দেউলিয়া আমেরিকা!
মৃণালকান্তি দাস
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাই বদলে দিতে বাধ্য করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বিদেশনীতি। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি ওবামার বাজেট ঘোষণায় অন্তত তারই ইঙ্গিত মিলেছে। ওবামা স্বীকার করেছেন, আগামী বছর বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে সমগ্র জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১১শতাংশ। এর প্রভাব পড়বে গোটা মার্কিন মুলুকেই। ওবামার নিজের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই বাজেট ঘাটতি থেকে মুক্তি পেতে এক দশক সময় লেগে যেতে পারে। আতঙ্ক চাপতে পারেনি খোদ মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড স্যানগার লিখছেন, গত দশকজুড়ে জাপান যে ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও সেই একই রোগে ভুগতে হতে পারে। ঋণ দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোটা দুনিয়ায় জাপানের প্রভাবও হ্রাস পায়। একই পথে এগোচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও!
গোটা আমেরিকা জুড়েই এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে আর্থিক ঋণের পরিমাণ নিয়ে। আকাদেমিক স্তরে এই বিতর্কের একদিকে আছেন কেইনস-অনুগামী সম্প্রতি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক পল ক্রুগম্যান এবং অপরপক্ষে আছেন অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ নীল ফার্গুসন। ফার্গুসন কেবলমাত্র হার্ভার্ডের অধ্যাপক নন। তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘অ্যাসোট অব ফিনান্স’ প্রমাণ করতে চেয়েছে যে আমেরিকার এই ঋণের বোঝা আন্তর্জাতিক স্তরে তার ভূমিকাকে ক্রমাগত নড়বড়ে করবে। এই বিতর্কে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে গত ৭ই ডিসেম্বর ‘নিউজ উইক’ সাপ্তাহিকে ফার্গুসনের প্রবন্ধ ‘দ্য এম্পায়ার অ্যাট রিস্ক’। সেখানে তিনি মন্তব্য করেছেন একদা বিশ্ব জোড়া সাম্রাজ্যের অধিকারী স্পেন, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন এই অভ্যন্তরীণ ঋণের কারণে তাদের ক্ষমতা খুইয়েছিল। কারণ সেই দেউলিয়াপনার জন্যই তারা তাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেনাবাহিনীর ভরণ-পোষণ চালাতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং কালক্রমে বাহিনীর আকার শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হতে থাকে। ফার্গুসন অর্থনীতির ইতিহাস ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে স্পেন-সমুদ্রযাত্রার মাধ্যমে দুনিয়ার ভূগোল সন্াীরনে যে দেশটি অবশ্যই অগ্রপথিক— ১৫৫৭ থেকে ১৬৯৬ এই ১৪০ বছরে অন্তত ১৪বার ঋণের দায়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। যার অনিবার্য পরিণতিতে দেশটির কাঁধের উপর স্থায়ীভাবে চেপে বসেছে মুদ্রাস্ফীতির ভূত। বিপ্লব পূর্ববর্তী ফ্রান্সে রাজকীয় আয়ের ৫২শতাংশ অর্থই প্রতি বছর ব্যয় হতো এই ঋণ মেটাতে। শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্যেও দেনার সুদ মেটাতে যেখানে ১৮১৬ সালে প্রয়োজন হতো মোট রাজস্বের ১৫শতাংশ, সত্তর বছরের মাথায় সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ৫০শতাংশে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটেনকে বছরে ঋণের সুদ দিতে হতো মোট রাজস্বের ৪৪শতাংশ। আর সেই কারণেই হিটলারের ঝটিকা বাহিনীর আক্রমণের মুখে ওই দেশকে বারবার নতজানু হতে হয়েছে। আমেরিকার কর্তৃপক্ষের সামনে ফার্গুসন দূর অতীতের এইসব উদাহরণ একেবারে অকারণে তুলে ধরেননি। আমেরিকার বাজেট অফিস সম্প্রতি এক হিসেব দাখিল করে জানিয়েছে, যে আমেরিকার দেশী এবং বিদেশী নাগরিকদের মোট আয়ের ৪১শতাংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ দিতে। এক দশক পরে এই অঙ্কটা গিয়ে পৌঁছবে ৬৮শতাংশে।
এই সরকারী তথ্য তুলে ধরেই ফার্গুসন আরও আতঙ্কজনক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়ে বলছেন, যে আগামী ৩০বছরে আমেরিকার কোনো রাষ্ট্রপ্রধানই সামঞ্জস্যপূর্ণ বার্ষিক বাজেট পেশ করতে পারবেন না। আর ২০৩৯সালে এই আর্থিক ঋণের সুদ গিয়ে পৌঁছবে সরকারী আয়ের ৯১শতাংশে। তাঁর মতে এই অবনমিত আর্থিক প্রবণতা প্রথমেই টান দেবে প্রতিরক্ষা বাজেটে। কারণ নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বাতিল করে যদি ওই বাজেট অক্ষুণ্ণ রাখা হয় তাহলে সারা দেশে যে গণবিক্ষোভ শুরু হবে তা সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেমন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার জনমত যুদ্ধবিরোধী হয়েছিল, তেমনি খুব শীঘ্রই এমন এক জনমত গড়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই প্রবল যে ইরাক বা আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালানো একটি আর্থিক ভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্রের পক্ষে নিতান্তই অবিবেচক বিলাসিতা। নিজ দেশের অর্থনীতির এমন মলিন মানচিত্র তুলে ধরার দায়ে তিনি কেইনস শিষ্যদের কামানের মুখে পড়েছেন। তাঁরা বিকল্প দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বলেছেন জাপানে তো জনতার আয়ের ২০০শতাংশ ব্যয় হয় ঋণ শোধ করতে। কিন্তু তাতে জাপান কি খুব একটা পিছিয়ে আছে অন্যদের থেকে! ফার্গুসন এই বিপরীত দৃষ্টান্ত মানেনি। তাঁর মতে জাপান ঋণ শোধ করার যে রাস্তা নিয়েছিল আমেরিকা সেই পথে যায়নি। আমেরিকা তার ফেডারেল রিজার্ভ এবং বিদেশী ব্যাঙ্কগুলির কাঁধে ভর করে এই ঋণ শোধ করছে। কারণ জনমতের চাপে বারাক ওবামাকেও জনস্বাস্থ্য, উষ্ণায়ন বা অন্যান্য জনহিতকর প্রকল্পে টাকা ঢালতে হচ্ছে। সেই কারণেই এখন আমেরিকার হয়ে এই ঋণ শোধের বোঝা চেপেছে আরও কয়েকটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে এশিয়াটিক সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের উপর। কিন্তু সেই ব্যাঙ্কের চীনের শরিক ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে জানিয়েছে যে একটি দেশের ঋণ শোধ করার দায় নিয়ে এই ব্যাঙ্ক গঠিত হয়নি। শুধু তাই নয়, ওইসব বিদেশী ব্যাঙ্কে বিনিয়োগকারীরা এখন উত্তেজিতভাবে এই দাবিই তুলছেন যে তাঁদের টাকাতেই যদি আমেরিকার অর্থনীতি বেঁচে থাকে তবে তাঁরা অধিকতর হারে সুদ পাবেন না কেন? যাঁদের টাকায় আমেরকিা এখন দেনার সুদ মেটাচ্ছে তাঁদের দাবির প্রতি দেশটি সহানুভূতিশীল হয় — সেটা তাকে হয়তো হতেই হবে — তাহলে তার অর্থনীতি আরও ডুববে।
লক্ষ্য করুন, মন্দা জারি, এক জানুয়ারি মাসেই সরাসরি ৭১হাজার ৪৮২জনকে ছাঁটাই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে নতুন বছর ২০১০ শুরু হয়েছে আমেরিকার। এমনিতেই ছাঁটাই চলছিল। কিন্তু, ৭১হাজার ৪৮২জনকে ছাঁটাইয়ের ঘোষণা, গত পাঁচ মাসে সবচেয়ে বেশি। জানিয়েছে গ্রে অ্যান্ড ক্রিস্টমাস। যথারীতি সংস্থা তার প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ছাঁটাইয়ের এই বৃদ্ধিকে ‘মন্দা আরও ঘোরতর’ হয়েছে বলে ভাবা ঠিক হবে না। চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি ছাঁটাই হয়েছে টেলিকম ক্ষেত্রে। গত বছর ডিসেম্বরের তুলনায় ৫৯শতাংশ বেশি।
হোয়াইট হাউসে এক বছর পূর্ণ হওয়ার পরের দিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা নিজেই তাঁর উপলব্ধি প্রকাশ করে বলেছেন, মার্কিন জনগণ ক্রুদ্ধ ও হতাশ হয়ে পড়েছেন। অপরদিকে তিনি গত এক বছরে তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে অবহেলা দেখিয়েছেন। গত এক বছরে অজস্র সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে সময়ের অভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে ডেমোক্র্যাট সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির দখলে থাকা ম্যাসাচুসেটস আসনটি নির্বাচনে রিপাবলিক্যান প্রার্থী বিস্ময়কর ভাবে জিতে নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ওবামা স্বীকার করেছেন, মানুষ গত এক বা দু’বছরের ঘটনাবলীতে বিরক্ত হননি। তাঁরা ক্ষুব্ধ সবমিলিয়ে গত ৮বছরের ঘটনাবলীতে। সাধারণ মানুষ যখন বেশ নিশ্চিত অবস্থায় ছিলেন, সে সময় হঠাৎ অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষের মজুরি বা বেতন কমে গেছে। তাঁরা হঠাৎ দেখলো ব্যাঙ্কগুলিতে ধস নামছে। তাঁদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় উবে যাচ্ছে।
ম্যাসাচুসেটস কেন্দ্রে ডেমোক্র্যাটদের হার সম্পর্কে তিনি বিস্মিত নন বলে ওবামা মন্তব্য করেছেন। এ বি সি নিউজ চ্যানেলের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কারণ আমি নিজেও নিরাশ। গত এক দশক ধরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির পক্ষে প্রয়োজনীয় ধরনের অগ্রগতি দেশে ঘটেনি। আমি নির্বাচনী প্রচারে এই ধরনের অগ্রগতিরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তবে আমি নিজেও কিছু ভুল করেছি।
আলোচিত ব্লগ
মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?
শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন
জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।
আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব
সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন