১.
এ বাড়িতে দুই ময়না। মানুষ ময়না, পাখি ময়না। সময় পেলেই মানুষ ময়না তাকিয়ে থাকে পাখি ময়নার দিকে। পাখি ময়না তাকিয়ে থাকে মানুষ ময়নার দিকে। ফিরে যায় সুখময় অতীতে।
কি চমৎকার দিন ছিল ময়নাদের। মায়ের বারন কে বা শুনত। উড়তে উড়তে, গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে কখন যে সন্ধ্যা হতো টের কি পেত? তারপর কতশত খুনসুটি মায়ের সাথে। কান ধরে কত বলা, এইবার শেষবার, আর না। তবুও আবার। বারবার। সেটাই তো কাল হলো। একদিন পাখি ময়না নজরে পড়লো শিকারীর আর মানুষ ময়না পড়লো এ বাড়ির বড় ছেলেটার। জাল বিছানো হলো। ধরা পড়লো জালে।
মানুষ ময়নার জায়গা হলো এ বাড়িতে। সবার কি প্রশংসা। ‘আর বলবেন না ভাবী, ইফতির ভাগ্যটা অনেক ভালো। এই সুন্দর বউ।’ ‘কি যে বলেন, গাঁয়ের মেয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে। আমরাও তো গাঁয়ের মেয়ে ছিলাম। এখন কি কেউ বলবে?’ ‘বউমা ভালো কিন্তু কথায় গেঁয়ো টানটা এখনও আছে।’ ‘তাতে কি? ঠিক করে নিবেন।’ অতএব মানুষ ময়নাকে ঠিক করানোর চেষ্টা করা হয়। ময়না আর ময়না থাকে না। নামটা বড্ড গেঁয়ো, ব্যাকডেটেড। হয়ে যায় নয়মা। শুরু হয় আধুনিক, স্মার্ট বানানোর চেষ্টা। এভাবে বলতে হয় না, এভাবে বলতে হয়, এত দৌড়াতে হয় না, চুলে সাবান দিতে হয় না, এই ড্রেসটাতে খ্যাত খ্যাত লাগে। শুদ্ধ কথা, মুগ্ধ কথা। ময়নাকে সবাই কথা শুনাতে চায়, কেউ ময়নার কথা শুনতে চায় না।
পাখি ময়নার জায়গা হল খাঁচায়। তারপর এ খাঁচা সেখাঁচায়, এহাত-সেহাত ঘুরে এসে পড়লো এই বাড়িটায়। বারান্দার যে ছোট জায়গাটায় শিলিং ফ্যান ঝুলানোর কথা সেখানে খাঁচাটা ঝুলানো হলো। মুগ্ধ মানুষজন ময়নাকে দেখে মুগ্ধ হয়। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা শিখানোর চেষ্টা করে। শুদ্ধ কথা, মুগ্ধ কথা। ময়নাকে সবাই কথা শুনাতে চায়, কেউ ময়নার কথা শুনতে চায় না। বাড়ির ছোট মেয়েটা এসে বলে, কেউ বারান্দায় পা রাখার সাথে সাথে বলবি হ্যালো, ওয়েলকাম। আরো কত উপদেশ, আদেশ।
ময়নাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। ছুটতে চায়। পারে না। তাইতো দুই ময়না তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। ঠোট নড়ে। পাখি ময়নার কথাটা বুঝা যায় না। মানুষ ময়নারটা বুঝা যায়। ‘ও ময়না, আমারে ছাইরা দিতে ক না।’
২.
একদিন খুব হৈ চৈ। মানুষ ময়না বারান্দায় আসে। পাখি ময়না বলছে ‘ও ময়না, আমারে ছাইরা দিতে ক না।’ ‘ও ময়না, আমারে ছাইরা দিতে ক না।’ ‘ও ময়না, আমারে ছাইরা দিতে ক না।’ মানুষ ময়না চলে যায় বারান্দা থেকে। বাড়ির মানুষজন মানুষ ময়নার কাঠিণ্যে অবাক হয়। এত কঠিন মেয়েটা। পাষান। হয়দয়হীনা।
৩.
এখনও সময় পেলেই মানুষ ময়না তাকিয়ে থাকে পাখি ময়নার দিকে। পাখি ময়না তাকিয়ে থাকে মানুষ ময়নার দিকে। পাখি ময়না বলে ‘ও ময়না, আমারে ছাইরা দিতে ক না।’ মানুষ ময়না বলে ‘তুই গ্যালে আমি কের লগে কতা কমু?’