somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার, হৃদয়ে দহন হৃদয়ে চড়া

২১ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯শে জানুয়ারি — দূরে বিধানসভা ভবনের সামনে ড্রাম বেজে উঠলো। সামরিক কুচকাওয়াজ শুরু। রেড রোড থেকে রেসকোর্সমুখী বাতাসে তখন উথালপাথাল সুর — ‘জাগো জাগো সর্বহারা/ অনশন বন্দী ক্রীতদাস....’।
শিল্পীর গলা কাঁপছে। মঙ্গলবার, দুপুর ৩টে ২৫। শায়িত কমরেড জ্যোতি বসুকে নিয়ে শকট রওনা দিল মোহরকুঞ্জের দিকে।
জ্যোতি বসুর মরদেহ যখন রাজভবনের সীমানা পেরোচ্ছে রাস্তার বাঁ পাশে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ়া স্লোগান তুললেন। তাঁর গলার চামড়া ভেদ করে হাড়ের ইঙ্গিত শব্দোচ্চারণের তালে তালে উঠছে নামছে। কপালের দুপাশের রগ টানটান, স্পষ্ট। যৌবনের অভ্যাস আর অনায়াস দক্ষতা ছিল স্লোগান তোলার। এখন তা নিদারুণ কষ্টের কারণ হতে পারে। জানতেন তিনি। তবু আর একবার ঝলসে উঠলো সত্তর দশকের অদম্য শিহরণ।
কারণ সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছেন সেই দ্রোহকালের সাগ্নিক, নির্মাণের সেনাপতি — কমরেড জ্যোতি বসু।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মূর্তির সামনে পিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সন্ধ্যা তপাদার। বেহালার মানুষ। উদগ্রীব তিনি বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু গলা মিলে যাচ্ছিল প্রিয়, বহুদিনের চেনা গানটির সুরে। হাতে একটি গাঁদার মালা। কাছে যেতেই বলে উঠলেন,‘‘ দেখতে পারিনি আমি জ্যোতিবাবুকে। পৌঁছোতেই পারিনি। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু হলো না। তাই এখানে এসে দাঁড়ালাম। একবার দেখবো। মালা দেবো শুধু। একটু সাহায্য করবে ভাই ? এখানে দাঁড়াবে ওনাকে নিয়ে ? জানো কিছু ?’’
জবাব দেওয়া হলো না। উত্তরে মুখ তুলতেই চোখে পড়ল কনভয়, গাড়ি। বড়জোর ৫মিনিট দাঁড়ানো গেল। রেড রোড মুহূর্তে লাল হয়ে গেল। শিমূল নেই, পলাশ নেই। পর্ণমোচী গাছেদের ডালেডালে শুধুই ধূসর বাদামি রঙ। তাতে কী? লক্ষ হৃদয়ের স্লোগান শোনা যাচ্ছে। রাস্তার পাশের মরা ঘাসের নিচ থেকে ধুলো উড়ছে পায়ে পায়ে। চেনা রেড রোড ছোট হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। লাল হয়ে যাচ্ছে রেড রোড — যতদূর চোখ যায় শুধু রক্ত নিশান।
তখন জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার। হৃদয়ে দহন, হৃদয় চড়া।
তারপর শুধু ভেসে যাওয়া। প্রথমে ৩টি মোটর সাইকেলে ৩জন সার্জেন্ট। তারপর তিনটি লরিতে সাংবাদিকরা। আবার চারটি মোটর সাইকেলে সার্জেন্টরা। তারপর হুডখোলা জিপে দুজন সটান দাঁড়ানো পুলিস। একজন খাকি পোশাকের। পিছনে সাদা ইউনিফর্মে প্রায় ৬ফুট উচ্চতার আর একজন। তারপর একটি সামরিক ট্রাকে সেনাবাহিনীর ১৬জন। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা জনতার আকাঙ্ক্ষিত তিনদিক খোলা গাড়িটি ঠিক তার পিছনে। গাড়িতে জ্যোতি বসুর মরদেহ। শায়িত দেহের উপর গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা। নানা মাপের মালা। বুকের উপর রাষ্ট্রের সম্মান — ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকা আর আমৃত্যু বিপ্লবীর অহঙ্কার, আবেগ, ভালোবাসা — লালনিশান।
আর সঙ্গে তাঁরা, যাঁদের কথা জ্যোতি বসু বারবার বলেছেন। বারবার সব জয়ের বিজয়তিলক তাঁদের কপালে এঁকে দিয়েছেন। অমোঘ সত্য প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত অনাটকীয় ভঙ্গিতে —‘‘ মানুষই ইতিহাস রচনা করে। মানুষের স্বার্থে কাজ করা ছাড়া কমিউনিস্টদের আর কোন স্বার্থ নেই।’’
মঙ্গলবারের রেড রোড সাক্ষী, সাক্ষী ফোর্ট উইলিয়াম। সাক্ষী সেই পুলিস কনস্টেবল, যিনি মাত্র কিছুক্ষণ আগেই সেনাবাহিনীর কড়া মানসিকতার কথা বলছিলেন। অনেকেই দেখলেন — নিজের চেয়ার ছেড়ে ট্রাকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এক হ্যাট পড়া সামরিক অফিসার। মোবাইল মেলে ধরে ছবি তুলছেন তিনি। তখন ৯৬টি অর্ধনমিত লাল পতাকাবাহী স্বেচ্ছাসেবকের দুপাশ থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু তাঁরা — ‘যাঁরা ইতিহাস রচনা করেন।’ তাঁরা গান গাইছেন। স্লোগান তুলছেন। অস্থির আবেগে হাত তুলছেন আকাশে।
ফোর্ট উইলিয়ামের মূল ফটকের সামনে চার রাস্তার সঙ্গম। ঐ জায়গা পেরিয়েই দীর্ঘদিন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে নিয়ে কনভয় চলে গেছে পার্ক সার্কাস হয়ে বিধাননগরের দিকে। ঠিক ঐ মুখেই বাঁদিকে একটি বিদ্যুতের সুইচ বক্স আছে। প্রায় সাড়ে ৪ ফুট লম্বা। ওপরে উঠে শুধু পা দুটি রেখে কোনক্রমে দাঁড়ানো যায়। তারই উপর দাঁড়িয়েছিলেন এক যুবক। হলুদ কালো ডোরাকাটা শার্ট আর খয়েরি রঙের ট্রাউজার পরনে। কী করবেন বোঝা যাচ্ছিল না। বোঝা গেল একটু পর। মরদেহ নিয়ে গাড়িটি যখন তাঁর সামনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, যুবক শরীর টানটান করে সংগ্রামী অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন শায়িত জ্যোতি বসুর দিকে। তাঁর দুটি চোখ ভাসিয়ে নামছে লোনা স্রোত — যার নিশ্চিত নাম ভালোবাসা।
বাঁদিকে হাজারো সংগ্রামের ঠিকানা জানা ব্রিগেড পেরিয়ে যাচ্ছে। সেই মাঠের অনেক, অনেক সভায় যিনি দিকনির্দেশ করতেন উন্মুখ জনপ্লাবনকে তিনি নীরব। তাঁকে নিয়ে শকট এগোচ্ছে। ডানদিকে ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সিংহের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তিন টাঙ্গাওয়ালা। ঘোড়া আছে। সওয়ারি নেই। রাস্তা নেই। রাস্তা তখন জনতার।
সেখানেই ঐ বাঁকের মুখেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন আজগর আলি। ডানকাঁধে সস্তার ব্যাগ। গায়ে ঐ গরমেও মোটা সোয়েটার। কোনক্রমে সামলালেন। সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। রাত কেটেছে দার্জিলিঙ মেলে। বাড়ি শিলিগুড়ির আনন্দপল্লীতে। বাস শ্রমিক। ফেরার টিকিট কাটা আছে। ফিরতি ট্রেন ধরে ফিরবেন। কেন এলেন ? এত কষ্ট। বাঁদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বছর পঞ্চাশের আজগর আলি আমার মুখ দেখলেন। ক্লান্ত, বোঝাই যাচ্ছে। তবু জবাবে মিলল দুপুর ১২টার ত্যেজ। বললেন —‘‘ আসবো না ? কেন? দূরে থাকি বলে ? জ্যোতি বসু চলে যাচ্ছেন। হাঁটবো না শেষ যাত্রায়। মানুষটা যে সারা জীবনটাই দিয়ে গেলেন।’’ এরপর কোন প্রশ্ন হয় না। কারণ সিদ্ধান্ত টেনে দিয়েছেন তিনিই। একইভাবে জনস্রোতের আর এক জলকণা খালেক শেখের সাথে দেখা হল বিড়লা তারামণ্ডলের ঠিক আগে। ট্যাংরায় বাড়ি। দিন মজুর। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন রেড রোডে। একই উদ্দেশ্য। ছোটবেলায় একবার জ্যোতি বসুকে কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি এখন ৪৪। জ্যোতি বসু প্রয়াত। তাঁর শেষ যাত্রায় আর একবার দেখতে চান মানুষটিকে। খালেক বললেন —‘‘ ছুঁতে পারবো না জানি। শুধু একবার দেখবো। একবার। তাই এসেছি। যতদূর পারবো হাঁটব।’’
কতদূর তিনি হাঁটতে পারলেন জানা হলো না। কারণ বিড়লা তারামণ্ডলের সামনে আর একটি ধাক্কা আসবে জানা ছিল না।
দড়ি ধরে ভিড়কে আটকে রেখেছিলেন ৬-৭ জন পুলিস। কনভয়ের সামনের গাড়িটি বাঁদিকে ঘুরে মোহরকুঞ্জের দিকে এগোন মাত্র দড়িটি হারিয়ে গেল। আর একটি জনস্রোত আছড়ে পড়ল। নতুন স্রোতধারা থেকে স্লোগান উঠল —‘ কমরেড জ্যোতি বসু লাল সেলাম। জননেতা জ্যোতি বসু অমর রহে।’ এতক্ষণ বয়ে আসা গণপ্লাবন থেকে জবাব এল —‘লাল সেলাম/লাল সেলাম।’
বিড়লা তারামণ্ডল থেকে মোহরকুঞ্জের দিকে রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার আছে লোহার। কয়েকশো মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন ঐ রেলিং ধরে। আকাদেমির সামনে দাঁড়িয়ে জনস্রোতের রোদে চোখ রেখে ২২ বছরের যুবক তাঁর সহপাঠীদের মাঝখান থেকে সামসুর রহমানের পংক্তি আবৃত্তি করছে —‘‘ হৃদয়ে আমার সাগর দোলার ছন্দ চাই/ অশুভের সাথে আপসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই/ দয়িতাকে ভালোবাসার মতন লগ্ন চাই.....’’। জনস্রোত থমকে গেছে মোহর কুঞ্জের সামনে। স্লোগান, গানে মথিত চত্বর।
তিন বার ফায়ারিঙের শব্দ শুনলো জনতা। ঘড়িতে ৪টে ৩৫। জনতা উত্তর দিল শপথের স্লোগানে। উদাস ছাত্ররা গেয়ে উঠলো ইন্টারন্যাশনাল।
মোহরকুঞ্জের আকাশ বেয়ে তখন ঘরে ফিরছে পাখিরা। মানুষ দাঁড়িয়ে। তখনও। এখনও কাজ বাকি।


৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×