somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি এবং বিবিধ পরিবহন

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছি সময় কাটাতে। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি কোন একটা পরিবহনের জন্যে। আজ আমার বনভোজনের নেমন্তন্ন। কারা যেন দিয়েছিলো ঠিক মনে করতে পারছিনা, তবে নিমন্ত্রণ একটা আছে এটা নিশ্চিত। এই নির্জনতায় নীরবতার চোখ রাঙানিতে কেমন কাঁচুমাচু হয়ে আছি। কেউ নেই আশেপাশে। কখন যে আসবে একটা বাস! অথবা একটা ট্রেইন। অথবা একটা রিক্সা। অথবা অলৌকিক আলোয় সজ্জিত দেবরথ! হাহা! একটা...ঐতো আসছে। ঝাঁ চকচকে একটা বাস মসৃনভাবে এগিয়ে আসছে। যেন পথের সাথে তার কতদিনের সখ্যতা। বাসের মধ্যে অনেকগুলো শিশু। তারা আনন্দে গান গাইছে, নাচছে। আমার মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেলো দেখে। আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাত নাড়াতে লাগলাম খুশীতে। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল বাসটা। অদ্ভুত বুনোনের টুপি পরা আমুদে ড্রাইভার আমার দিকে চেয়ে হাসলো।

"কি মিয়া, কোথায় যাবা তুমি?"
"আমি..." এই যাহ! কোথায় যাব তাতো ভুলেই গেলাম। একটু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে আমাকে এখন। আমাকে যে যেতেই হবে! কোথায় যাব, কেন যাব তা মনে নেই, কিন্তু এই ঝলমলে বাসটায় আমাকে চড়তেই হবে।
শিশুকন্ঠের গান ভেসে আসে বসন্তের ফুলের রেণুর মত করে নাচতে নাচতে।
"আমি...আমি ওদের গান শেখাতে চাই"
"বটে? তোমাকে কে বলেছে যে এটা গান শেখানোর স্কুল?" ভ্রু কুঁচকিয়ে নীরিক্ষার দৃষ্টিতে তাকালো এইবার ড্রাইভার।
"তাহলে ..তাহলে আমি ওদের মত করেই গাই? ওদের মত হয়ে যাই? এই নাও ব্যাগটা ধরোতো, দেরী হয়ে যাচ্ছে"
"হ্যাঁ, চাইলেই হলো আর কি! অতই সহজ!"
"সহজ না?" আমি তাকালাম দেবশিশুদের নিস্পাপ চোখে।
"খুব কি কঠিন?" প্রথমবারে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
কিন্তু ওরা কেউ কোন কথা বলছেনা। অস্বস্তিকর একটা নীরবতা বিরাজমান। ওদের সুরেলা কন্ঠের গান বন্ধ হয়ে গেছে সেই কখন!
হঠাৎ করে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে উঠলো, "তুমি চলে যাও"
মৃদু ফিসফিস ধীরে ধীরে সমস্বরে উচ্চারিত হতে থাকে, "তুমি চলে যাও" "তুমি চলে যাও"

বাসের ড্রাইভারও এবার মওকা পেয়ে খুব একচোট হেসে নেয় মিটমিটিয়ে, তার গোঁফের ফাক দিয়ে। আমাকে একরাশ ধূয়োর মধ্যে নিমজ্জিত করে ভুস করে বাসটা নিয়ে চলে যায়। আমি ধূয়োর মধ্যে খাবি খেতে খেতে শুনতে পাই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে আস গানের সুর। ওরা আবার গাইতে শুরু করেছে,

"সহজ মানুষ সেতো বড় সহজ কথা নয়
বৃথেই,শুধু বৃথেই তুমি করছ অনুনয়"

গানের সুরটা যতই দূরে সরে যেতে থাকে কথাগুলো ততই আমার মনের মধ্যে গেঁথে যেতে থাকে। এরকম হলে আমার খুব কষ্ট হয়। মাথা ধরে যায়। বিপত্তির যেন শেষ নেই। বাস থেকে নির্গত ধূয়োগুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। ওরা মেঘ হয়ে যাচ্ছে। কি ভীষণ তাড়াহুড়ো! কি যেন ফন্দি এঁটেছে! বৃষ্টি হয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিতে চায়? হাসি পেলো আমার। ওরা যদি জানতো যে বৃষ্টি কি ভীষণ প্রিয় আমার! ওরা যদি জানতো যে....একসময়..সে কোন একসময়..কোনসময় যেন? ধুচ্ছাই! হবে কোন একটা সময়, আমি বৃষ্টিতে ভিজতাম। আমার সাথে ভিজতো..কে যেন..? সেই সিক্ততায় উবে যেত সব তিক্ততা। খুব মনে আছে আমার। কিন্তু আজ এই হঠাৎ শুরু হওয়া তুমুল বৃষ্টি আমাকে ভীত করে তোলে। আমি দৌড়ুতে থাকি। খুব দৌড়ুতে থাকি। নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন আমার। এই নির্জনে কোথাও কোন ঘরবাড়ি নেই। আমি কোথায় যাব? বুকের ভেতর জীবন ছটফট করতে থাকে। "এই রিক্সা"! কোনমতে বলতে পারি আমি হাঁপাতে হাঁপাতে। রিক্সার আরোহিনী আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে যেন।
"আমাকে নাও...আমাকে নাও" ব্যাকুল কন্ঠে বলি আমি। আমি তাকে চিনতে পেরেছি। কি অদ্ভুত কাকতাল, এই ঝড়জলের রাতে ঠিকঠিক তার সাথেই দেখা হয়ে গেল আমার! আর চিন্তা কি!
"না"
শীতল প্রত্যাখ্যান তার কন্ঠে।
"কেন?"
"কারণ, তুমি বেদম হাঁপিয়ে গেছ, তোমার আর আগের মত দম নেই
কারণ,কারণ তোমার হাতের কাটা দাগটা মুছে গেছে, যায় নিমিষেই
কারণ, কারণ, কারন..তুমি ভুলপথে হাঁটো রাখতে পারোনা খেই.."
সে খলবলিয়ে হাসতে শুরু করে। "তবে প্রকৃত কারণটা তো বলিইনি এখনও"

"কি" জানতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু আমি আসলেই বড্ড ক্লান্ত, বড় বড় করে শ্বাস নেবার তাড়ায় আমার আর প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনা। কিন্তু আমার উৎসুক জিজ্ঞাসু মুখ দেখে হয়তো তার করুণা হয়। সে নেমে আসে।
"জবাব চাও?"
আমি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।
"কতটা চাও?"
"আমি..."
"কতটা নেয়ার ক্ষমতা আছে তোমার?"
"আমার.."
"পেয়েছো প্রশ্নের উত্তর"?
সে ব্যঙ্গের হাসি হাসে আমার দিকে চেয়ে।
"বুড়োদের একটা ট্রেন আছে আর মিনিট দশেক পরে, সোজা গেলে পাবে, ওখানটাতেই যাও!"
"কিন্তু আমি.."
আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দেয়না সে। হুশ করে কোথা থেকে এক অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ী এসে থামে। সে চলে যায়। কার সাথে আমার দেখার ইচ্ছে হয়না।
কিন্তু আমি এখন কি করব! বুড়োদের ইস্টিশানে যাবার কোন মানেই নেই। কিন্তু আমাকে কোথাও যেতেই হবে। এভাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলে লাভ নেই কোন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি কি করা যায়। হঠাৎ একটা খসখসে কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম,
'কোথায় যাবে তুমি?"
আরেহ! ধুর। এ যে সেই বুড়োদের স্টেশনেই এসে পড়েছি দেখছি।
"নাহ, কোথাও না, এমনি হাঁটছি"
খিক খিক করে হেসে ওঠে বোকা বুড়ো। বলে,
"আমরাও অমন এমনি এমনি হেঁটেই এখানে এসেছি বাছা, তোমারও আর বেশি দেরী নেই"
"দাও তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও" হৃদ্যতা প্রকাশ পায় একজনের কন্ঠে।
"হ্যাঁ, ট্রেন আসতে আর বেশি বাকি নেই" সবাই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে আমাকে নিয়ে।
আমি রীতিমত বিরক্ত হয়ে উঠি তাদের এহেন উপযাচকপূর্ণ আচরণে।
"বুড়োদের সাথে থাকতে বয়েই গেছে আমার" রূঢ়তা প্রকাশ পায় আমার কন্ঠে।
ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ট্রেনে ওঠার যোগাড়যন্তর শুরু করে।

কিন্তু এ কি! এ ট্রেনটাতো দেখছি বেজায় বেগতিক আচরণ শুরু করেছে! লাইন ছেড়ে দিয়ে আমার পেছনে লেগেছে। আবারও দৌড় দৌড় দৌড়!

"আর পারিনা আর পারিনা আমার ক্লান্তি আমায় কাঁদায়"

কতক্ষণ এভাবে দৌড়েছি মনে নেই। অচেতন হয়ে গেছিলাম হয়তোবা। চেতনা ফিরে পাবার পরে দেখি মিশমিশে অন্ধকার এক ঘরে শুয়ে আছি। কারা যেন অপেক্ষা করছিলো আমার জন্যেই, আমার চেতন ফিরে পাওয়ার জন্যেই।
"এই চুপ চুপ" উদগ্রীব হয়ে ওঠে ওরা।
"তোমরা কে?"
"আমরা কে অত জেনে কি হবে? তোমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে এনেছি। এখন তোমাকে তোমার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছে দিলেই তো হল? গাড়ি অপেক্ষা করছে বাইরে"
"আমার অভিষ্ঠ লক্ষ্য কি?
"জানোনা তুমি!" কৌতুক প্রকাশ পায় ওদের কন্ঠে।
"এত তাড়াতাড়ি অবশ্য না গেলেও চলবে, তবে বেশি দেরীও নেই। আর একদিন না একদিন তো যেতে হবেই ,নাকি!" ওরা বলে।
"এত অন্ধকার কেন এখানে?" আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই।
"আলো পাবে কোথায় বোকা! সব আলো খরচ করে এসেছো না! যাইহোক, শোনো, বেশিক্ষণ কিন্তু সময় নেই, আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি সিদ্ধান্ত নাও থাকবে নাকি যাবে। আমরা চলে গেলে কিন্তু এই অন্ধকার ঘরে তোমাকে একা থাকতে হবে"
"আমি যাবোনা"
"যাবেনা? আরেকবার ভাবো। একদিনতো আসতেই হবে। কিভাবে, কেমনভাবে আসো তার কোন ঠিক আছে? আজকের দিনটা ভালো, চলে আসো"
"নাহ!" অস্বীকৃতি জানাই আমি। ওরা চলে যায়।

আমি আমার একমুঠো জীবন প্রাণপণে খামচে ধরে থাকি গোঁয়ারগোবিন্দের মত....

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:১১
১৬১টি মন্তব্য ১৫৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি অজ্ঞ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫২


ভাবতে পারো
৮০ টুকরো হতে হয়;
ভাবতে পারো
জ্বলে পুড়ে মরতে হয়!
ভাবতে পারো
কতটুকু লোভ লালসা
থাকলে পরে
এমন হবে বলো দেখি;
ভাবতে পারো
কেমন জন্ম মৃত্যুর খেলা;
জানি আমি
তুমি কিছু ভাবতে পারবে না
কারণ তুমি অজ্ঞ
মৃত্যুর পরে একা... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×