখেছেন: “তারাও (ইংরেজরা) নবী আলাইহিস সালামের জন্মানন্দ পালনের লক্ষ্যে তাদের কোর্ট, কাছারিতে ১২ই রবীউল আউয়ালকে মুসলমানের উভয় ঈদ ও শবে বরাতের ন্যায় ছুটির দিন মনোনীত করেছে।” এ ইতিহাস সামনে রেখে এবার আমরা ফিরে তাকাই রাসূলের মহত্তম জীবনের দিকে। ‘কেমন ছিলো তাঁর জীবন?’ এ প্রশ্নটি হযরত আয়েশাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: হুবহু কুরআনই প্রতিফলন ছিলো তাঁর জীবন। রাসূলের হাদীস হচ্ছে কুরআনেরই বিশ্লেষণ। আর হাদীসের ব্যাখাসাপে অংশসমূহের বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ফিক্হের কিতাবাদিতে। ইসলামী শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্বিতীয় প্রধান উৎস ও মানদণ্ড হলো রাসূলের জীবন চরিত বা সীরাতুন্নবী। এ সীরাতুন্নবী সমস্ত বনী আদমের সম্মিলিত সম্পদ। সকলেই এ প্রদীপের মুখাপেক্ষী। মানব জীবনের অবিকল পাথেয়, কেননা সীরাতুন্নবীর নির্দেশনা ছাড়া মানুষ তাঁর অভীষ্ট মানযিলে পৌঁছতে পারবে না। তাই তো দেখা যায়, পূর্ববর্তী বড় বড় হক্কানী উলামা কিরাম রাসূলের জীবন চরিত বুঝাতে যতো গ্রন্থ লিখেছেন, সবক’টিরই নামকরণ করেছেন “সীরাত” শব্দে। যথা: ‘সীরাতে ইবনে হিশাম’, ইবনে কাসীরের ‘আস-সীরাহ’, ইদ্রীস কান্দলবীর ‘সীরাত আল-মুস্তফা’, শিবলী নু’মানীর ‘সীরাতুন্নবী’ প্রভৃতি। রাসূল সা.’র জীবন চরিত সম্বলিত পূর্বসূরীদের কোনো কিতাব মীলাদুন্নবী নামে আছে বলে জানা যায় না।

রাসূল সা.’র যুগ থেকে ৬ শতাব্দি পর্যন্ত যে মীলাদের অস্তিত্ব খুঁজে মেলে না, আজ ঐ মীলাদের শুরুতে আরেকটি ঈদ শব্দ সংযোজন করে তাকে শি’আরে ইসলাম বা ইসলামের নিদর্শন বানিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। মীলাদ পালনকারীদেরকে ‘আশিক্বানে রাসূল’ বা রাসূলপ্রেমিক উপাধি দেয়া হচ্ছে। আর ঐ মীলাদ নিয়ে যাঁরা গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাঁদেরকে ‘দুশমনানে রাসূল’, ‘মীলাদ বিরোধী’, ‘দুরূদ বিরোধী’ প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করে জনসাধারণকে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে।
ওপরের আলোচনা থেকে কি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, রাসূলের যুগের ছ’শো বছর পরে উদ্ভাবিত মীলাদুন্নবী পালনীয় না কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি সীরাতুন্নবী?

২য় মূলনীতি: ইসলামে যতো ইবাদত রয়েছে, সে সবের নাম, সময় ও পালনের পদ্ধতি শরীয়াহ্ কর্তৃক নির্ধারিত রয়েছে। জনগণের মতামতের উপর ছেড়ে দেয়া হয় নি। ‘ঈদ’ নামটিও শরীয়ার দেয়া একটি ইবাদতের নাম। হযরত আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল সা.’র সহীহ হাদীস দ্বারা উম্মতের দু’টি ঈদ নির্ধারিত। ঈদুল ফিত্র এবং ঈদুল আয্হা। যার সময়, আদায় বা পালন পদ্ধতিও স্পষ্টত নির্দিষ্ট। প্রতিটি ঈদে রয়েছে দু’ রাকাত নামায, ৬ তাকবীর। রয়েছে দু’টি খুৎবা। সাহাবী, তাবিয়ী, তাবে তাবিয়ী ও ইমামগণ দু’টি ঈদই পালন করে গেছেন। ইসলামের প্রকৃতির সঙ্গে ঈদে মীলাদুন্নবীর দূরতম কোনো সম্পর্কও থাকতো, তাহলে রাসূল অবশ্যই বলে দিতেন। যদি বলা হয়, যেহেতু বিষয়টি নবীর একান্ত ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পর্কিত বলেই তা বলেন নি, তাহলে নবীর ভক্ত সাহাবা কিরাম যাঁরা নবীর প্রেমে সর্বস্ব কুরবান করে দুনিয়ার সামনে নযীর স্থাপন করে গেছেন, তাঁরা অবশ্যই নবীর জন্মদিনকে ‘ঈদ’ বানিয়ে জশনে ঈদে মীলদুন্নবী পালন করতে কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। এমতাবস্থায় নবীর জন্মদিনকে ঈদ বানানো পরোক্ষভাবে এ কথার দাবি করা নয় কি যে, নবীর শুভজন্মে আমরা যতোটা আনন্দে উদ্বেল, তারা ততোটা ছিলেন না? তাঁর জন্যে আমাদের যে ভালবাসা রয়েছে, তাঁদের তা ছিল না। এ কি যুক্তিযুক্ত? যদি না হয়, তাহলে নবীর জন্মদিনকে ঈদ বানানো দ্বীনের মধ্যে নব উদ্ভাবন বা বিদআত ছাড়া আর কী হতে পারে! পথভ্রষ্ট খৃস্টানদের উদ্ভাবিত ঈসা আ. এর জন্মদিবসে বড়দিন তথা ঈদ পালন আর হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালনের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কী বলা যায়! তাছাড়া যে ১২ই রবীউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে নবীর জন্মানন্দ বা ঈদ পালন করা হয়, সে ১২ই রবীউল আউয়ালই নবীর জন্ম তারিখ, এটি নিশ্চিত নয়; কারণ নবীর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। জনসাধারণের কাছে ১২ই রবীউল আউয়াল বহুল প্রচলিত হলেও ঐতিহাসিকদের কারো মতে ৮, কারো মতে ৯ রবীউল আউয়াল। আবার কারো মতে ৫৭০/৫৭১ খৃস্টাব্দের ২২শে এপ্রিল আল্লাহর রাসূলের শুভ জন্মদিন। (সীরাত আল-মুস্তফা)। কিন্তু ১২ই রবীউল আউয়াল যে নবীর ওফাত তারিখ, এতে কারো দ্বিমত নেই। থাকার কথাও নয়। সুতরাং ১২ই রবীউল আউয়াল ওফাতুন্নবী এটা নিশ্চিত। আর নবীর ওফাতের তারিখে নবীর কোনো উম্মত কি ঈদ পালন করতে পারে?

এবার যে সকল ভাইয়েরা ১২ই রবীউল আউয়াল ঈদ পালন করেন, তাদেরকে যদি সবিনয়ে জিজ্ঞেস করা যায়: আনন্দ-বিষাদের দ্বিবিধ সংশ্লেষজড়িত এ দিনটিকে যে ঈদ বানালেন, সে কি মীলাদুন্নবীর কারণে, না ওফাতুন্নবীর কারণে, তারা কি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন? যে দিনটি নিশ্চিত শোক আর অনিশ্চিত আনন্দের স্মৃতিবাহী, সেই দিনে শোকের কথা ভুলে গিয়ে শুধু আনন্দে মেতে থাকা কি কোনো বিবেকবানের পক্ষে শোভা পায়?
একটি উপমা দিয়ে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার করা যাক। ধরুন কারো পিতা যে তারিখে জন্মগ্রহণ করলেন, পঞ্চাশ বছর পর ঘটনাক্রমে ওই একই তারিখে মারা গেলেন। পরেরবার ওই তারিখে ওই ব্যক্তি তার পিতার নিকট অতীতের বিয়োগ-শোকে শোকাহত না হয়ে তাঁর একান্ন বছর আগেকার জন্মের আনন্দে উল্লসিত হয়ে উৎসব পালন করে, তবে তার সেই উৎসব উদযাপন খুব কি যৌক্তিক হবে?

৩য় মূলনীতি: ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এতে কোনো সংযোজন, বিয়োজনের অবকাশ নেই। এ মূলনীতির আলোকে বলা যায়, ঈদে মীলাদুন্নবী নামে তৃতীয় ঈদের সংযোজনের অনিবার্য অর্থ হবে, রাসূল সা. আপন রিসালতের দায়িত্ব যথাযথ পালনে ত্রুটি করেছেন। ঈদে মীলাদুন্নবীর মত ঈদে আ’যম আর সাওয়াবের কাজ থেকে উম্মতকে মাহরূম রেখেছেন। তাই আমাদের পীর সহেবরা তা আবিষ্কার করেছেন। অথচ কোনো মুসলমানের পক্ষে জেনেবুঝে এরূপ আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণ করা সম্ভব নয়। কাজেই ঈদে মীলাদুন্নবী কীভাবে পালনীয় হতে পারে?

আনুষ্ঠানিক পার্থক্য: আমাদের উপমহাদেশে মীলাদুন্নবী নামে যে সকল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেগুলোতে সাধারণত প্রথমে কিছু কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। অতঃপর তাওয়াল্লুদ নামক আরবী পঙ্ক্তিমালা আবৃত্তির পর সমবেত লোকজন দাঁড়িয়ে সমস্বরে দুরূদ-সালাম ও রাসূল সা.’র গুণকীর্তনমূলক কবিতা পাঠ করেন। প্রসঙ্গত, প্রচলিত মীলাদানুষ্ঠানে তাওয়াল্লুদসহ যেসব আরবী গজল গীত হয়, তাতে প্রায়ই আপত্তিকর কথাবার্তা থাকে এবং সুরসঙ্গতির জন্যে দুরূদসমূহে মারাত্মক বিকৃতি সাধন করা হয়। যা হোক, দুরূদ-সালাম ও কবিতা পাঠ শেষ হলে মুনাজাত ও মিষ্টি-তবারক বিতরণ করে আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত করা হয়। সেখানে থাকে না রাসূল সা.’র জীবনাদর্শের শিক্ষা, থাকে না মানুষের হিদায়াতের কোনো নির্দেশনা। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে, কোথাও কোথাও রাসূল সা.’র জীবন চরিতের ওপর সংপ্তি হলেও কিছুটা আলোচনা হয়। তবে তা অধিকাংশই মনগড়া, ভিত্তিহীন। পক্ষান্তরে পাক-ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সীরাতুন্নবী নামে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাতে যেভাবে থাকে মীলাদুন্নবী বা জন্মকথা, সেভাবে থাকে দুরূদ ও সালাম পেশের ব্যবস্থা, থাকে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় উসওয়াতুন হাসানা তথা নবীজীবনের সমূহ বিষয়ের বর্ণনা এবং তা থেকে শিক্ষা হাসিল করে জীবনে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার কথা।

প্রকৃতিগত পার্থক্য: (ক) মীলাদুন্নবীর অর্থ মহানবীর জন্ম। আর সীরাতুন্নবীর অর্থ মহানবীর জীবনেতিহাস। যেহেতু কারো জীবনালোচনা করতে গেলে তাঁর জন্মালোচনা বাদ দিয়ে হয় না, বিপরীতপে জন্মালোচনায় জীবনালোচনা করলে প্রসঙ্গ ঠিক থাকে না। তাই জীবনলোচনার ভেতর জন্মালোচনা আছে, জন্মালোচনার ভেতর জীবনালোচনা নেই। সীরাতুন্নবীর ভেতর মীলাদুন্নবী আছে, কিন্তু মীলাদুন্নবীর ভেতর সীরতুন্নবী নেই। যেভাবে পাঁচের ভেতর এক আছে, কিন্তু একের ভেতর পাঁচ নেই। সুতরাং সীরাতুন্নবী পালন করলে মীলাদুন্নবী পালন হয়, কিন্তু মীলাদুন্নবী পালন করলে সীরাতুন্নবী পালন হয় না।
(খ) সীরাতুন্নবী একটি ব্যাপক শব্দ। অর্থ যেমন ব্যাপক, তেমনি ভাব-ব্যঞ্জনাও। স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে তাঁর আদর্শ সর্বকালীন ও সর্বজনীন। সীরাতুন্নবী শব্দবন্ধ রাসূলের জন্ম ও মৃত্যুসহ গোটা ৬৩ বছরের জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করে। কোনো বিশেষ সময়ের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। বছরের যে কোনো দিন, যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে জীবনালোচনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়।
পক্ষান্তরে মীলাদুন্নবী শব্দে শুধু রাসূলের জন্মই বোঝায়, যা একটি বিশেষ সময় তথা জন্মদিনের ক্ষণকালবোধক। কাজেই শব্দটির পরিধি নবীর জন্ম উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করা তথা শুধু ঐ দিবস পালন করাতেই সীমিত। আর কোনো দিবসকে শুধু দিবস হিসেবে পালন করা ইসলামী শরীয়ায় কোনো গুরুত্ব রাখে না। অতএব ৬৩ বছরের জীবনাদর্শ পালন না করে একদিনের জন্মোৎসব পালন করা যুক্তিসিদ্ধ নয়।
(গ) মীলাদুন্নবীর আলোচনা করা নফল, আর সীরতুন্নবী কায়েম করা ফরয। ফরয ছেড়ে নফল পালন করা, লুঙ্গি খুলে পাগড়ি বাঁধার মতোই। তাই সীরাতুন্নবী ছেড়ে মীলদুন্নবীর আনুষ্ঠানিকতা কোনো অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে না।
(ঘ) আল্লাহর পবিত্র কালাম কুরআন এবং রাসূলের লক্ষাধিক হাদীসের কোথাও মীলাদুন্নবীর আলোচনা নেই, আছে ৬৩ বছরের জীবনাদর্শ; কারণ মহানবীর জন্মকালীন মু’জিযা খোদাপ্রদত্ত। তাঁর একান্ত ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পর্কিত। তাতে মানুষের শিক্ষণীয় ও পালনীয় কিছু নেই। তাছাড়া মানুষের জন্ম একটি গোপন অধ্যায়, যা আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কুরআন-হাদীসে তা আসেও নি। সুতরাং কুরআন, হাদীসের সম্পর্ক সীরাতুন্নবী সাথে, মীলাদুন্নবীর সাথে নয়।

মীলাদুন্নবী পালন কি সম্ভব? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কারো জন্ম কখনোই পালন করা যায় না, শুধু আলোচনা করা যায়। কায়েম করা যায় না, পর্যালোচনা করা যায়। বিশেষত মহানবীর জন্মক্ষণে যেসব অলৌকিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, উদাহরণত, সীরাত গ্রন্থাদিতে আছে, মহানবী সা. মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তাঁর মা আমেনা বলেন: ‘‘আমি প্রসবকালে কোনোরূপ কষ্ট অনুভব করি নি।” তিনি মায়ের গর্ভ থেকে খৎনাকৃত এবং নাড়ি কাটাবস্থায় ভূমিষ্ঠ হন। জন্মগ্রহণ করেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। তাঁর জন্মমুহূর্তে তৎকালীন পারস্যের অগ্নিপূজকদের হাজার বছরের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়। রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্প হয়ে ১৪টি প্রস্তরখন্ড খসে পড়ে। তাঁর জন্মক্ষণে পবিত্র কা’বা ঘরে কুরাইশদের স্থাপিত মূর্তিগুলো ভূমিসাৎ হয় ইত্যাদি। এরূপ বিস্ময়কর ঘটনা কি অন্য কারো জন্মের ক্ষেত্রে ঘটেছে? ঘটা কি সম্ভব! কাজেই মীলাদুন্নবী আলোচনা করা যেতে পারে, কায়েম নয়। তায্কিরা করা যেতে পারে, উদযাপন নয়। শুকরিয়া জ্ঞাপন কর যেতে পারে, পালন নয়। কেউ যদি মীলাদুন্নবী কায়েম করা, উদযাপন করা, আর পালন করার দাবি করে, তাহলে তা অবাস্তব, অযৌক্তিক এবং অসম্ভবের পায়ে মাথা লোটা ছাড়া কিছু হবে বলে মনে হয় না। অর্থগত দিক থেকেও সীরাতুন্নবীর বাস্তবায়ন সম্ভব, কিন্তু মীলাদুন্নবীর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়; কারণ রসূলের জন্ম হয়েছে একটি বিশেষ তারিখের সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে। আরব দেশের সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তটি বাংলাদেশের কত তারিখ, কী বার, কোন প্রহর ছিল, তা ঠিক করে বলা অসম্ভব। সুতরাং মীলাদুন্নবীর সঠিক উদযাপনও অসম্ভব।

আশ্চর্য হলেও অবাস্তব নয়: যে মীলাদুন্নবী পালনীয় নয় শুধু আলোচনীয়; যে আলোচনা ফরয নয়, নফল; সে মীলাদুন্নবীর পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে যে সীরাতুন্নবী শুধু আলোচনীয় নয়, পালনীয়ও; যে সীরাতুন্নবীর অনুসরণ, অনুকরণ এবং জীবনে যার বাস্তব প্রতিফলন নফল নয় বরং ফরয; সে সীরাতুন্নবীর প্রতি বিষোদগার আর অনাস্থা জ্ঞাপন করা হয়। শ্লোগান দেয়া হয়, ‘মীলাদুন্নবী করতে হবে, সীরাতুন্নবী ছাড়তে হবে।’ ‘মীলাদুন্নবী কায়েম কর, সীরাতুন্নবী বন্ধ কর।’ এমনকী এক গোমূর্খকে একবার বলতে শুনলাম, ‘মীলাদুন্নবী কায়েম কর, সীরাতুন্নবীতে লাথি মারো’ (নাউযুবিল্লাহ)। ভাবতে অবাক লাগে, শুনতে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, যে সীরাতুন্নবী তথা মহানবীর পুণ্যময় জীবনেতিহাস, যে সীরাতুন্নবী তথা পবিত্র কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, ইসলামের প্রতিমূর্তি, সে সীরাতুন্নবী নিয়ে জঘন্যতম উক্তি আশিক্বে রাসূল দাবিদারদের মুখে কেমন করে শোভা পায়। আবু জাহল, আবু লাহাব তথা মক্কার কাফেরেরাও মহানবীর মহত্তম জীবন নিয়ে এত জঘন্য উক্তির সাহস করে নি, বরং নবুওয়াতপূর্বকার নবীজীবনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। এ ধরনের কটূক্তি করে মূলত যে তারা আপন ঈমান নামের বৃক্ষমূলে কুঠারাঘাত করছেন, তা উপলব্ধি করার জ্ঞানটুকুও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছেন।

নবীপ্রেম ও মীলাদুন্নবী: মুমিনের ঈমানের দাবি হচ্ছে, তার জীবন, স্বজন ও সর্বস্বের চেয়ে রাসূল সা. কে বেশি ভালবাসা। রাসূল সা. বলেছেন: ‘‘তোমাদের কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার সন্তানাদি, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন তথা সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হব।” (মিশকাত) ভালবাসা গোপন ব্যাপার। পরিচয় করা যায় লক্ষণ দেখে। রাসূলকে ভালবাসার নিদর্শন হলো, তাঁর আদর্শ ও সুন্নাতের অনুসরণ করা। অন্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি আমার আদর্শ গ্রহণ করল, সেই আমাকে ভালবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।” (ফয়যুল কালাম) সুতরাং নবীর সুন্নাতের অনুসরণ ব্যতিরেকে নবীপ্রেমের দাবি অবান্তর। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে আমাদের সমাজে যাদের মাথা থেকে পাতা পর্যন্ত রাসূলের সুন্নাত খুঁজে পাওয়া যায় না, যারা নবীর আনীত শরীয়াহ ও সুন্নাতমতো জীবন যাপনে উদাসীন, বরং এর বিপরীত পথে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাদেরকেই দেখা যায় ১২ই রবীউল আউয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী নামে মৌসুমী নবীভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে তৎপর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনই তাদের সারা বছরের রাসূলবিরোধী অপকর্মের ভর্তুকী আর কাফ্ফারা। তাছাড়া যারা ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করে, তারা দিবসটি ঈদ বা খুশির দিবস হিসেবে উদযাপন করে। তাই দিবসটি তাদের কাছে অনুষ্ঠানসর্বস্ব। জৌলুস আর উৎসবই হয় মুখ্য। ফলে রঙের বৈচিত্র, রকমারি ফেস্টুন আর বর্ণাঢ্য মিছিল দ্বারা তারা দিবসটিকে মাতিয়ে তুলতে চন। লাল, নীল ও হলুদ বাতি জ্বালিয়ে, আগরবাতি পুড়িয়ে, মিষ্টি বিতরণ আর ভেরাইটিজ খাবারের আয়োজন করে দিবসটিকে সার্থক করে তুলতে চান। অথচ এসবের সাথে নবীপ্রেমের দূরতমও কি কোনো সম্পর্ক আছে? এসবের দ্বারা কি নবী খুশি হতেন? নবীর আদর্শ গ্রহন না করে, জীবনের সকল স্তর থেকে নবীর সুন্নাতকে বিদায় করে, শুধু নবীর জন্মোৎসব পালনের দ্বারা যদি আশিক্বে রাসূল হওয়া যেত, তাহলে আবূ লাহাবই সবচেয়ে বড় আশিক্বে রাসূল হওয়ার কথা। নবীর জন্মোৎসব পালনে সে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। দাসী ছোয়াইবার মুখ থেকে নবীর জন্মসংবাদ শুনতে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে তার বহুমূল্য এই দাসীকে মুক্ত করে জন্মোৎসব পালন করেছে। যার মূল্য ঐসব মীলাদানুষ্ঠানের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি হবে। (সীরাত আল-মুস্তফা)

আসুন! আমরা আমাদের দৃষ্টি ও মনের সংকীর্ণতা ও বক্রতা দূর করে উদারতা ও সরলতাকে স্থান দেই। নিজের মত ও পথের অনুকূলে না হলেও সঠিক বিষয় জানা ও বোঝার মানসিকতা তৈরি করি। নবীপ্রেমকে শ্লোগান আর সময়ের সীমানায় সীমিত না রেখে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীর আদর্শ বাস্তবায়ন করে প্রকৃত নবীপ্রেমিক হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদেরকে সুমতি দিন, ঐতিহাসিক ও প্রামাণ্য সত্যকে গ্রহণ করে সত্যিকার নবীপ্রেমিক হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন!

লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষক, শাহবাগ জামিয়া মাদানিয়া, জকিগঞ্জ, সিলেট। ই-মেইল : [email protected]
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×