somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অমীমাংসিত তীরন্দাজ

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সব মানুষকে মানুষ ভাবেনা তীরন্দাজ। মানুষের ভিতরে শ্রেণীগত পার্থক্যই সে সব সময় খুঁজে বেড়ায়। সে দাবি করে মানুষ পূর্বজন্ম থেকেই তার নিজের শ্রেণী নির্ধারণ করেই জন্ম লাভ করে। মানুষের ভাগ্য বংশপরম্পরায় একটি পরিকল্পিত ব্যাপার এবং একমাত্র মানুষই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে। প্রত্যেকে তার ভবিষ্যৎ অনুধাবন করতে পারে, তার মৃত্যুও সে টের পায়। এ নিয়ে তীরন্দাজের সাথে বিভিন্নজনের প্রায়ই হাতাহাতি হয়। তাদেরকে গাল দিয়ে চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে তারপর ঘরে ফেরে। এটাই তার প্রতিদিনের কাজ। মানুষজনও সুযোগ পেলে ওকে ক্ষেপিয়ে তোলে, ওকে ক্ষেপিয়ে অনেকেই মজা পায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই সূর্যের উপর বিরক্ত হয়, ও সূর্যকে এই নিয়মতান্ত্রিকতাকে দাসত্বের সাথে তুলনা করে। প্রকৃতি কেন একটা চলমান নিয়মে আবদ্ধ থাকবে? আজ সে পূর্ব দিক থেকে উঠবে, কাল উত্তর দিক থেকে উঠবে পরশু পশ্চিম দিক থেকে উঠবে কিংবা কোন কোন দিন উঠবেই না।
তীরন্দাজ যখন খেতে বসে তখনই দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। ভাতের সাথে তার ঝগড়া জ্ঞান হবার পর থেকেই। ভাবে মানুষ যদি ভাত না খেয়ে থাকতে পরতো তা হলে পৃথিবীতে সমস্যা বলে কোন শব্দ থাকতো না। শুধুমাত্র এই ভাতের জন্যে মানুষে মানুষে এতো বিভাজন, এতো উৎপাত। সংগত কারণেই ও কখনো ভাত মুখে দেয়না। ফল-মূল খেয়ে বেঁচে থাকে। কখনো কখনো অন্য প্রাণীর মতো ঘাস-লতা-পাতা খায়। তীরন্দাজ চিন্তা করে পৃথিবীর সব প্রাণীর একই রকমের খাদ্য থাকা উচিৎ এবং সে সেটাই মেনে চলে। তার এই বেঁচে থাকার কোন নাম কেউ দেয়নি। অনেকেই মাঝে মাঝে উম্মাদ বলে ডাকে। এতে তার কোন আপত্তিও নেই, সায় দেয়না ওসব কথায়।

মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলতে যতো আপত্তি তার। সবার কাছে বলে বেড়ায় পৃথিবীর সব প্রাণীই নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা বলে বিবেচনা করে। মানুষ সেসব প্রাণীরই অংশমাত্র। মানুষ শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিদীপ্ত হিংস্র প্রজাতির প্রাণী। সে যদি তার হিংস্রতা দিয়ে অন্য প্রাণীকে বধ না করতো, অন্যসব প্রাণীকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা না করতো তাহলে হয়তো সেসব প্রাণী নিজ নিজ সৃষ্টিতে মত্ত থাকতো। এই যে পাখি তার ডানা মেলে স্বাধীন ভাবে উড়তে থাকে, মানুষ সেটা পারেনা। ঈশ্বর মানুষকে সে ক্ষমতা দেয়নি বরং মানুষই নির্ভর হয়ে থেকেছে জড়বস্তুর উপর, আর পাখি নির্ভর করে তার ডানার উপর। মানুষ আর পাখিদের এই পার্থক্যে মানুষদের উপরে পাখিদের স্থান দেয় সে। আবার এই মানুষেরা প্রাণী হত্যা করে তার মাংসভোজী হয়। তো অই পশুর মেধা এবং অন্তশক্তি মানুষ তার ভিতরে নিয়ে নেয়। ফলে মানুষ উদ্ভাবন করে নতুন কোন সৃষ্টির, এটা নিয়ে তার যতো বিরোধ। এভাবেই মানুষ পরনির্ভরশীল হয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে অযৌক্তিক দাবি করে। তীরন্দাজ ভাবে মানুষ যখন তৃণভোজী ছিলো তখনই সব প্রাণীদের মতোই একটি সাধারণ প্রাণী সে ছিলো, তারপর যখন প্রাণী হত্যা করা শিখলো তখন থেকেই সে ঐ প্রাণীর মেধাটুকু ছিনিয়ে নিলো। কে জানে মানুষ যদি তার আদি অবস্থায় থাকতো তাহলে হয়তো অই প্রাণীকূলই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাদেরকে দাবী করতো। তারাও আবিষ্কার করতো ক্রমিক সভ্যতার। অই প্রাণীকূলই হয়তো নিজেদের ভাবনায় ঈশ্বরকে সৃষ্টি করতো, পবিত্র গ্রন্থগুলো তারাই সৃষ্টি করতো। বিভিন্ন প্রাণী-প্রজাতির উপর বিভিন্ন ওহী নাযিল হতো। যেটা মানুষ পেয়েছে এবং করেছে। তীরন্দাজ এসব কে মানুষের হিংস্রতার ফসল বৈ অন্যকিছু ভাবে না।

সকালে ফল-মূল খেয়ে তীরন্দাজ বাজারের দিকে বেরিয়ে যায়। সে যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, সে রাস্তায় বছর খানেক আগে পিচ ঢেলেছে সরকার। কিন্তু জায়গায় জায়গায় পিচ উঠে বড়ো বড়ো গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ দেখে চিৎকার-চেচামেচি করে মানুষজন জড়ো করে তীরন্দাজ। সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘এই যে আমরা গরু ছাগল পুষি, হাঁস মুরগী পুষি ওদের হাঁটার জন্যে পিচঢালা পথের প্রয়োজন হয় না। এই পাকারাস্তার জন্য ওদের কোন শোকতাপ নেই। যেকোন পথই ওদের কাছে পথ। ওরাও দেখেশুনে চলতে পারে। নিজেদের চলার রাস্তা ওরা কখনো নষ্ট করেনা। আর দ্যাখ এই মানুষের দল নিজেরা চলবে যে পথে সে পথেও ধান্দাবাজী করে। লুটপাট করে। মানুষ আর প্রাণীর মধ্যেও পার্থক্য এখানে। মানুষেরা লুটপাট করে আর পশুরা সেটা করেনা। এই পশুরাই সৃষ্টির সেরা জীব। ওদেরকে যদি মানুষ সভ্যতা সৃষ্টি করার সুযোগ দিতো তাহলে ওরা এতো দুর্নিতীবাজ হয়তো হতোনা।’ তীরন্দাজের এই ভাষণ শুনে গ্রামের লোকেরা মুখটিপে হাসে। বিভিন্ন কথা বলে উস্কানী দেয়। কেউ কেউ ওকে হুনুমানের বংশধর বলে গালিও দেয়। এসব কথা শুনে তীরন্দাজ আরো চেচামেচি করতে থাকে। উপস্থিত সবার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করে। পিছন থেকে অন্যেরা আলোচনা করে বলতে থাকে তীরন্দাজ নিশ্চয়ই মানুষ না, ভুলক্রমে আল্লা-ভগবান মানুষ বানিয়ে ওকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।

বাজারে চায়ের দোকানে বসে মানুষদের চা খাওয়া খুব মনোযোগ দিয়ে দ্যাখে, হাসে। এ দেখে চাখেকো মানুষেরা বিরক্ত হয়। ওকে চলে যেতে বলে। চায়ের দোকানীও ওকে গালমন্দ করে। তাতে তীরন্দাজের কিছু যায় আসে না। তীরন্দাজ ভাবে যে মানুষগুলো এভাবে চুকচুক করে চা খায় এগুলো তারা পশুদের কাছ থেকে নকল করে শিখেছে। পশুরা এভাবেই জলপান করে। আর চুকচুক করে শব্দ করে। বাজারের একপাশে সার্কাস থেকে বিতাড়িত জোকারদের খেলা দেখার জন্য লোকজন জড়ো হয়ে বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে। লোকেরা জোকারদের খেলা দেখে মজাও পাচ্ছে। তাদের এই মজা পাওয়ার দৃশ্যগুলো তীরন্দাজ উপলব্ধি করে। পশুদের বিভিন্ন আচরণ নকল করে খেলা দেখাচ্ছে অবিকল মানুষের সেই আদিরূপ। এ দেখে তীরন্দাজও ফিরে যায় মানুষের আদিরূপে, মিল খুঁজতে থাকে মানুষ ও অন্যপ্রাণীর সাদৃশ্যগত বৈশিষ্ট্য। সার্কাস দল থেকে বিতাড়িত দলের ভিতরে একটা বানর ও আছে। সার্কাস বালকটি যা যা করছে বানরটিও সেটা নকল করছে। বালকটি যখন মাটিতে গড়াগড়ি খায় বানরটিও গড়াগড়ি খায়। বানর ও মানুষের আচরণ ঠিক একই রকম। তীরন্দাজ ভাবে মানুষই তাদের সব কিছূ পশুদের কাছ থেকে শিখেছে এটা চিরন্তন সত্য। যা মানুষ অস্বীকার করে।

মানুষের ভাষা নিয়ে একটা নতুন চিন্তা ঢুকেছে তীরন্দাজের ভিতরে। মানুষ ভাষা পেলো কোথায়? এটা কার কাছ থেকে নকল করেছে। তীরন্দাজ বাজার থেকে একটু রাত করেই বাড়ি ফেরে। জোছনা রাতে একাকী বাড়ি ফিরছে। রাস্তার পাশে খোলা মাঠ, মাঠের মাঝখানে প্রাচীন একটা বট গাছ। গ্রামের লোকেরা এটাকে বড়োবটতলা বলে চেনে। ঠিক অই বটতলা থেকে একটা কালো রঙের কুকুর ছুটে এসে রাস্তায় তীরন্দাজের পথ আগলে দাঁড়ায়। কি যেন বলতে চাইছে। কিছুটা ভয়ও পেয়ে যায় সে। কিন্তু কুকুরের ভাষা সে বোঝে না। তীরন্দাজ ভাবে এই মানুষেরা কুকুর হত্যা করে প্রথমেই মাংসভোজী প্রাণী হয়। হতে পারে এটা তার ভাবনার একটা অংশ। তীরন্দাজের গা ঘেঁষে কুকুরটি দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে গোঙায়। তীরন্দাজ কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে। তাপরপর যখন কুকুরটি জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে তখন প্রকৃত সমস্যা বুঝতে পারে। কুকুরটির দিকে ও ভালোভাবে খেয়াল করে। একটা আঘাতের চিহ্ন কুকুরের পিঠের ঠিক মাঝখানে দেখতে পায়। তীরন্দাজ কুকুরটিকে বাড়িতে নিয়ে আসে। ওর ক্ষতস্থারে বিভিন্ন লাতাপাতার রস দিয়ে ব্যাথা দূর কের দেয়।

কুকুরের সাথে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। কুকুরকে যা করতে বলে তা করে। তখন তীরন্দাজ বুঝে নেয় মানুষের ভাষা সে বোঝে। বোঝার চেষ্টা করে। মানুষ সেটা বোঝার চেষ্টা করেনা। হয়তো কোনদিন সব প্রাণীদের ভাষা বুঝতো আর প্রাণীরাও মানুষের ভাষা বুঝতো। মানুষ যখন সভ্যতার খাতায় নাম লিখিয়েছে, তখন তাদের সভ্যতার খাতিরে অসভ্য প্রাণীদেরকে সবক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করেছে। অবহেলা, অনাদর এবং অস্বীকার করেছে। মানুষের ভাষার যে ভিন্নরূপ তা মানুষের দ্বন্দ ও দূরত্বের কারণেই হয়েছে। কিন্তু প্রাণীদের ভাষার রূপ একই। তীরন্দাজ ঘরে ফিরে ঘুমোতে যায়। কুকুরটিও দরোজার সামনে গুটিমেরে ঘুমিয়ে থাকে।

১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×