somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

শাহ কিবরিয়া হত্যাকান্ডের সুবিচার ও রাষ্ট্রের দায়

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ ভোর ৪:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শাহ কিবরিয়া হত্যাকান্ডের সুবিচার ও রাষ্ট্রের দায়
ফকির ইলিয়াস
===============================
এমন মর্মান্তিক দু:সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। হঠাৎ করেই সাপ্তাহিক পরিচয় সম্পাদক নাজমুল আহসানের ফোন। নিউইয়র্কে বেলা তখন দুপুর দু’টা ছুঁই ছুঁই। নাজমুল আহসানের কন্ঠ জমাট। শুনেই বুঝলাম কোন চরম দু:সংবাদ। তিনি বললেন, “খবর শুনেছেন ? হবিগঞ্জে জনসভায় বোমা হামলা। কিবরিয়া সাহেব নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। আরো কয়েকজন। সত্তর - আশি জন আহত।”

২৭ জানুয়ারি ২০০৫ বৃহস্পতিবার দুপুর এ কেমন দু:সংবাদ বয়ে আনলো? আঁতকে উঠি। নাজমুল বলেন, ‘এইমাত্র এটিএন বাংলা তাদের ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে। কিবরিয়া সাহেব আর নেই’।

ফোনে বেশি কথা বলতে পারিনি; বুকটা হু হু করে উঠে! শাহ কিবরিয়ার মতো একজন মানুষকে ওরা এভাবে মেরে ফেললো? তিনি অন্য রাজনীতিকদের মতো শত্রু বেষ্টিত ছিলেন না। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ইতিমধ্যে মোবাইলে আরো ক’জনের সাথে কথা হয়ে যায়। গোটা আমেরিকা জুড়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত বেগে। বিষন্নতার ছায়া নেমে আসে বাঙালী অভিবাসী সমাজে। কারো সাথেই দু’এক কথার বেশি বলা যায় না। আহা, এমন সজ্জন, সহজ সরল অথচ নিষ্ঠাবান একজন কৃতি বাঙালীকে এমনিভাবে ভাগ্যবরণ করতে হলো! মনটা দারুণ বিষিয়ে উঠে। ভাবতে পারি না। কিছুই ভাবতে পারি না।

কাজ থেকে অনেকটা মানসিক অস্খিরতা নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। নির্বোধ হেঁটে যাই। পাশ দিয়ে অতিক্রম করি নিউইয়র্কের জাতিসংঘ ভবন। ক’দিন আগে তীব্র বরফ পড়েছে নিউইয়র্কসহ আমেরিকার অনেক অঙ্গরাজ্যে। বরফে ঢেকে আছে জাতিসংঘ চত্বর। এই চত্বরের পীচঢালা পথ আর সবুজ ঘেরা লনের চারপাশে পড়ে আছে শাহ কিবরিয়ার পদছাপ। কর্মপ্রয়োজনে তিনি এই চত্বরে হেঁটেছেন অনেক দিন, অনেক রাত। তাঁর পদছাপ খুঁজার চেষ্টা করি। একজন সফল কুটনীতিক, একজন আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী, একজন জনদরদী রাজনীতিক- স্বদেশে, স্বমাটিতে এমন জঘন্যভাবে নিহত হলেন ! হায়রে নিয়তি। হায়রে, বিধির বিচার !

ক’ঘন্টা পরেই ঢাকার দৈনিকগুলোর ইন্টারনেট ইস্যুতে ভেসে উঠে তাঁর মরদেহের ছবি। রক্তাক্ত, বিক্ষত শরীরের ছবি। মাত্র ক’ঘন্টা আগেও যিনি হাস্য উজ্জ্বল। এখন তিনি কেবলই স্মৃতি। ছবিগুলো দেখে অশ্রু সংবরণ কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অন্যতম স্বজনশীল ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন তিনি। এটা যে কেউ স্বীকার করবেন।

দুই.

হবিগঞ্জের জনসভায় বোমা হমালা এবং শাহ কিবরিয়াসহ ব্যক্তিদের মৃত্যু ও আহততের ঘটনার পর তৎকালীন সরকার গতানুগতিক বিবৃতি দিয়েছে। দু:খ প্রকাশ করেছে। হামলা হওয়ার পর সিলেট-হবিগঞ্জ-ঢাকা সড়কে চেক পয়েন্ট বসিয়ে চেকিং করার মতো হাস্যকর ঘটনাও ঘটিয়েছে সরকার। খুনীরা কি জানান দিয়ে যায় রাজপথ দিয়ে? তাহলে এমন হাস্যকর পদক্ষেপ কেন? শাহ কিবরিয়াকে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনীরা আওয়ামী লীগকে আরেকটি চরম ম্যাসেজ দিয়ে গিয়েছিল। আর ম্যাসেজটি ছিল এই, আহসান উল্লাহ মাস্টার, আইভি রহমান, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজ উদ্দিন, শাহ কিবরিয়ার মতো ব্যক্তিদের নিধনযজ্ঞ সম্পন্ন করে তারা একদিন আওয়ামী লীগকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। দেশে তো জনসভা আরো অনেক হয়েছিল সে সময়। অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগের জনসভায় সে সময় বোমা হামলা হচ্ছিল কেন? কারা করছিল ?

বাঙালি জাতির গর্বিত সন্তান হিসেবে যে ক’জন জ্ঞানী, গুণী মানুষ ছিলেন, শাহ কিবরিয়া ছিলেন তাদের একজন। রাষ্ট্রদূত, সচিব, জাতিসংঘ কর্মকর্তা, এসকাপের পরিচালক, রাজনীতিক, মন্ত্রী হিসেবে তিনি যতোটা পরিচিত ছিলেন, তার চেয়েও তার বড় পরিচয় ছিল তিনি ছিলেন একজন মানবদরদী মানুষ।

তাঁর মহাপ্রয়াণের পর তারই সহধর্মীনি খ্যাতিমান শিল্পী আসমা কিবরিয়া যে কথাগুলো বলেছিলেন এর জবাব দেবার শক্তি কি আমাদের এখনও আছে? শ্রদ্ধাভাজন আসমা কিবরিয়া বলেছিলেন, ‘গ্রেনেড হামলায় এমনভাবে নির্মম মৃত্যুর জন্য বিদেশ ছেড়ে স্বদেশে এসেছিলাম ?’

প্রিয় বাংলাদেশ, কি জবাব দেবে তুমি? কি জবাব দেবে বাঙালি জাতি ? এ প্রশ্নটি আমি এখনও করছি নিজেকে। শাহ কিবরিয়া আজীবন বিদেশে সুখে শান্তিতে থাকতে পারতেন। কিন্তু স্বদেশ, স্বমাটি, স্বজাতিকে ভালোবেসে তিনি দেশে স্খায়ী নিবাস গড়েছিলেন। রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবা করতে চেয়েছিলেন। সাদামাটা এই মানুষটি ছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি হবিগঞ্জের মাটিতে তাকে এমনভাবে রক্তাক্ত মৃত্যুবরণ করতে হবে।

তাঁর শবদেহের পোষ্ট মর্টেম করতে বাধা দিয়েছিলেন সহধর্মিনী। কিসের পোষ্ট মর্টেম? কেন পোষ্টমর্টেম ? গোটা দেশবাসীই তো দেখলো তার রক্তাক্ত নিথর মৃত্যু। তারপরও তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারি নিবন্ধনের মাধ্যমে? আর কতো আত্মপ্রতারণার আশ্রয় নেবো আমরা? আর কতো রক্ত দিয়ে ঢাকবো জীবনের স্বপ্ন আলো?

শিল্পী আসমা কিবরিয়া আরো কিছু স্পষ্ট কথা বলেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের কে বলেছিলেন ‘এ পর্যন্ত কি করতে পেরেছেন আপনারা ? একুশে আগস্টের বোমা হামলার বিচার করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারলে আজ এমনটি হতো না।’

তাঁর কথাটি সহস্রভাগ সত্য। ঘাতকদের লোলুপ দৃষ্টি আজও সূদুর প্রসারী। অথচ সেই সময়ে আক্রান্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা যেন আজ নিষ্ক্রিয়তার স্খায়ী আসন নিয়েছেন। আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকান্ড, একুশে আগস্টের বোমা হামলার পরই উচিত ছিল কাংখিত মুক্তির জন্য আন্দোলন করা। তখন চরম মুক্তির সূর্য খোঁজা কি জরুরি ছিল না ? এভাবে শবদেহের ভার আর কতো বইবে বাঙালি জাতি।

শাহ কিবরিয়া ছিলেন শ্রেষ্ট মননশীল বাঙালি। প্রিয় পাঠক, তাঁর লেখাগুলো জাতীয় দৈনিক, জাতীয় সাপ্তাহিককে আপনারা যারা পড়েছেন- তারা আরেকটি বার তার লেখাগুলোর মূল্যায়ন করুন। ''নতুন বছরের ভাবনা'' লেখাটিতে লিখেছিলেন ‘২০০৫ সালে আমাদের চেষ্টা রুখতে হবে এই দু:শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য। নতুন বছরের জন্য এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।’

সেই প্রতিজ্ঞা নিয়ে নতুন বছরের প্রথম মাসেই চির বিদায় নিয়েছিলেন বহুগুণী ব্যক্তিত্ব শাহ এ এম এস কিবরিয়া। বাংলার মাটি, ফুল, তরু, নদী, শ্যামল পরিবেশ আর সুনীল আকাশ শ্রদ্ধায় লিখে রাখবে মুক্তি সংগ্রামী এই মানুষটির নাম। যে মুক্তিযোদ্ধা কুটনীতিক এই দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তিনিই শহীদ হলেন আততায়ীদের হাতে। অমর রবে তার দেশপ্রেম। ঘাতকরা কি তার নাম মুছে দিতে পারবে? না পারবে না। কারণ এদেশে খুব বেশি শাহ কিবরিয়া জন্ম নেননি। নেবেনও না।

তিন
খুবই পরিতাপের কথা , তাঁর সেই নির্মম হত্যাকান্ডের সুবিচার আজও হয়নি। বিএনপি- জামাতের চারদলীয় জোট সে বিচার করবে না, তা সকলেরই জানা ছিল। বরং তারা না না প্রহসন করেছে।
তাই রাষ্ট্রের মানুষ দেশে পরিবর্তন এনেছে। মহাজোট ক্ষমতায় এখন। আমরা জানি , রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি মহল
খুব জোরেশোরেই তৎপর। তারপরও সরকারকে সুদৃঢ় থেকে এই
পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস
কিবরিয়া হত্যাকান্ডের নেপথ্য নায়কদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে। এদেরকে বিচারের কাটগড়ায় দাঁড় করাতে না পারলে , এই
দেশের রাজনীতি কখনওই পরিশুদ্ধতার পরশ পাবে না।
নিউইয়র্ক , ২৬ জানুয়ারী ২০১০




সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ ভোর ৪:৫২
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×