somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাইর খাওয়া-১

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ভোর ৪:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্কুলের জীবন মানেই মাইরের জীবন। বাড়ীর কাজ না করা, পড়া না পারা এবং মাইর। স্কুল মানেই মাইর, মাইর মানেই স্কুল।

মাইরের প্রকৃতি আকৃতি বিভিন্ন রকমের হইয়া থাকে। কান ধইরা উঠবোস করা, বেতের বাড়ি, স্কেলের বাড়ি, কান ধইরা বেঞ্চের উপ্রে দাড়াইয়া থাকা, কান ধইরা এক পা উচা কইরা দাড়াইয়া থাকা, বেঞ্চের নীচে মাথা আটকাইয়া দাড়াইয়া থাকা, মাঝে মাঝে পাছায় বেত বা ডাষ্টারের বাড়ি খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকটা পদ্ধতি হইল চাড়া কপালে নিয়া সূর্যের দিকে কপাল বা মুখ দিয়া কান ধইরা রৌদের মধ্যে দাড়াইয়া থাকা।

মাইর খাওয়ার কারণ বিভিন্ন হইতে পারে। হাতের লেখা না জমা দেওয়া, বাড়ীর কাজ হিসাবে দেওয়া অংক না করা, প্রশ্নের উত্তর বা শব্দার্থ না পারা ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়া টিফিন টাইমে স্কুল পলায়ন, ক্লাসের কারও সাথে মারামারি করা, ক্লাস চলাকালিন সময়ে বন্ধু বান্ধবের সাথে গল্পগুজব অর্থাৎ ক্লাসে কথা বলা ইত্যাদি কারণেও মাইরা খাওয়া যাইতে পারে।

জীবনে প্রথম মাইর খাইছিলাম ক্লাস টু তে পড়তে। না পড়া না পারা বা স্কুল পলায়ন জাতীয় কোন কাজ করি নাই। একটা কিন্ডারগার্ডেনে পড়তাম। একটা মাইক্রোবাস আছিল কিন্ডারগার্ডেনের, ঐটায় কইরা স্কুলে যাইতাম, বাসায় আইতাম, মাসে তিনশ টাকা ভাড়া দিতে হইত এর জন্য। একদিন আসায় আইতাছি। মাইক্রোর সামনে বসা আমি। মাইক্রো বাস থামার একটু আগেই আমি দরজা খুইলা ফালাইলাম বাসায় আসার অতি উৎসাহে। এই অপরাধে আমার এক শিক্ষক যিনি পিছনের সিটে বইসা ছিলেন উনি আমার মাথায় একটা থাপ্পর দিলেন। জীবনে প্রথম মাইর খাইয়ালাম। হ ষ্পষ্ট মনে আছে ঐটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম মাইর খাওয়া। এর আগে কোনদিন আমার বাবা মাও আমারে মারা তো দুরের কথা একটা বকাও দেয় নাই। বাসায় ঢুকলাম মুখ কালা কইরা। মনটা খুবই খারাপ। আত্মমর্যাদায় লাগতেছিল। বাবা মা আমার মুখ কালা দেইখা জিজ্ঞাসা করলেন, "কি হইছে বাবা? কেউ মারছে? স্যারে কিছু বলছে?" আমি উত্তর দেই,"নাহ কিছুই হয় নাই, কই কিছুই হয় নাই তো।"

সেই আমার যাত্রা হল শুরু। এরপরে গঙ্গা ভগিরথীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। মাইরের পর মাইর আমার উপর দিয়ে ঝড়ের মত বয়ে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বটবৃক্ষের মত দৃঢ়ভাবে।

ঐ কিন্ডারগার্ডেনে আমি টু থিকা ফোর পর্যন্ত পড়ছি। ঐখানেই আমি আমার শৈশবের মাইর খাওয়ার ট্রেনিং সম্পন্ন করি। বাচ্চাদের চরম কড়া শাসনে রাখার জন্য ওই স্কুলটা বি,এম,এ রেও ফেল মারাইব। ঐ স্কুলের পুলাপানগুলা আছিল একেকটা খবিশ। কেউ যদি কাউরে একটু চিমটি দিছে তাইলেই হইছে, লগে লগে অফিসে যাইয়া বিচার আর চিমটিদাতারে ফাউ কয়েকটা স্কেলের বাড়ি।

পড়াশুনা জিনিসটা আমার কাছে মাঝে মাঝেই জঘণ্য লাগে। বাংলা সবসময় বানাইয়া বানাইয়া উত্তর লেখতাম। এই সেইদিন ইন্টারের পরীক্ষার সময়েও এই কাজ করছি। পরীক্ষার হলে বইসা বইসা উত্তর বানাইছি আর লেখছি। কিন্তু অংক আর ইংরেজীতো আর বানাইয়া বানাইয়া লেখা যায় না। একটা ক্লাস টু থ্রীর পোলার মদন ছাত্রের পক্ষে আর যাই হোক গ্রামার আর বানান ঠিক রাইখা "এ জার্নি বাই বোট" লেখা সম্ভব না। আর আমি যেহেতু বিশিষ্ট ফাকিবাজ ছাত্র সেহেতু অংক বাড়ীর কাজ প্রায়শই ফাকির উপ্রে দিয়া চালাইয়া দিতাম। সাধারণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অক্সিজেনের অভাবে মোমবাতি কিভাবে নিভা যায় তার পরীক্ষা করতে গিয়া একটা কাছের গ্লাস ফাটাইছি আর তাপের ফলে জল আর বায়ুর উর্ধ্বগতি পরীক্ষা করতে গিয়া কোকের বোতলে বেলুন লাগাইয়া চুলার আগুনে একটা বোলের মধ্যে কিছু পানি দিয়া কোকের বোতল বোলের মধ্যে কিছুক্ষণ বসানির পর কোকের বোতলের তলা খুইলা পড়ছে। কিন্তু পরীক্ষার পাতায় আমার কাউয়ার ঠ্যাং বগার ঠ্যাং ( আমার হাতের লেখা খুবই জঘণ্য ) লেখা দেইখা তো আর মাষ্টারের মন ভরে না। ফলাফল সবসময় মাইরের উপ্রে থাকছি।

আমাগোর ইংরেজীর শিক্ষিকা ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভদ্রমহিলা। উনার নাম নিতে চাই না। যে শিক্ষার্থী "নিউ ফাংশনাল ইংলিশ" নামক হলদেটে মলাটের বই থিকা "রেইনি সিজন" নামক রচনাটা হুবুহু না দেইখা খাতায় লেখতে পারত তারে উনি পনেরতে পনের দিতেন। দুইটা বানান ভুল মানেই এক নাম্বার কাটা। প্রতি নাম্বারের জন্য দুইটা কইরা বেতের বাড়ি। তয় চৌদ্দ বা সাড়ে তের পাইলে বাড়ি খাওয়া মাফ করতেন। ছাত্র ছাত্রীরা প্রায়ই দেখাদেখি করিয়া রচনা লেখত। একজন আরেকজনেরটা দেইখা লেখত। এই জন্য উনি সবাইকে খাতার উপর আরেকটা খাতা দিয়া ঢাকিয়া রচনা লেখতে বলতেন যাতে কেউ দেখাদেখি করতে না পারে। তাছাড়া উনার শ্যেন দৃষ্টি থাকিত কেউ কারো খাতার দিকে তাকায় কিনা। ধরা পড়লেই মাইর। ভাইরে ভাই সে যে সে মাইর না পুরা রিমান্ডের মাইর। উনি প্রথমে অপরাধী শিক্ষার্থীরে দিয়াই অফিস থিকা বেত আনাইতেন। বলির জীব নিজের বলির জন্যই খড়গ আনিতে যাইতেছে এই জাতীয় অবস্থা তৈরী হইত। যদি বেত না পাওয়া যাইত অর্থাৎ মজুত বেত সব অন্য ক্লাসে ব্যাস্ত থাকিত তাইলে উনি কোন একজনের কাছ থেকে একটা স্কেল নিয়া বলতেন হাত পাত। তারপর সেই হাতে শুরু করতেন মাইর। শিক্ষার্থীরা কাকুতি মিনতি করত, "আপা আর করব না, আর করব না।" কিন্তু উনার মন গলিত না। উনার খায়েশ না মেটা পর্যন্ত অথবা যতক্ষণ উনি মনে না করতেন যে যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে, এই শাস্তি পুনরায় না পাওয়ার ভয়ে আর হয়তো এই নচ্ছার এই কাজ পুনরায় করবে না ততক্ষণ উনি মাইর চালাতেন। হাত সরিয়ে নিলে উনি উরু, ডানায় মারতেন। শিক্ষার্থীরা উনাকে যমের মত ভয় করত।

আমি একদিন পড়া শিখে যাই নাই। উনাকে নানা অযুহাত দেখালাম। উনি মানলেন না। উনি আমাকে একটা কাঠের স্কেল দিয়া পিটান আরম্ভ করলেন। আমি মাইর খাওয়া বিশেষজ্ঞ পুলা। সব হজম কইরা ফালাইলাম। ক্যাচাল লাগল বাসায় আইসা। আমার এক ছোট খালা তখন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসছেন। আমি স্কুলের জামা খুইলা নিশ্চিন্ত মনে জামা বদলাইতাছি। হঠাৎ উনি আমার হাত ধইরা ফালাইলেন। বললেন কিরে তোর শরীরে এইগুলা কিসের দাগ। বুঝলাম আমি ধরা পড়িয়া গেছি। লুকাইতে চেষ্টা করলাম। বললাম চুলকানীর দাগ। উনি বললেন, না এইটা চুলকানীর দাগ না। আমার ভয় ছিল, স্কুলে পড়া না পাইরা মাইর খাইয়া এই কথা যদি আবার বাসায় জানাজানি হয় তাইলে আমার কপালে আরেক দফা মাইর আছে। তাই গোপন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আন্টি সব ধইরা ফালাইল। ফর্সা ছিলাম খুব। শরীরের প্রত্যেকটা দাগ গুনলেন। মোট পঞ্চান্নটা দাগ পাইলেন। আমি যদিও এই ব্যাপারে বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলাম না কিন্তু উনাকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন দেখাইতে লাগিল। আমি খালি চিন্তা করতে ছিলাম, বাবা মার কাছ থিকা কেমনে লুকাই যে পড়া পারি নাই। বাবা মা রাত্রিবেলায় বাড়ী আসলেন। উনারা ঘটনা দেইখা এতই মর্মাহত হইলেন যে আমার পড়া না পারার কথা বেলালুম ভুলিয়া গেলেন। মা আমাকে নিয়া সোজা স্কুলের এম ডি আপার বাসায় সেই রাত্রিবেলায় গমন করিলেন। এম ডি আপাও দেইখা তাজ্জব হইয়া গেলেন। আসলে তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারি ব্যাপারটা খুব খারাপ ছিল। ছোট বাচ্চাদের এভাবে শাস্তি দেওয়াটা ঠিক না। অবশ্য গরুর গোয়ালে যেখানে একদল গাধার মত খায় অর্থাৎ মুখস্ত করে আর বমি করে অর্থাৎ খাতায় লেখার মত উগরাইয়া দেয় সেখানে এর থেকে ভাল কিছু আশা করা ঠিক না।

চলবে...............
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:২৩
৩৫টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×