somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ যোগাযোগ

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




জানালার কাচের ওপর আমি ডান হাত রেখে বসে আছি। আমার পাশে একটা কালো কাচ। কাচের তাপমাত্রা খুব কম। হাতের আঙুলে ঠাণ্ডা লাগছে। বাইরে শিশির পড়ছে। কে বলেছিলো কাচ আসলে তাপ কুপরিবাহী? তাহলে আমার শীত লাগছে কেন! আমি হাত সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবলেও সরাই না। আঙুলের ডগা কেমন অবশ হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ কী হলো, আরেকটা হাত এসে কালো কাচটার ওপাশে ঠিক আবার হাতের মধ্যে এসে পড়লো। আগেই বলেছি, কাচটা একেবারে কুচকুচে কালো, তাই আমি ঠিক মতো দেখতেও পারছি না ওপাশে কে আছে। খালি অন্ধকারের মাঝ থেকে একটা সাদা হাত দেখা যাচ্ছে। সেটার আঙুলের সাথে আমার আঙুলগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো আমার হাতে আবার সাড় ফিরে আসছে।


আমি পিয়ানোর রীডে বাজনার মতো আঙুলগুলো নাড়ালাম। টুং টাং। কোনো শব্দ নেই তবুও আমার মনে হলো কিছু একটা সুর বেজে উঠলো, কোনো টান টান তারে স্পন্দন জাগলো, চকিতে উপ্ত হলো কোনো আলতো উচ্চারণ। শব্দ এক প্রকার শক্তি যা বায়ু, তরল ও কঠিন মাধ্যমের সাহায্যে চলাচল করে। কাচ এবং আমার আঙুলের মাঝে তেমন কোনো সম্পর্কই ছিলো না একটু আগে। ওপাশে হাতের পরশ এসে দাঁড়ালো আর সুরগুলো, কথাগুলো সশব্দ হয়ে উঠলো। আমার টুং টাং দেখেই কি না জানি না, ওপাশের আঙুলগুলোও নড়ে উঠলো। খুব অল্প সময়ের জন্যে। নাকি আমি ভুল দেখছি? টিং টি টি টুং! টিং টি টি টুং! জগতে কতো আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! এই যে আমি একা একা বসে ছিলাম, আমি আর আমার হাত, আর একটা শান্ত শীতল কাচ। আর কেউ ছিলো না, এখনও তেমন কেউ নেই। তবু একটা নাম-পরিচয়হীন হাত এসে আমার সাথে মিশে গেছে। এখন কেমন অপার্থিব শ্রবণ-মধুর সুর বেজে উঠছে। মনোটোনাস একাকিত্বের মাঝে সিঙ্গেল টোন...!


একটু অপেক্ষা করে আমি হাতের ভাঁজ মুঠো করলাম। তেলোর অংশ তখনও কাচের ওপরে লেগে আছে। ওপাশের হাতটি মনে হয় একটু বিভ্রান্ত হলো, একটু ভেবে-চিন্তে তার দুটো আঙুল ভাঁজ হয়ে এলো। অনামিকা আর কনিষ্ঠা। বাকি তিনটে আঙুল একা একা নড়তেই লাগলো, দুলে দুলে। আমার ভালো লাগছিলো হাতটির এমন খুশি খুশি নাচ দেখে। ওভাবে কাচের ওপরে ঝুলে থেকে এমন নাচ আমি আগে দেখিই নাই কখনও! সে'ও হয়তো একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, দেখলাম কব্জির নিচে সবুজ রগ দুটো ফুলে ফুলে উঠছে কেমন অশান্ত ঘোড়ার মতো। সাদা ধবল বকের মতো হাত, তার মাঝে সবুজ ঘাসের মতো দুটো রগের আভাস। ওপরে লালচে তালু আর চিকন তিনটে আঙুল নাচছে তাথৈ। আমার যেনো হঠাৎ করেই অনেক ভালো লাগতে থাকলো। মন ফুরফুরে হয়ে হালকা পালক হয়ে গেলো। সেই একলা ঘরের ভেতরে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো। আমি খুশিতে মুঠো খুলে সেই তিনটা আঙুলকে ধরতে চাইলাম, ছুঁতে চাইলাম। কাচের কালো রঙ হুমকি দিলো, খবরদার! ওকে স্পর্শ করার কোনো অধিকার তোমার নেই!


আমার কী যে হলো হঠাৎ, একা একটা ঘরে অনেক সময় থাকার কুফল মনে হয়, আমি খুব ক্ষেপে উঠলাম। রেগে গেলাম হুট করেই। তারপরে খুব জোরে কাচের গায়ে আঘাত করলাম। একটা ধপ করে শব্দ হলো বিদঘুটে। কিছুই বদলালো না। ওপাশের তিনটা আঙুল এখন বেঁকে মুচড়ে যাচ্ছে। কাচের কালো রং সেই আলতা লাল আঙুলের মাঝের দাগে ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে! আমার বিপন্ন লাগছে আমার মাঝে দানা দানা ক্ষোভ জমা হচ্ছে। আমি আরো জোরে কাচের ওপর মুঠো দিয়ে মারলাম। আরো একবার। আরো একবার। আমার হাড়ের ভেতরে ব্যথার মাশরুম ফুটে উঠছে হলুদ হলুদ। আমার জেদ চেপে গেলো। ওপাশের আঙুলদের ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় আমি কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠলাম। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি শেষবারের মতোন একটা ঘুষি দিলাম।


মনে হলো আমি আবারও হঠাৎ করেই হালকা হয়ে গেছি। নিজের হাতটাকে বেলুনের মতো নির্ভার মনে হলো। দেখলাম খুব স্লো-মোশন ম্যুভির মতো কাচের টুকরোর ফাঁক দিয়ে হাতের মুঠিটা বেরিয়ে গেলো। কব্জি আর চামড়ার ভেতরে কয়েকটা রাগী কাচের টুকরো ঢুকে গেলো, আর গলগল করে গরম রক্ত বেরিয়ে এলো। আমার কনুই আর পায়ের ওপরে স্রোতের মতো লাল নদী বইতে লাগলো। আমি কোনো ব্যথা অনুভব করছি না। কারণ দেখতে পাচ্ছি ভাঙা টুকরোর ওপাশে আমার লাল হলুদ আঙুলের সাথে কতোগুলো উষ্ণ আঙুল জড়িয়ে আছে। অপরিচিত সেই হাতটিকে সামনে টেনে নিতেই আমি যে মুখটি দেখি, সেখানে অনেক অনেক পুরোনো স্মৃতির ভোর আর দুরন্ত রোদ আমার দিকে খলখল করে হেসে দিচ্ছে।


****
- অনীক আন্দালিব
২০.২.১০


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:০১
২২টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×