আনুমানিক দুইটা থেকে তিনটার মধ্যে কোনো এক সময়ে সামহোয়্যার ইন ব্লগ থেকে লগ আউট করে কম্পিউটার অফ করলাম। বাইরে তখন চরম ঠাণ্ডা। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ থাকার পরেও কোনো এক অলৌকিক উপায়ে ঘরের ভেতর বাতাস বইছিল । ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। হাতের আঙুলগুলো প্রায় টাইপ করতে অসমর্থ হয়ে যাওয়াতেই মূলত কম্পিউটার ছেড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেই।
শীতের রাত। আশেপাশের কোনো শব্দ নেই। সিলিং ফ্যানগুলোও বন্ধ থাকায় একেবারে পিনপতন নীরবতা চতুর্দিকে। প্রায় অর্ধেকের বেশি রাত মশার কামড় খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় মশারী টাঙিয়ে নিলাম। কম্বলের নিচে ঢুকেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। কোনোভাবেই ঠাণ্ডা যাচ্ছে না। অবশ্য তখন আমি শুধু পাতলা একটা শার্ট পড়েছিলাম। (আমার বিরুদ্ধে [পারিবারিক] দুর্নাম আছে আমি নাকি শীতকালে প্রায় খালি গায়ে আর গরমকালে মোটা মোটা কাপড় পড়ে থাকি )
যাই হোক, শোয়ার আনুমানিক দশ মিনিট পর (যা অন্যান্য দিনের তুলনায় দ্রুতই) ঘুমে চোখ বুজে আসলো। মজার ব্যাপার হলো, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, চোখ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। স্বপ্নটা এতো জীবন্ত বা প্রাণবন্ত ছিল যে, এখনো আমার দু'চোখে ভাসছে স্বপ্নগুলো।
হ্যাঁ, স্বপ্নগুলো। কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি দু'টো। একটা বড়; আরেকটা ছোট। এখন ছোটটাই বলি।
স্বপ্নে দেখলাম, কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছি। বেড়াতে না কাজে ঠিক বুঝতে পারিনি, তবে ঢাকার বাইরে কোথাও। আবহাওয়া ছিল ঠাণ্ডা; তবে শীতকাল ছিল না। আকাশে মেঘ ছিল। গ্রাম্য একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি আর আমার এক সহপাঠী (ওর সঙ্গে ভালো করে পরিচয়ও হয়নি, ও স্বপ্নে অভিনয় করলো কি করে বুঝলাম না)। পিচঢালা একটা লম্বা রাস্তা। রাস্তার দু'ধারে সারি সারি সবুজ গাছ।
আমরা হেঁটে যাচ্ছি একটা টার্মিনালের দিকে। লঞ্চ টার্মিনাল। অর্থাৎ আমরা কাজ বা বেড়ানো শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসছি। আমরা দু'জনই ছিলাম না। একটু পর দেখলাম আরো কয়েকজন বন্ধুও সেখানে উপস্থিত ছিল। তবে তারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা করছিল।
তো আমি আর আমার সহপাঠী একটা লঞ্চে উঠে পড়লাম। বলা বাহুল্য, যেটায় উঠেছিলাম সেটা ছিল বিশালাকৃতির এক ক্রুজশিপ; যেগুলো বাংলাদেশে নেই-ই। যাই হোক, আমরা উঠে লঞ্চের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। লঞ্চ থেকেই দেখা যাচ্ছিল অন্য বন্ধুরা টার্মিনালে কথা বলছে। লঞ্চ ছাড়তে এখনো অনেক দেরি। তাই কারো কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
তখন সন্ধ্যা। লঞ্চ ছাড়ার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই অনুভব করলাম দুলে উঠেছে পুরো জাহাজ। কী ব্যাপার! লঞ্চ তো এতো দ্রুত ছাড়ার কথা না। কিন্তু আমরা কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই লঞ্চ টার্মিনাল ছেড়ে খোলা নদীতে চলে এলো। এসেই ফুল স্পিডে চলতে শুরু করলো। আমার ধারণা যতটা স্পিডে আমি স্বপ্নে সেই লঞ্চরূপী ক্রুজশিপটাকে চলতে দেখেছি, বাস্তবে এতদ্রুত কোনো সাগরযান চলতে পারে না।
ততক্ষণে লঞ্চের অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা, কোনো ভাবে খোলা সাগরে থাকা অন্য কোনো লঞ্চের সঙ্গে একটু ছোঁয়া লাগলেই সাগরবুকে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের লঞ্চ।
তারচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, আমি সাঁতার জানি না! (বাস্তবেই না)
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ঠিক আমাদেরটার মতোই আরেকটা ক্রুজশিপ ওরফে লঞ্চ। দু'টো একেবারে পাশাপাশি চলে এসেছে। ওটা ধীরগতিতেই চলছে, কিন্তু আমাদেরটা ওটাকে পাশ কাটানোর জন্য যেন মরিয়া হয়ে পড়েছে। আমাদের লঞ্চ থেকে ঐ লঞ্চটার দূরত্ব তখন এক কি দেড় হাত। হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যায় অপর লঞ্চটির। চরম উত্তেজনায় প্রতিটি সেকেন্ড যাচ্ছে সবার। যে কোনো সময় সংঘর্ষ হতে পারে জাহাজ দু'টির। আর যদি তেমন কিছু হয়, শত শত লোকের ভাগ্যে আছে মৃত্যু। যাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে নিজের নাম উপলব্ধি করছিলাম আমি।
হঠাৎ একটা প্রবল ধাক্কা লাগলো লঞ্চ দু'টোর মধ্যে। যাকে বলে একেবারে ভূমিকম্প। ভীষণভাবে দুলে উঠলো জাহাজদু'টো। ভয়ে-আতঙ্কে জমে আসা হাত দিয়ে সহপাঠী আমাকে দ্বিতীয় জাহাজটির দিকে ইশারা করলো। ধাক্কা লেগে সেটা তখন পেছনে পড়ে গেছে। দ্রুত পানি ঢুকছে সেই লঞ্চ বা জাহাজটিতে। পুরো ডেক পানিতে থৈ থৈ করা শুরু করেছে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে।
সাঁতার না জানা একজন মানুষের জীবনে ঐ মুহুর্তটা কতোটা ভয়ঙ্কর আর শ্বাসরুদ্ধকর হতে পারে নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছেন। মুত্যুভয় আর আতঙ্কে অবশ হাত-পা নিয়েই ঘুম ভাঙলো আমার। খেয়াল করে দেখলাম, এখনো হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে। শীতের নিস্তব্ধ রাতে স্পষ্ট হৃদস্পন্দন শুনতে পেলাম শুয়ে থেকেই।
দ্বিতীয় স্বপ্ন পরে কোনোদিন লিখবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১১ রাত ১১:১৫