somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যথেষ্ট দূর্নাম নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে (শেষ পর্ব)

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৩:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব : Click This Link

অনেকদিন পর সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে পৃথিবীকে অচেনা লাগছিল। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলমনা সকাল না সন্ধ্যা হল। কিছুক্ষণ পর আশপাশের রুম থেকে অন্যদের শব্দ শুনে বুঝলাম ওহ ইহা একটি সকাল। আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। নাস্তা সেরে রওনা হলাম আমাদের মূল গন্তব্য, টাঙ্গুয়ার হাওর । ২০০০ সালে যেটাকে দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট (পরিবেশ-প্রতিবেশের দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সংরক্ষিত এলাকা) ঘোষণা করা হয়েছে। ভাবতেই ভালো লাগছিল সেখানে যাচ্ছি। ভালবাসা নিয়ে এগিয়েও যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সব ধুলোতে মিশে গেল, যখন শুনলাম ধুলোমাখা পথে তিন ঘণ্টার একটা মোটরসাইকেল জার্নি আছে।
আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। তবে কিছুই করার নেই।
সুরমা নদী পার হয়ে তিন ঘণ্টার আঁকাবাঁকা পথ পেরুনোর জন্য ১৪টি মোটরসাইকেলে ১৪ জন রওনা হলাম। আমার চালকের নাম শফিক রানা। চালকদের মধ্যে কিছুটা নেতা গোছের রানা বেশ সহযোগিতা করেছিল বিভিন্ন স্পটে নেমে ছবি তোলায়। প্রথম দিকে কিছুক্ষণ পরপর ছবি তোলার জন্য তাকে থামাচ্ছিলাম। ভেবেছি বিরক্ত হচ্ছে। তাই আর ছবি তুলব না ভেবে অনেকক্ষণ যখন আর তাকে থামাতে বলছি না তখন সে নিজ থেকেই বলছিল, ভাইজান এইটা তোলেন।
ভাইজান ওইটা তোলেন।
আমিও চরম উৎসাহে পুনরায় ছবি তুলতে শুরু করলাম। কোথাও কোথাও কাউকে ধরে রিকোয়েস্ট করে ছবি তুলতে হলো। কোথাও কেউ আমাকে রিকোয়েস্ট করলো ছবি তুলে দেয়ার জন্য। কোনও রিকোয়েস্টই এই পাহাড়ি ভূমিতে না ফেলে পূরণ করে গেলাম। কিছুক্ষণ চলি।
আবার থেমে থেমে তুলি ছবি।
এভাবেই চলছিল আমার মোটরসাইকেল জার্নি। কখনও অন্য সফরসঙ্গীর আগে চলে যাচ্ছিলাম। কখনওবা ফটোসেশনের কারণে পিছিয়ে পড়ছিলাম।
অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে। কখনও ছোট কখনও বড় পাহাড়, কখনও ছোট-বড় খাল। সব মিলিয়ে এ যাত্রা অসাধারণ। ওপাশে ভারতের মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড় ছিল দৃষ্টিনন্দন। দুটি সীমান্ত এরিয়াও পড়ল পথে। মালামাল আসা যাওয়া করছে। মোটরসাইকেল চালক শফিক রানাকে বললাম, এদিক দিয়ে গিয়েছেন ভারতে?
সে অদ্ভুত উত্তর দিল, জিও।
আমি ভড়কে গেলাম। ইন্ডিয়ায় যাওয়ার প্রশ্নের কারণে কী হিন্দিতে উত্তর নাকি?
প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরেরও সংশ্লিষ্টতা মেলাতে পারছিলাম না। কারণ, 'জিও' মানে বেঁচে থাকো।
অবাক হলাম কিন্তু শফিক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করার দুঃসাহস পেলাম না। তাই অন্য প্রশ্নে চলে গেলাম। শফিক ভাই, এই মোটরসাইকেল চালানোই কী আপনার পেশা নাকি?
আবারও তার সেই উত্তর, জিও। এবার আমার জ্ঞান কিঞ্চিত খুলল।
'জিও' মানে আমাকে তিনি বেঁচে থাকার শুভ কামনা করছেন না।
জিও মানে, হ্যাঁ।
তাই চুড়ান্ত শিওর হওয়ার জন্য আরেকটা টোপ ফেললাম। অতি সহজ এবং উত্তর জানা প্রশ্ন, শফিক ভাই, আমরা তো টাঙ্গুয়ার হাওরেই যাচ্ছি নাকি?
শফিক ভাই মাথা নাড়লেন, জিও।
পথে যেতে যেতে আরেকটা মজার জিনিস পেলাম। ছোট ছোট খালগুলোতে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কিছু সাকো বানানো হয়েছে। সেসব সাকোর সামনে বাশ দিয়ে পথ আটকে টোর তোলে এলাকার কিশোর সমাজ। জোদড় ধমক দিলে আবার ঠোল মাফ। ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে।

হাওরের সীমানায় পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগল। নেমেই ধুলো ঝেড়ে নিলাম। অবস্থা খারাপ। জ্যাকেট থেকে প্রায় তিন কেজি ধুলা পড়ল। মুখের ভেতরে অনুভব করলাম আরো মিনিমাম আধা কেজি ধুলা আছে।
আমরা আইইউসিএন-এর নানা কার্যক্রমের কথাবার্তা শুনে রওয়ানা হলাম দুটি ট্রলারযোগে হাওরের উদ্দেশে। হাওরের যত ভেতরে যাই ততই বাড়তে থাকে সৌন্দর্য। বাড়তে থাকে আমাদের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ।
প্রথমদিকে দুয়েকটি অতিথি পাখি দেখেই সবাই তুমুল উৎসাহে গোটা বিশেক ছবি তুলে ফেললাম। ভাবনা ছিল, এই বুঝি সব। কিন্তু ভেতরে যে কি বিশাল অভয়াশ্রম পাখিদের, তা আমাদের ধারণায়ও ছিল না। লাখো পাখি সমাবেশে আমরা ট্রলারের বিরক্তিকর শব্দ নিয়ে ঢুকছিলাম বার বার। উপরে নীল আকাশ, নিচে স্বচ্ছ পানি, পাখি ও মাছের এই সৌন্দর্য ভোলার মতো নয়।
দুটি ট্রলারেই সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি সবাই চলছিল নিজের কাজ সম্পাদনেরও তাড়া। সব মিলিয়ে ঘণ্টাদুয়েক হাওরে থেকে আমরা ডাঙায় ফিরলাম। সেখানে খেয়ে আমরা আবার রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে দুয়েক জায়গা যাত্রা বিরতিতে চা-নাস্তা খেয়ে ফিরছিলাম কবি আর সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল ময়েজউদ্দিনের সুনামগঞ্জে। যিনি কবিতায় জানিয়েছিলেন, তার প্রিয় সুনামগঞ্জের প্রেম, এ শহর ছেড়ে পালাব কোথায়?
না পালালেও যাকে দুর্ঘটনায় দুর্ভাগ্য সরিয়ে নিয়ে গেছে অনেকদূরে। সুনামগঞ্জে সৃজনশীলতা আর অন্যরকম মানসিকতার অভাব নেই। পদে পদে টের পাচ্ছিলাম। শেষবার টের পেলাম এক ভিক্ষুককে টাকা দিতে গিয়ে। সারাজীবন দেখেছি ভিক্ষুক টাকা চায় ভাত খাওয়ার জন্য। তিনি চাইলেন চা খেতে।
হাছন রাজার দেশে এমন চাওয়া স্বাভাবিক মেনে টাকা দিতে গিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। তিনি জোড়া দেয়া পুরোনো টাকা নেবেন না। আমার মানিব্যাগে থাকা কচকচে টাকাই তাকে দিতে হবে। সেটা নিতে বয়স্ক ভিক্ষুকের সেকি ছেলেমানুষি। অবাক না হয়ে পারলাম না।
সারাদিন পার করে সন্ধ্যায় যখন ফিরছিলাম, তখন ভালোই লাগছিল। শওকত ভাইকে ম্যান অব দি ডে ঘোষণা করতে গিয়েও করতে পারলাম না, কারণ সুব্রত দা বিশেষ এক কারণে ম্যান অব দি ডে হওয়ার দাবিদার হয়ে গেছেন।
তাকে দেখলাম, তিনি যে কারো যে কোনও কথাই শুনে হেসে দেন। বলেন, এটা ভালো বলেছেন। টক অব দি ডে।
আমি সুব্রত দাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললাম দাদা, একদিনে টক অব দি ডে কয়টা হয়?
সুব্রত দা হেসে দিলেন, আর তার ডে-এর শেষ টক করতে পারলেন না। চুপ করে গেলেন।
আমরা গেস্টহাউসে ঢুকলাম। ফ্রেশ হলাম এবং বিশেষ তাড়ার কারণে আর সকালে উঠে রওয়ানা দেয়ার ঝামেলা এড়াতে ডেইলি স্টারের এমরান আর আমি না পালানোর শহর থেকে মোটামুটি পালিয়ে এলাম।
তবে এটা জানি, পালানো যাবে না স্মৃতি থেকে। যে ভালবাসা ছড়িয়ে এসেছি হাওরে সেটাই ভুলি কী করে?


ছবি: ১. সেই অতিথী পাখিরা
২.পথের মাঝে খাল
৩.এক ঝাক হাঁসেরা
৪. হাওরে মাছ ধরা
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

সততা হলে প্রতারণার ফাঁদ হতে পারে

লিখেছেন মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম নাদিম, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৯

বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে। ক্রেতাদের মনে যে প্রশ্নগুলো থাকা উচিত:

(১) ওজন মাপার যন্ত্র কী ঠিক আছে?
(২) মিষ্টির মান কেমন?
(৩) মিষ্টি পূর্বের দামের সাথে এখনের দামের পার্থক্য কত?
(৪) এই দোকানে এতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০, কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×