somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা আন্দোলনঃ শহীদদের স্বপ্ন পূরনের জন্য চাই সর্বস্তরে বাংলাভাষার চর্চা

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা অনুসারে ব্যক্তি থেকে সমাজ আর সমাজ থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। ব্যক্তির ভাষা মাতৃভাষা। সমাজের ভাষা মাতৃভাষা। তাহলে সমাজ থেকে রাষ্ট্র গঠিত হলে রাষ্ট্রের ভাষাও মাতৃভাষা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতার জোরে পাকিস্তানি শাসকচক্র আমাদের মাতৃভাষার বাহিরে অন্য একটিভাষা আমাদের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলো। দেশ বিভাগের পূর্বেই তারা এ ষড়যন্ত্র শুরু করে। তবে তা নজর এড়াতে পারেনি আমাদের বুদ্ধিজিবী মহলের। শুরু হয় বিভিন্নভাবে আন্দোলন। ১৯৪৩ সাল থেকে মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক সওগাত ইত্যাদি পত্রিকায় ব্যপক লেখালেখি করেন আমাদের বুদ্ধিজিবী মহল। খ্যাতনামা সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ, বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, চৌধুরী খালেকুজ্জমান, আবদুল হক, মাওলানা আকরাম খাঁ, আবুল কালাম সামসুদ্দিন, মুজিবুর রহমান প্রমুখ বুদ্ধিজীবি বক্তব্য ও প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন। এরপরও যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির কার্যকলাপ ভালো মনে হলো না, তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৫ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠন করা হলো তমদ্দুন মজলিশ। “ঢাকার আরমানিটোলার ‘নূরপুর ভিলায়’ ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিশের এক মিটিংয়ে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এ মিটিংয়ের সভাপতি ছিলেন ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

নভেম্বর মাসে সফররত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের পক্ষ হতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক দাবী সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্মারকলিপিটি পাঠ করে শুনান ডাকসুর তৎকালীন জিএস।

এভাবে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বেগবান হতে থাকে বাংলাভাষার দাবি। জিন্নাহ, নাজিমউদ্দিন সাহেব সহ যিনিই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কথা বলতেন, তার সাথে সাথেই প্রতিবাদি হয়ে উঠতো এ দেশের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল। পাকিস্তানী শাসকচক্রও কঠোরতা অবলম্বন করতে শুরু করলো। জারি করলো সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারা। তবে মাতৃভাষা প্রেমিকদেরকে এগুলোর কিছুই দমিয়ে রাখতে পারে নি। তারা কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাহিরে বেরিয়ে আসে। যার ফলে জীবন দিতে হয় সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বারের মত দেশের সূর্য সন্তানদেরকে।

তারা জীবন দিয়ে আমাদের জন্য রেখে গেলেন বাংলাভাষা। পৃথিবীর বুকে বাঙালিরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবনকে উতসর্গ করেছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের আজ ৬১ বছর পরও কি আমরা পেরেছি শহীদদের মনের ইচ্ছা পূর্ন করতে?

কি কারনে জীবন দিয়েছেন আমদের ভাইয়েরা? তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি? তারা চেয়েছিলেন সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করতে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য আজ স্বাধীন দেশে বাস করেও আমরা বাংলার চেয়ে অন্য ভাষাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আমাদের উচ্চশিক্ষিত লোকেরা নিজেদের সন্তানদেরকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতেও কুন্ঠা বোধ করেন না। বাংলার আগেই হিন্দি ভাষা শিখছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। যা জাতীর জন্য চরম দুর্ভাগ্য।

যে বাংলা ভাষার জন্য ইউনেস্কো ২১ ফেব্রয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দিয়েছে, সে ভাষায় কথা না বলে আজ আমরা ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় কথা বলে নিজেকে স্মার্ট মনে করছি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম ভাষা শহীদদের নাম ঠিকমত বলতে না পারলেও ভারতীয় নায়ক নায়িকাদের নাম ঠিকই বলতে পারছে। রেডিও টিভিতে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কে নিয়ে যতনা আলোচনা হয় তার তার চেয়ে অনেক গুনে বেশি আলোচনা হয় নায়ক-নায়িকা ও খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে। বাংলাভাষার মধুর সুর ও ধ্বনী পরিবর্তন করে বিদেশি ভাষার সুরের সাথে বাংলার সুরকে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে। রেডিও জকিতে এ কাজটি করা হচ্ছে অত্যন্ত সফলতার সাথে।

আমাদের বাংলাভাষা গরীব নয়, ব্যাপক সমৃদ্ধশালী। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায়- “মাতৃকোষ রতনের রাজি”। কিন্তু এ রতন ছেড়ে আমরা বিদেশি নোংরা সংস্কৃতির দিকে আজ হাত বাড়াচ্ছি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সালাম-বরকতের এই পূন্যভূমিতে শাররুখ খানের কনসার্টের আয়োজন করা হচ্ছে। অথচ বাংলার গর্ব লালন-হাসনের গানগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। এগুলোকে রক্ষা করার কোন উদ্যোগই যেন দেখা যায় না উপরের লোকদের মধ্যে। যার খেসারতও অবশ্য আমাদের দিতে হচ্ছে। অশ্লিল হিন্দি ও ইংলিশ ছবির ছড়াছড়িতে আজ অধঃপতনের অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের যুব সমাজ। ইভ টিজিং, ধর্ষন ইত্যাদি আজ নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু এ জন্য কি জীবন দিয়েছিলেন আমাদের ভাইয়েরা? শুধুমাত্র একটি ভাষার জন্য তারা নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন আমাদের মুখের ভাষা। আর আমরা কিনা তার অমর্যাদা করছি!! হীরার টুকরো ছেড়ে লোহা লস্কর নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছি!! এর মাধ্যমে আমরা সরাসরি বেঈমানি করছি আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের সাথে।

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাস এলে আমরা খালিপায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাই। আর বাসায় এসে চালিয়ে দেই হিন্দী বা ইংলিশ ছবি- যা শহীদদের সাথে সুস্পষ্ট প্রতারনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যেসব ভাষা সৈনিক এখনো জীবিত আছেন আমাদের কর্তাব্যক্তিরা তাদেরকে উপযুক্ত সম্মান দিতেও কৃপণতা করছে। যারা রাজনৈতিক ভাবে তাদের দলের নয়, তাদেরকে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত করছে, আর যারা নিজ দলের লোক, তাদেরকে নানারকম মিথ্যা বিশেষনে ভূষিত করছে, যা জাতীর জন্য চরম দুর্ভাগ্য।

প্রতি বছরের মত এবারও আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে ২১শে ফেব্রুয়ারী। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আমাদের শহীদ মিনারগুলো। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”। আমাদের শহীদ ভাইয়েরা চাননি, উনাদের সম্মানে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হোক। উনার চেয়েছেন সর্বস্তরে বাংলাভাষার চর্চা। তাই বিদেশি ভাষার প্রতি মোহ পরিত্যাগ করে, বাংলাভাষার চর্চা সর্বস্তরে চালু করা গেলেই পূরন হবে শহীদের স্বপ্ন। আর এটাই হওয়া উচিত শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ড্রেনেই পাওয়া যাচ্ছে সংসারের তাবৎ জিনিস

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫০



ঢাকার ড্রেইনে বা খালে কী পাওয়া যায়? এবার ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তর) একটি অভুতপূর্ব প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। তাতে ঢাকাবাসীদের রুচিবোধ অথবা পরিচ্ছন্নতাবোধ বড় বিষয় ছিল না। বড় বিষয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×