somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গণিত বিষয়ক ফিকশান: পিঁপশঙ্কের রাজ্যাভিযান (পর্ব ২)

২২ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পর্ব ১: Click This Link

[২]
তীব্র শৈত্য প্রবাহের রাত, ১৫ই জানুয়ারি ২০১০
মেঘনা-তিতাসের বাঁক, ফারিনের গ্রামের বাড়ি, ড্রয়িংরুম


রাতের খাবার শেষে ভারী পোশাক গায়ে চাপিয়ে সবাই বসে আছি। আমার পাশে ফারিন, তার পাশে ফারিনের বড় বোন জেরিন, আর ওপাশে তাদের মা। তীব্র শীতে কাবু হয়ে পড়া এক রাত। কাঠালিচাঁপার গন্ধে ভরে গেছে সারা বাড়ি। টিনের চালে টুপটাপ শিশিরের শব্দ, মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে প্যাঁচার ডাকে। আর বাতাসের বেগ বেড়ে গেলে ভেসে আসছে কৈবর্ত পাড়ার কীর্তনের বিষণ্ণ সুর; সেই সাথে আরো দূরে, মিটমিট আলোতে মেঘনার বুকে ছলছল জেলে নৌকার ছৈয়ের ভেতর থেকে ভাটিয়ালী গানের শব্দ।

আমার হাতে চায়ের কাপ। ফারিনের হাতেও, যদিও মেয়ের চা খাওয়া তেমন পছন্দ করেন না তার মা। তবে মাঝে মাঝে নিয়ম শিথিল হয়, আজকে সেরকম একটি সময়। আজ থেকে বেশ ক'বছর আগে, জেরিনের জন্মের পর প্রথম বার তার মুখ দেখে হাসপাতালের বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম আমার জীবনের শেষ সিগারেটের প্যাকেটটি। তার কিছু দিন পর শুরু হয় চায়ের ব্যাপারটি। না, একটি নেশাকে কাটানোর জন্য আরেকটি নেশার আশ্রয় নয়; সিগারেট কাটানোর জন্য জেরিনের কোমল মায়াবী মুখই যথেষ্ট ছিল। আমি আসলে সেসময় থেকে মাঝে মাঝে রাত জেগে লিখতে শুরু করেছিলাম।

"আচ্ছা, বাবা, ধরো তোমাকে বিশাল একটি গুহায় ফেলে দেয়া হলো। উঁচু-নিচু, এবড়ো-থেবড়ো গুহার দেয়াল, আর ভেতরটা মিশমিশে কালো, কোনো আলো নেই কোথাও।" হঠাৎ ফারিনের এ অদ্ভুত কথায় হাসতে শুরু করল সবাই। তীব্র শৈত্য প্রবাহের রাতে জনমানবহীন অন্ধকার গুহায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার কল্পনা উষ্ণ চায়ের পেয়ালা হাতেও সুখপ্রদ কোনো ব্যাপার নয়; আমি দ্রুত গুহার ভেতর থেকে বের হবার উপায় খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার সমস্যাটি আসলে তার চেয়েও বড়।
"কীভাবে তুমি বুঝবে গুহাটা আকারে কত বড়?" ফারিনের প্রশ্ন এবার।
অন্ধকার গুহায় বসে তার ক্ষেত্রফল বের করার সূত্রটি নিঃসন্দেহে তার ভেতর থেকে বের হয়ে আসার উপায়টি থেকে অনেক বেশি জটিল। আমি মগ্ন হয়ে গেলাম চিন্তায়।

"আচ্ছা, আরেকটু সহজ করে দেই," ফারিন আশ্বস্ত করে আমাকে, "তুমি ইচ্ছে করলেই টিকটিকি বা তেলাপোকার মতো বুকে ভর দিয়ে গুহার দেয়ালের উপর চলতে পার। তবে তোমার সময় কিন্তু মাত্র দু'মিনিট।"
"একটা কাজ করা যায়," নিজেকে স্পাইডারম্যানের মতো খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললাম আমি, "দেয়ালের পরিসীমা হিসেব করে মোটামুটি ক্ষেত্রফলটি বের করা যায়। যত বেশি পরিসীমা, তত বেশি ক্ষেত্রফল।"
"ওহ, তাই!" একটু যেন দমে যাওয়া কণ্ঠ ফারিনের, হয়তো বা সমাধানটির এতটা পরিষ্কার সারল্য আশা করেনি সে। তবু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার জন্য টেবিল থেকে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে আসলো।

আর তখনই আমার মনে পড়ে গেল কী হাস্যকর ভুলটিই না করেছি আমি! "না, না, এভাবে হবে না," অনেকটা চিৎকার করে উঠলাম। "কারণ শুধু পরিসীমার মানের উপরই ক্ষেত্রফল নির্ভর করে না, পরিসীমাটির আকৃতি কীরূপ, আয়তকার, বৃত্তাকার, ডিম্বাকার, না অন্য কোনোরূপ, এটিও একটি বড় ব্যাপার। যেমন, নিচের চিত্রে, আয়তকার ক ও খ গুহার পরিসীমা প্রায় সমান, প্রত্যেকটি ৬ ইঞ্চির কাছাকাছি, কিন্তু ক-এর ক্ষেত্রফল, খ-এর ক্ষেত্রফলের দ্বিগুণ।



"এছাড়া গুহার ভেতর কোনো জায়গায় যদি খুব সরু, লম্বা ফাটল থাকে, তাহলে পরিসীমা অনেক বেড়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু সে অনুযায়ী ক্ষেত্রফল তেমন নাও বাড়তে পারে।"
"হ্যাঁ, বাবা, এভাবে হবে না।" ফারিনের গলার স্বরে খুশির পরিবর্তনটি সুস্পষ্ট।

এবার আমার মনে পড়ে গেল একাদশ শ্রেণীতে পড়া রসায়নের ক্লাসের কথা। স্পাইডারম্যান থেকে—না, রসায়নের ছাত্র নয়, বরং আবদ্ধ কোনো পাত্রে ছুটন্ত গ্যাসের অণু হয়ে গেলাম আমি, ক্রমাগত ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছি পাত্রের দেয়াল থেকে দেয়ালে। এক দেয়াল থেকে ধাক্কা খাবার পর গুণে যাচ্ছি কত কদম পর আবার আরেক দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছি। এভাবে অনেকক্ষণ ধরে একটি ধাক্কা ও তার পরবর্তী ধাক্কার মধ্যবর্তী দূরত্বের হিসেব রেখে একটি গড় দূরত্ব বের করা যায়, যার উপর ভিত্তি করে গড় মুক্ত-পথের সূত্র অনুযায়ী গুহার ক্ষেত্রফল বের করা যেতে পারে। গড় মুক্ত পথের দূরত্ব যত বেশি হবে, গুহার ক্ষেত্রফলও সে অনুযায়ী বেশি হতে থাকবে।

কাগজে বেলনাকৃতির জায়গায় একটি অণুর ছবি এঁকে সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম ফারিনকে।

বেশ মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখার পর ফারিন বলল, "তার মানে এ পদ্ধতি কাজ করবে যখন গুহার দেয়ালের অভ্যন্তরটি বাঁধাহীন, মুক্ত হয়, তাই না?"
"হ্যাঁ, তাই।" সায় দিলাম আমি।
"কিন্তু, বাবা, মনে করো, গুহার মাঝ বরাবর খুব পাতলা একটা পর্দার মতো ঝুলিয়ে দেয়া হলো। পর্দার দু'পাশে একদম অল্প করে মাত্র জায়গা রাখা হলো যাতে তা গলে গুহার এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে গুহার ক্ষেত্রফল তেমন কমলো না বললেই চলে, কিন্তু প্রাণীটি এখন আগের চেয়ে আরো তাড়াতাড়ি গুহার দেয়ালে ধাক্কা খেতে থাকবে, তাই না? আর তখন হিসেবেও ভুল হয়ে যাবে।"


মমতামাখা বিস্ময়ে আপ্লুত হলো আমার হৃদয়, একটু গর্ববোধও। আলতো করে নেড়ে দেই ফারিনের চুলগুলো। পৃথিবীতে আশাবাদী, সুখী হবার কতই না অসংখ্য অপার বিষয় রয়েছে আমাদের, এবং চারপাশে।

[প্রিয় পাঠকদের প্রতি:
প্রথম পর্বের সাড়ায় সবার প্রতি গভীর মুগ্ধতা, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। দুঃখিত, এ পর্বে শেষ করা গেল না। তবে শেষ পর্বের কাজ চলছে, সম্ভব হলে আজ রাতেই তা এসে যাবে।]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:৫৭
২৭টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×