somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশে যুক্ত হলো নতুন তারা, কিছু কান্না

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারী বান্দরবানে চিটাগাং কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে ৫ টি গাড়ী বহর নিয়ে এক পিকনিক আসে। ফিরার পথে সে গাড়ী পড়ে যায় গভীর খাদে। আমরা হারায় আমাদের বিভাগের সাতজন ভাইবোনকে। সাথে হারাই দু অভিভাবককে। সে ঘটনার পর আমরা যারা ঐ পিকনিকে ছিলাম তারা একটা ডায়েরী নিজেদের কম্পিউটার থেকে অফসেট পেপারে বের করি। ২০ জনের লেখা ছিল।
১২ ফেব্রুয়ারী ২০১০ এ যেখানে গাড়ী পড়ছিল তার উপরে জুমার নামাজের পর দোয়া দরুদ পড়া হবে।

সংকলনটিতে

আমার লেখা সম্পাদকীয়


... আমাদের অনেকে ব্যাক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ডায়েরীতে লিখে রাখে। দুঃখের কথাগুলো প্রকাশ করা গেলে ভারটা অনেকটা কমে যায়। ১২ ফেব্রুয়ারী অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে যে দুঃসহ ঘটনা ঘটে গেছে তা অনেকের জন্যই জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত। সারাদিন যাদের সাথে আনন্দ করেছি, গল্প করেছি, একসাথে খেয়েছি তাদের মধ্যে হতে নয়জনকে আমরা হারিয়েছি চিরদিনের জন্য।কেউ কেউ এখনো আছে দুঃসহ শারীরিক ব্যাথার যন্ত্রণা নিয়ে।আমরা চেয়েছি আমাদের সেদিনের অনুভূতিগুলো একই সুতায় বাঁধতে। চেয়েছি শোককে শক্তিতে পরিণত করতে। এরই প্রয়াস হিসাবে বের করা হলো “ ট্র্যাজেডী ১২ ফেব্রুয়ারী”। এই সংকলনে আমাদের কজন বন্ধুর সেদিনের ডায়েরী প্রকাশ করা হলো। এটা সম্পূর্ণরুপে আমাদের ব্যাক্তিগত অনুভূতির এক আনাড়ী প্রকাশ। যেহেতু আমরা পেশাদার প্রকাশনার কাজে জড়িত নই সেহেতু বহু ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। আশা করি পাঠকরা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখবেন।

এডিসন রেলগাড়িতে নিজের প্রেস দিয়ে পত্রিকা বের করতেন। এডিসনের সে ঘটনা আমাদের সাহসী করেছে ধরণের সংকলনপ্রকাশ করতে। আমরা কোন ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়া ঘরে বসে নিজেরাই সম্পূর্ণ ভাবে “ ট্র্যাজেডী ১২ ফেব্রুয়ারী”প্রকাশ করেছি।

লেখাগুলো একটা বিষয়কেন্দ্রিক হওয়ায় লেখায় বৈচিত্র্য নাআসলেও আমরা বলতে পারি এই সংকলন পড়ে সেদিনের অনেকঅজানা ঘটনা পাঠককুল জানতে পারবেন।

আমাদের একান্ত প্রত্যাশা ভুল বুঝে কেউ ব্যাপারটাকে অন্যভাবেদেখবেন না। বরং ভবিষ্যতে যেন আরো সুন্দর কিছু প্রকাশ করতে পারি সে ব্যাপারে সকলে সহযোগিতা একান্ত কাম্য।আমরা চাই সুস্থ সংষ্কৃতির বিপুল বিকাশ হোক আমাদের সকলশিক্ষাঙ্গন গুলোতে।

সেখানে আমার লেখাটি ছিল-

আকাশে যুক্ত হলো নতুন তারা



আকাশের তারা গুণা আমার দৈনন্দিন অভ্যাসের একটি। প্রতিদিন আকাশের তারা গুনি। যেদিন তারা থাকে না সেদিন আকাশের দিকে বিমর্ষ চোখে তাকিয়ে থাকি। ১২ ফেব্রুয়ারী আমার আকাশের দিকে তাকানোর সময় হয়নি। ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সের আতঙ্কিত আওয়াজে ছুটলাম সদর হাসপাতালে। দেখি বাইরে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবাই ভিতরে ঢুকতে চায়। বহু কষ্টে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে আহতরা পড়ে আছে। বেড স্বল্প।ফ্লোরে বসে বসে আহত ভাইরা কাতরাচ্ছে। ডাক্তারও কম। কাকে রাখে কাকে দেখবেন এই অবস্থা। নার্সের স্বল্পতায় আমরাই নামলাম নার্সের ভূমিকায়।

এক ভাইয়ের মুখ একপাশ অনেক খানি কেটে গেছে। সেলাই লাগবে। তার পা চেপে ধরলাম যাতে নড়াচড়া না করেন। ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে মুখের তিন-চারদিকে। ডাক্তারের তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে। যেহেতু অনেক রোগী। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ইনজেকশনের সুইচ বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারের সেদিকে নজর নাই। ভাই কাতরাচ্ছেনতো কাতরাচ্ছেন। চাঁদ আকৃতির বিশাল সুই দিয়ে বড় বড় করে সেলাই দেওয়া হচ্ছে। পাশেই আর এক আপুর সেলাই চলছিল। আপুর সে কি চিৎকার! দোতলায় গিয়ে দেখি একজনের সেলাইয়ের পরও মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। তাকে আবার নিচে নিয়ে আসা হল। পূণরায় সেলাই করতে হয়। সে কি কষ্ট। রেশমা আপু বাকরুদ্ধ। স্বপরিবারে এসেছিলেন। কিন্তু যেতে হল মা-বাবা ছাড়া। চারদিকে ভয়াবহ পরিবেশ যাতে তার দেখতে না হয় এজন্য তাকে আর এম ও রুমে বসানো হল। তার ভাই প্রথমে বাবার জন্য কিছুক্ষণ কাঁদলো। আমরা স্বান্তনা দেওয়ার সুযোগটুকু পাচ্ছিলাম না। পরে যখন দেখল মা-ও বেশ আহত হয়েছে। তখন জোর করে স্বাভাবিক হল। দোতলায় ছেলে আকুতি করে নার্সকে বলছে- সিস্টার, আমার মাকে দয়া করে ঘুমের ইনজেকশন দিন। বাবার কথা জানতে দিবেন না। ছেলে অনেক অনুনয় করল। নার্স বলল, এটা সম্ভব না। ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া তা দেওয়া যাবে না। ছেলে অনুমতি আনার জন্য ছুটাছুটি করতে লাগল। কিন্তু ডাক্তাররা যে তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত।

দোতলায় ফর্সা এক আপুকে দেখলাম শারীরিক তেমন আঘাত না পেলেও অজ্ঞান হয়ে আছেন। ডাক্তার তার হাত পাঞ্চ করে জ্ঞান আনার চেষ্টা করছেন। আপু ঠোট নাড়ার চেষ্টা করছেন।নিচে এক ভাইকে চিকিৎসা দেওয়ার পর বাইরের চেয়ারে বসানো হল। দেখি কিছক্ষণ পর সে বমি করছে। খারাপ লক্ষণ।ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। আর্মি এক ডাক্তারকে অনেকটা ধরে নিয়ে আসলাম।রেশমা আপুর বাবাকে আনা হলো। পেটটা ফোলা। ইমার্জেন্সী রুমে ঢুকানো হল। কিছুক্ষণ পর সাদা কাপড়ে মুখ দেখে বেরকরা হল। আরেক আপুকেও ইমার্জেন্সী রুম থেকে সাদা কাপড়ে আবৃত করে আনা হল। পৃথিবীতে এদের পদাচারণা শেষ।এরিমধ্যে আরো এক মৃত আপুকে আনা হল।

বনভোজনের স্থান নির্বাচনে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দেখলাম বান্দরবানের ব্যাপারে আগ্রহ নেই। বান্দরবানের স্থানীয় ছেলে হিসেবে তাতে কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু সারাদিনের ঘুরা শেষে যখন বিদায় নিচ্ছিলো তখন দেখি সবার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। আত্মতৃপ্তির অবয়ব। বান্দরবান তাদের নিরাশ করে নাই ভেবে আমিও আনন্দ পাচ্ছিলাম। হয়ত সবাই গভীর প্রতীক্ষায় কখন শহরের গিয়ে পরিবারের কাছে, বন্ধুদের কাছে মজার স্মৃতিগুলো প্রকাশ করবে। না তা আর হলো না।সারাদিন কি করেছে তা জানতে না চেয়ে রাতে পরিবারের সদস্যরা, বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত কাঙ্খিতজন অন্তত ভাল আছে কিনাএটা জানার জন্য। একজন চালকের অসতর্কতার কারণে সারাদিনের স্বপেড়বর বান্দরবান শহর সন্ধ্যায় হয়ে গেল এক আতঙ্কিত নগরী। বনভোজনেযাওয়া অনেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে জীবনে কখনো বান্দরবানমুখী হবে না। অথচ দুপুর বেলায়ও তাদের কেউ কেউ চিন্তা করেছিল সামনের বার পরিবারের সাথে আসবে। বান্দরবানকে নিয়ে রঙিন রঙিন স্বপড়বও বুনেছিল কেউ কেউ। রাত বারোটা বাজার আগেই একটা গতি হল। আহতদের বেশির ভাগকেই চমেকে পাঠিয়ে দেওয়া হল। যখন আহত একজনকে স্ট্রেচারে ধরে আর্মির অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিচ্ছিলাম তখন পাশে দেখি বয়স্ক কয়েকজন লোক কতজন মারা গেছেএসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে। দিলাম ধমক। বয়সে বড় ব্যাপারটা গায়ে মাখলাম না।বারোটার দিকে বাসায় ফিরছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো আকাশের দিকে তাকাতে । আকাশের দিকে তাকালে হয়ত কিছুক্ষণের
জন্য ভুলে থাকতে পারতাম সন্ধ্যা থেকে এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অতি শোকাবহ ব্যাপারগুলো। তখনই ভাবলাম আমার বন্ধুরাতো ভুলতে পারছে না। আমি কেন স্বার্থপরের মত এই কাজ করতে যাব। নতমুখে বাসায় ফিরলাম। বড়রা বলেন যারা মারা যান তারা নাকি তারা হয়ে আকাশে উঠে। সেদিন আকাশে তাকালে হয়ত নতুন কয়েকটি তারাদেখতাম। যারা আমাদের সাথে সারাদিন মজা করেছিলেন। তাঁরা দুঘন্টা কিংবা কিছু সময়ের বেশি ব্যবধানে আজ আকাশের তারা।

পরের দিন গেলাম স্পটে। ভয়াবহ অবস্থা। খাড়া পাহাড় নামতেই লাগলো আট মিনিট। এত নিচে যে উপর থেকে উচ্চ গলায় কথা বললে নিচে শুনা যায় না। মোবাইলে কথা বলতে হয়। বাসটি উল্টায় নাই। যায়নি দুমড়ে মুচড়ে। চারপাঁচটা জানালার কাচ অক্ষত। বাসটি উল্টালে যে প্রাণহানি আরো কত বাড়ত তা ভেবে শিউরে উঠলাম। হিমশীতল পানিগুলোর উপর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। উল্টালে গাড়িতে পানি ঢুকতো। যাত্রীরা সে পানিতে হাবুডুবু খেত। ছাদের উপর মই রাখতে পারায় উদ্ধারকাজ তাড়াতাড়ি হয়েছে। অন্যথায় আরো অনেক বেশি সময় লাগত। বাসে পড়ে আছে আপেল। সামনে, পিছনে, নিচে জলাধার। পানিগুলো বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা। অল্পক্ষণ পানিতে হাত রাখলেই হাত অবশ হয়ে আসে। দুপাশে চাপা পাহাড়। গাড়ির ছাদে দাঁড়ালাম। ১টি গোলাপি রঙের চুমকি কাজের সালোয়ার, চকলেট রঙের শার্ট পড়ে আছে। লিপজেল, ভেসলিন, ভিনড়ব জোড়ার কিছু জুতা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। গাড়ির বডিতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। পুলিশ একটা লাল ব্যাগ পায়। ব্যাগে চাবির গোছা ছাড়া কিছুই ছিল না।

তখনো পর্যন্ত প্রেয়সী দিদিকে পাওয়া যায় নি। মজিদ মেম্বারের নেতৃত্বে সিভিল কিছু লোক গাড়িটির সামনের অংশ উঠানোর চেষ্টা করছেন। দীর্ঘ ছয় ঘন্টা কসরতের পর গাড়ী সামনের অংশ কিছুটা উঠানো গেল। সেখানে খুটি দিয়ে বলি দেওয়া হলো। এরপর দুজন লোক ঢুকে খুঁজতে লাগলেন। গন্ধ বের হয়। তবে তা রক্তের। পুরাটা সময় আমি সেখানে ছিলাম। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলাম। মুকুল স্যার বার বার মোবাইলে খবর নিচ্ছিলেন। তাকে জানালাম আজ আর উদ্ধার কাজ চলবে না।

পরের দিন প্রেয়সীর কিছু আত্মীয় ডিসি অফিসে গেলেন। প্রেয়সীর এক কাজিন ফোন করে আমাকে সেখানে যেতে বললেন।গেলাম। এর মধ্যে কিছু কথা ছড়িয়ে গেছে। প্রেয়সী নাকি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছে। ওর জামার রঙও নাকি কে বলেছে। অবাক হলাম। প্রেয়সীর সাথে যার বিয়ের কথা ছিল তার এক আত্মীয়সহ সদর হাসপাতালে গেলাম। সেখানে রেজিষ্টার বুক দশবারের উপর তিন-চারজন লোক দেখল। না প্রেয়সীর নাম নেই।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ডি.সি সাহেব আছেন। প্রেয়সী যদি থেকে থাকে তাহলে বাসের পিছন অংশে যে জলাধার আছে সেখানে থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে যে পানি তা সরাতে আধুনিক প্রযুক্তি দরকার। মজিদ মেম্বার বার বার বললেন ফায়ার বিগ্রেডের পাম্প নামাতে। কিন্তু ফায়ার বিগ্রেডের লোকেরা নারাজ। এত নিচে নামালে পাম্পের ক্ষতি হবে। তাছাড়া তাদের জনবল এটা নামাতে পারবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিল। উদ্ধারের জিনিষ উদ্ধারের কাজে না লাগানো গেলে আর কি লাভ। অবাক হলাম। ওদেরও বা কি দোষ দিব। শুনলাম কোন জিনিষ নষ্ট হয়ে গেলে নাকি তাদের উপর এর দায় পড়ে। মজিদ মেম্বার নিজে রিস্ক নিয়ে নিজের লোক দিয়ে নামাতে পারবে বলার পর এবং স্বয়ং ডিসির নির্দেশে পাম্প নামানোর ব্যবস্থা হলো। পাম্পটি সমতলে বহন করতেই লাগে ছয়জন। সেটাকে বহু কষ্টে গড়িয়ে গড়িয়ে ৩০০ ফুট নিচে নামানো হলো।

জলাধারটি ছোট। কিন্তু পানির গভীরতা বেশি। আর পানির ঠান্ডাত্ব হিমালয়ের বরফের কাছাকাছি। গাড়ির ছাদের উপর পাম্প বসানো হল। সেচ শুরু হলো বড় বড় দুইটা পাইপ দিয়ে । দীর্ঘ সোয়া এক ঘন্টা পর পানি কিছুটা কমে। দেখা যায় একটা কাচ। সম্ভবত গাড়ির পিছনের কাচটি। সেটা সরাতেই হলুদ রঙের কাপড় দেখা যায়। সবাই চিৎকার দিয়ে উঠে। হ্যা পাওয়া গেছে প্রেয়সীকে পাওয়া গেছে। নিচে স্ট্রেচার পাঠানো হয়। সাথে বস্তা-রশি। সেগুলো দিয়ে বাঁধা হয় আমাদের সবার প্রিয় প্রেয়সীদিকে। আর স্ট্রেচার সহ তা লাগানো হয় একটা মইয়ের সাথে। ব্যাপারটা অমানবিক। কষ্টের। কিন্তু তাকে তোলানোর এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা যে আমাদের নেই। মইয়ের উপর রশিটি ২০০ ফুট উপরে আনা হয়। আমরা রশি ধরে টানি। দুজনমই ধরে থাকে। প্রেয়সী আপুকে নিচ থেকে উপরে উঠাতে ২০ মিনিটের মত লেগে যায়।

যখন উপরে উঠানো হয় দেখি তার পায়ের নিচ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। পা পানিতে সাদা হয়ে হয়ে গেছে। অনেকটা রক্ত শূন্য। মৃত মানুষের রক্ত বের হয় না। তারপরও প্রেয়সী আপুর কেন বের হয়েছে তা রহস্যজনক। ব্যাপারটা মেডিকেল পড়–য়ারাই ভাল বলতে পারবেন। প্রেয়সীদিকে তোলা হয় ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ীতে। উঠলাম সেখানে। আমার ঠিক সামনে প্রেয়াসীদি। তার কপালের টিপটি পর্যন্ত মুছে নি। হাতের আংটি রয়ে গেছে। চোখ দুটো বুজে আছেন। ঠোট দুটো চেপে। মনে হচ্ছিলো প্রেয়সী আপু ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর উঠে বলবেন আমি এখানে কেন? আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম ইশ্ প্রেয়াসী দি যদি উঠে হেসে উঠতেন। তার শরীরে তো কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। পুরা শরীরটাই স্বাভাবিক। কাপড় যেভাবে পড়ে আসছিলেন সেভাবেই আছে। মুখ সে জীবিত ঘুমন্ত মানুষের মতই।

তাকে আনা হলো মর্গে। লোকে লোকারণ্য। পানি থেকে তাকে উঠাতে গিয়ে সেখানে পাওয়া গেলো তিনটি ব্যাগ। বড় একটা নীল ব্যগ। দুইটা ভ্যানিটি ব্যাগ। বড় ব্যাগটা আমাদের আরেকজন হারানো ভাই সানি ভাইয়ের। আরো দুইটি ওড়না পাওয়া গেল। সেগুলো সব ভরা হলো বড় ব্যাগটাতে। পুলিশ কর্মকর্তা হেলাল সেগুলো আমার হেফাজতে দিলেন। তার আগে কর্মকর্তাদের সামনে বেশ কয়েকবার ব্যাগ খোলা হল। কি কি আছে তা লিস্ট করে লিখে সেখানে আমার স্বাক্ষর দিতে হল। দুইদিন ধরে পানিতে থাকায় ব্যাগটি অনেক ভারি হয়ে যায়। আলগাতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে সেটা চট্টগ্রাম কলেজে এনে জমা দিই।

মর্গ থেকে প্রেয়সীদিকে বের করা হল। সবাই একটু খানি দেখতে চায়। আপুর শান্ত চোখে মুখে বিরক্তির কোন চিহ্ন নেই। নেই পৃথিবীর প্রতি কোন ক্ষোভ। অথচ ভুল-বিভ্রান্তকর তথ্য আসায় তাকে ঠান্ডা পানিতে দুদিনের মত থাকতে হয়েছে। উঠানো হয়েছে মইয়ের সাথে বেঁধে। আপু কি ব্যাথা পান নি? তারপরতো আপু এতটুকু ভ্রু কুঞ্চিত করেন নি। এত ভালআপুটাকে কেন আমরা হারালাম।

এখন কলেজ খুলেছে। আমরা ক্লাস করছি। আমরা যে বেঞ্চিতে ক্লাস করছি সেগুলোতে বসেই হাসান ভাই, সানি ভাই, শান্তাপু, ফাজানাপু, প্রেয়সীদি, পাপড়ি আপু ও সোলায়মান ক্লাস করত। অথচ অনার্স জীবন ওদের শেষ হয়নি। পার হয়নি ফাইনাল ইয়ার। তারপরও কখনো আর এরা আসবে না ক্লাস করতে। বেঞ্চিতে বসবে না আর কখনো। ক্লাস করার সময় কথাগুলো যখন ভাবি তখন মনকে বড়ই মুমূর্ষ মনে হয়। ক্লাসে তারা কিছুক্ষণ থাকতেন মাত্র। এতেই আমাদের এত খারাপ লাগলে সারাদিন তারা পরিবারে থাকতেন যে সে পরিবারের সদস্যদের কেমন লাগছে। কল্পনা করতে পারছি না আমি সে কষ্ট।

রেশমা আপুর মা-বাবা ছাড়া আর কোন অভিভাবক অর্থনীতি বিভাগের বনভোজনে সঙ্গী হননি। তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলগাড়ী দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। তারাতো না আসলেও পারতেন যেমন আসেনি অন্য কোন অভিভাবক। কিংবা তারাতো পারতেনঅন্য গাড়িতে বসতে। এটাও হয়নি। আসলে মৃত্যুই তাদের ডেকে এনেছিল বান্দরবানে। যে কারণে না আসার সম্ভাবনা থাকলেও তাদেরকে বান্দরবান আসতে হয়েছিল।
এই দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি বিভাগের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তা যেন মোকাবেলা করার ক্ষমতা খোদা আমাদের দেন। আমরা আশা করি আহত রাশেদ আবার আমাদের সাথে মাঠে μিকেট খেলবে। দৌড়াবে ব্যাটবল নিয়ে। দীর্ঘ সময় ধরে আই সি ইউতে থাকা তুহিন ভাইয়ের পাজর জোড়া লাগবে। আবার আমাদের সাথে আগের মত বুকে বুক মিলাবেন।

অন্য যারা আহত হয়েছে তারা ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবন। চাই মহাকষ্টের যে স্মৃতি তাদের জীবনে ঘটে গেছে তার চেয়ে বিশাল আনন্দের ঘটনা তাদের জীবনকে আলোকিত করুক। তাদের অবাধ পদাচারণায় মুখর হোক আমাদের কলেজ ক্যাম্পাস।



আজ ১২ ফেব্রুয়ারী । সে কালো দিন।
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×