Click This Link
'তমা..........তমা.......চোখ খোল...........কি হল............'
ভাসা ভাসা কথাগুলো আসতে থাকে তমার কানে। মনে হচ্ছে একটা অন্ধকার সুরঙ্গের ভেতর প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। মাথাটা এত ভারী লাগছে, নিচের দিকে ডেবে যাচ্ছেই তো যাচ্ছে। চোখের পাতাও ভারী হয়ে আছে ভীষণ। প্রাণপণে চেষ্টা করছে চোখ খুলতে কিন্তু পারছে না। হাল্কা পানির ঝাপটা পড়ল চোখে, মুখে। মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এবার আম্মার গলা পেল তমা। ডাকছে ওকে। অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টা করে চোখ খুলল তমা। চোখ খুলেই আব্বার মুখটা দেখতে পেল সামনে। চেয়ারে বসে আছে। মুখে উদ্বেগ, রাগ, বিরক্তি। মাথা ঘুরিয়ে আম্মার দিকে তাকাল। ওর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে। কাঁদছে, তেল-জল হাতে ঘষে দিচ্ছে মাথার তালুতে।
তমা মনে করতে চেষ্টা করল কি ঘটেছে। মনে পড়ছে না। শুধু এক মহিলার কথা মনে পড়ছে, বেশ সুন্দর দেখতে, কিভাবে ত্বক আরো ফর্সা, স্নিগ্ধ, কমনীয় হয় সে বিষয়ে টিপস দিচ্ছিল। আম্মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কি হইছে তমা? আমি আর তোর আব্বা আসছি কখন। বেল দিচ্ছি সমানে। তুই দরজা খুলিস না। তারপরে তোর আব্বা চাবি দিয়া দরজা খুলল। ঘরে ঢুকে দেখি এই অবস্থা।' তমা কিছু বলল না। চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইল।
আব্বা এবার রেগে গেল। কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, 'কি ব্যাপার? কথা বল না কেন? কি শুরু করছ তুমি? তোমার কোন সমস্যা হইলে আমাদেরকে বল। আমরা সমাধানের চেষ্টা করি। তা না, যা মনে হচ্ছে তুমি করে যাইতেছ। চেহারার কি অবস্থা বানাইছো? ভুত সাজার শখ হইছে? ঘরের জিনিস পত্রও ভাঙা শুরু করছো!' আব্বার গলা চড়ছে আস্তে আস্তে। মাথার ভিতরে এখনো ভোঁতা অনুভূতিটা রয়ে গেছে। কথাগুলো যেন মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মারছে। তমা ধীরে ধীরে উঠে বসল। আব্বা আবার বলল, 'তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছি আমি।' আম্মা বলে, 'তুমি থামো তো। জেরা পরেও করতে পারবা।'
'না, আমার এখনই জানা লাগবে। ও নিত্য নতুন একেকটা কান্ড ঘটাবে আর সহ্য করতে হবে। কি পাইছে কি? বল তোমার সমস্যা কি?'
'আমার কোন সমস্যা নাই আব্বা।' দুর্বল গলায় বলল তমা। 'আর থাকলেও তোমরা তার কোন সমাধান করতে পারবা না। প্লীজ এখন রুমে যাও। আমার একটু বিশ্রাম দরকার।'
আব্বা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু আম্মা ইশারা করল চলে যেতে। হতাশভাবে উঠে গেল আব্বা। আম্মা আরেকবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, আদর করে বলল, 'যা মা, মুখহাত ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নে। কি অবস্থা করছিস।'
তমা ওইভাবেই বসে থাকে আরো কিছুক্ষণ। মাথাটা ভোঁতা হয়ে আছে, কাজ করছে না একদম। ধীরে ধীরে উঠে যায়। গোসল করা দরকার। জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় তমা। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে পানির নিচে। ঠান্ডা পানি ধুইয়ে দিতে থাকে ওর দেহ। মাথা থেকে ধুয়ে নিয়ে যেতে থাকে ভোঁতা ব্যথাটা। মনে পড়ে সেই দিনটাতেও তমা এইভাবেই শাওয়ারের নিচে বসেছিল। দেড়-দুই ঘন্টা হবে। যেন পানিতেই ধুয়ে যাবে সব নোংরামি, কলুষতা, কষ্ট! কিন্তু কিছুতেই ধুতে পারেনি তমা। এই ছয় বছরেও ধুয়ে যায়নি ওর ভিতর থেকে কষ্টটুকু, নোংরা অনুভূতিটুকু। এখনও সেই একই অনুভূতি হয় তমার। তখন এসে বসে থাকে শাওয়ারের নিচে। ওই দিনের মত করে। পার্থক্য শুধু এই যে ওইদিন কেঁদেছিল অঝোরে, শাওয়ারের পানি আর চোখের মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আর কাঁদে না। চোখের ভিতরটা শুকনো খরখরে হয়ে গেছে। শুধু জ্বালা জ্বালা একটা অনুভূতি হয়।
অনেকক্ষণ পরে উঠে তমা, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে নিজেই হেসে ফেলে। আব্বা ঠিকই বলেছিল, ভূত সাজার শখ হয়েছে। চোখের কাল কাজল আর ঠোঁটের লাল লিপস্টিক সারা মুখে একাকার হয়ে গেছে। কি যে বিভতস দেখাচ্ছে! ফেস ওয়াশটা ঢেলে নিয়ে ভাল করে ঘষে ঘষে মুখটা পরিষ্কার করে তমা। শ্যাম্পু করতে হবে। আম্মা ইচ্ছামত তেল-পানি দিয়েছে মাথায়। শ্যাম্পু দিয়ে ভাল করে চুল ধোয় তমা। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে আম্মা যখন উদ্বিগ্ন হয়ে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দেয় তখন বের হয়ে আসে।
বিকেল হয়ে এসেছে। রোদ মরে গেছে। তমা ভেজা চুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মাথাটা এখন অনেকটা পরিষ্কার। ব্যথাটাও নেই আর। ভাল লাগছে। সামনের ছোট্ট গলিটায় কতগুলো বাচ্চা ক্রিকেট খেলছে। আম্পায়ার একজনকে আউট দিয়েছে, সবাই খুশিতে হই হই করছে আর ওদিকে ব্যাটসম্যান গাল ফুলিয়ে বলছে, 'হয় নাই, হয় নাই। আমি খেলবো না কিন্তু......'। তমা হাসে ওদের দেখে। একটা ভাল লাগায় মন ভরে গেছে।
আম্মা আসে বারান্দায়। জিজ্ঞেস করে, 'তমা, চা খাবি।' 'দেও'। আম্মা চলে যেতে থাকে। তমা হাত ধরে থামায় আবার। বলে, 'আমাকে একটু জড়ায় ধরে রাখবা?' আম্মা এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখে তমাকে শক্ত করে। কিছু বলে না, কিছু জিজ্ঞেস করে না। আম্মার এই ব্যাপারটা তমার এত ভাল লাগে! কিভাবে যেন বুঝতে পারে এখন কোন কথাই তমা সহ্য করতে পারবে না। আম্মার কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে থাকে তমা।
চলবে...........
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:২১