সকালে তমার ফোলা চোখ দেখে আম্মা বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ‘কি হয়েছে?’ তমা কিছু বলে না। কিন্তু বারবার জোর করার পরে শেষ পর্যন্ত অস্থির হয়ে বলল, ‘'তোমাকে বলে কি হবে? তুমিতো সেই একই কথা বলবা, সাবধানে থাকিস। আর কিভাবে সাবধানে থাকে মানুষ?’'
আম্মা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করে, '‘কেন, কি হইছে? ওই ছেলে আবার কি করছে?’'
‘কি আবার করবে বিয়ের কথা বলছে। খালি রাস্তায় হাত চেপে ধরছে।’ তমার চোখে আবার পানি চলে আসে।
‘'হাত চেপে ধরছে! কত বড় ফাজিল।'’ আম্মা অস্থির হয়ে উঠে, '‘দাঁড়া, আজকাই তোর আব্বারে বইলা একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’'
তমা চোখ মোছে, '‘কি করবা তুমি? তোমাকে আমি কতদিন ধরে বলতেছি।’'
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয় তমা। আম্মা ভীত-উদ্বিগ্ন মুখে পিছন পিছন আসে, মাথায় ফু দিয়ে বলে, ‘'সাবধানে যাইস।’'
তমা রেগে যায় এইবার, ‘'আবার তোমার সেই একই কথা! ভাল্লাগে না আম্মা।’'
দুমদাম বের হয়ে আসে বাসা থেকে। আবারও দেখা হয় মারুফের সাথে-সেই দৃষ্টি, সেই হাসি, সেইসব কমেন্টস। তমা কিছু বলে না, মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যায়। সামনে চলে এলে যেন মিশে যেতে চায় মাটির সাথে। একইসাথে শুরু হল নতুন উৎপাত। ফোনে জালাতন করা। যখন-তখন বাসায় ফোন করে, যেই ফোন ধরুক আজেবাজে সব কথা বলে, শিষ দেয়। তমা এরপর ফোন ধরাই বন্ধ করে দেয়। সামনে বসে থাকলেও ফোন ধরে না। কারণ জানে ফোন ধরলেই ভয়ংকর কিছু শুনতে হবে। আব্বাকে কখনো এইসব জানানো হয়না। আব্বার হার্টের সমস্যা, বেশি টেনশন সহ্য করতে পারে না। একদিন আব্বাকেও এইরকম উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করল। আব্বাতো ভয়ানক রাগারাগি করে ফোন রেখে দিয়েছে। তারপর নিজে নিজেই কিছুক্ষণ গজগজ করল পোলাপান কত বেয়াদব হয়েছে এইসব বলে। একদিন তমাকে নিয়ে আব্বা মার্কেটে গিয়েছিল। ফেরার পথে মারুফের দলবল রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কথা-বার্তা শুনে আব্বা বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বাসায় ফিরে চিন্তায় অস্থির হয়ে হইচই শুরু করে দিল। একবার বলে বেয়াদব ছেলে-পেলেকে দেখে নিবে আবার তমাকেই দোষ দেয়। তমা কেন রাস্তায় বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করে, কেন মাথা নিচু করে হাঁটে না, কেন বারান্দায় যায়......একবারতো বলছে এখন থেকে বোরখা পরে বেরোতে। তমা নিজের ঘরে বসে ছিল চুপচাপ। আম্মা বারবার চেষ্টা করছিল আব্বাকে শান্ত করতে কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। তমার কান্না পাচ্ছে কিন্তু ও দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে বসে আছে। তারপর কখন যেন বিছানায় শুয়ে পড়ে ঘুমিয়ে গেছে জানে না। অনেকক্ষণ পরে আম্মা এসে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকতে উঠে গেল। আব্বা বসে আছে থমথমে মুখে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘'মারুফ তোমারে কতদিন ধরে বিরক্ত করে?’'
‘'অনেকদিন আব্বা, এইখানে আসার পর থেকেই।’'
আব্বার গলা আরেকটু উঁচুতে উঠে, ‘এতদিন ধইরা বদমাইশের দল এইসব করতেছে, তুমি জানাইছো? নিজের মধ্যে শয়তানি নিয়া বইসা থাকলে মানুষ ভাল আচরণ করবে ক্যান?’
তমার গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে, মুখে ভাত তুলতে পারে না। আব্বা সবসময় এইরকম, কখনো বুঝে না। আম্মা থামায়, ‘'আহ, তুমি থামো তো। ও কি করবে?’'
আব্বাও চিৎকার করে ওঠে, '‘তোমার লাই পাইয়্যাই তো এই অবস্থা!’'
‘'থামো না, মেয়েটারে তুমি খাইতেও দিবা না?'’
তমা মুখ নিচু করে থাকে। চোখ ভরে পানি আসে, খেতে পারে না। তমা বোঝে অতিরিক্ত টেনশনে আব্বা এইরকম করছে। কিন্তু কথাগুলো এত নিষ্ঠুর! ও সহ্য করতে পারে না।
আম্মা শান্তভাবে বলে, ‘'কান্দিস না এখন, খা। পরশু বন্ধের দিন। তোর আব্বা এলাকার মুরুব্বীদের বইলা একটা কিছু ব্যবস্থা করবো। চিন্তা করিস না এত।’'
কোনরকমে খেয়ে উঠে তমা।
সত্যি সত্যি আব্বা এলাকার সব মুরুব্বীর সাথে কথা বলে শুক্রবার একটা সালিশের ব্যবস্থা করে। মারুফের আব্বাকে খবর দেওয়া হয়, মারুফ আর তার দলবলও অপরাধী হিসেবে হাজির থাকে। যে চাচার বাসার সামনে বিচারের ব্যবস্থা হয়, তমা আর আম্মা ওই বাসার ভিতরেই থাকে। মেয়েদের নাকি সালিশের আসরে বসতে হয় না! সবকিছু জানানো হয় মারুফের আব্বাকে। বলা হয় বিচার আপনিই করেন। উনি এত কথা শুনে ক্ষেপে উঠেন। রেগে গিয়ে মারুফকে সবার সামনেই চড়-চাপর মারতে শুরু করেন। সবাই হা হা করে উঠে, কিন্তু আশ্চর্য! তমা ভিতর থেকে দেখে মারুফের কোন ভাবান্তর হয় না। বরং মুখে কৌতুকপূর্ণ একটা সূক্ষè হাসি। কিছুক্ষণ পরে মারুফের আব্বা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। ভাঙা গলায় বলেন, ‘'মা মরা ছেলেটারে নিয়ে দেশে আসছি একটু শান্তির আশায়। অথচ ছেলেই আমাকে বুঝল না। ভাই, ছেলের হয়ে মাফ চাইতেছি। আপনি আমারে মাফ করে দ্যান।’' তমার আব্বার হাত ধরে বলেন ভদ্রলোক। ‘'আপনারা বিচার করলেন, এরপরেও যদি বেয়াদবী করে, ওরে আমি আবার আমেরিকায় পাঠায়া দিবো ওর ভাইয়ের কাছে।'’ সবাই সহানুভূতি জানায় ভদ্রলোককে। বারবার বলে '“কি বাপ আর কি ছেলে”!'
ব্যাপারটার ওইখানেই মিমাংসা হয়ে যায়। কিন্তু তমা সন্তুষ্ট হতে পারে না। মনে হয় ভদ্রলোক নিজে সহানুভূতি আদায় করে ছেলেকে বাঁচিয়ে দিলেন। ওর গত ছয়মাসের মানসিক অশান্তির কাছে ওই দুই-চারটা চড়-চাপরকে কিছুই না মনে হয়। ফিরে আসে ওরা বাসায়।
তমা অবাক হয়ে লক্ষ করে সত্যি সত্যি মারুফ আর জ্বালাতন করছে না। বাসায় উটকো ফোন বন্ধ হয়েছে, রাস্তা-ঘাটেও বিরক্ত করে না। বলা যায় দেখাই যায় না। মাঝে মাঝে সামনে পড়ে গেলেও এমন একটা ভাব করে যেন দেখেইনি। তমার তবু ভয় কাটে না। মনে হয় এটা আরো বড় কোন অঘটনের প্রস্তুতি। এভাবে প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে যায়। তমার ভয় আস্তে আস্তে কাটতে থাকে। আম্মা বা আব্বা প্রতিদিনই উদ্বিগ্নভাবে জানতে চায় মারুফ আর বিরক্ত করে কি না। তমার উত্তর শুনে আম্মা স্বস্তি পায়। আব্বা খুশিমনে মাথা নাড়ে। '‘দেখছো তো ওষুধে কাজ হইছে। বাপটা তো আর খারাপ না। খেয়াল রাখতে পারে না বইলা ছেলের এই অবস্থা। যাক, বলছে যখন আর সমস্যা করবো না।’'
তমা কিছু বলে না। ধীরে ধীরে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। সামনে পরীক্ষা, পুরোদমে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে। বন্ধদের নিয়েও ব্যস্ততার অন্ত নেই। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এক সপ্তাহ পরে। তার প্রস্তুতি চলতে থাকে। কে কি করবে, কি পরবে, সেই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা। তমা ভুলে যায় কিছুদিন আগেও ও একটা ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছিল। একদিন কলেজ শেষে তমা, প্রিয়ন্তী, রিফাত, নিপা-চার বান্ধবী গল্প করতে করতে ফিরছিল। কি একটা কথায় হেসে উঠল তমা, প্রাণখোলা, উচ্ছল হাসি। এমন সময় পিঠে একটা ঢিল এসে পড়ল। ঝট করে ফিরল তমা। চারদিকে খুঁজে দেখল, কোথাও কেউ নেই। নিচে একটা কাগজ দুমড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। তুলে নিল তমা কাগজটা। একটা ইটের গায়ে মোড়ানো। ফেলে দিতে গিয়েও কি মনে হতে খুলল তমা। ভিতরে লেখা-
“"ভেবো না পার পেয়ে গেছো
এত সহজে ছাড়বো না তোমাকে”"
তমা চারদিক ভালভাবে খুঁজতে থাকে, কিন্তু কাউকে পায় না। ভীষণ ভয় পায় তমা। প্রিয়ন্তী ওকে সান্ত্বনা দেয়। '‘ভাবিস না, আঙ্কেল তো কথা বলছেই ওর আব্বার সাথে। কিছু হবে না।'’
কিন্তু কি যেন একটা অজানা আশঙ্কায় তমার ভিতরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে।
চলবে..............
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:১৩