অবসরে বিনোদনে টিএসসি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
অবসরে বিনোদনে টিএসসি
সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। জন্মলগ্ন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় লেখা-পড়া ও জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছে। টিএসসি এ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাদপীঠ। লেখা-পড়া ও জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে, ভবিষ্যৎ জীবনে নেতৃত্ব গ্রহণের উপযোগি হবে, এ উদ্দেশ্য নিয়েই ষাটের দশকে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। টিএসসিকে দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের তীর্থস্থান বলেও মনে করা হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছাড়াও দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কার্যক্রম এ কেন্দ্রকে ঘিরে পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় বহিরাগতদের আধিক্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও যত্রতত্রভাবে কোন শৃংখলা না মেনে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।
বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির ফলে হলসমূহের পক্ষে সহশিক্ষা কার্যক্রমের পর্যাপ্ত সুযোগ বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছিল না। শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম পরামর্শ ও নির্দেশনাকে আরো সুসংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে কর্তৃপক্ষ ১৯৬১ সালে একটি ছাত্র বিষয়ক শাখা গঠন করে। পরবর্তীতে এটাই ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র হিসেবে বৃহত্তর পরিসরে আত্মপ্রকাশ করে। কেন্দ্রের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৬২ সালে। গ্রীক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ডকসিয়াডিস এসোসিয়েটস কনসালটেন্ট লিমিটেড এ টিএসসি ভবনের নকশা তৈরী করে। ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৬ সালে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই টিএসসি দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সহযোগিতা করে আসছে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে টিএসসির তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আশির দশকে টিএসসি কেন্দ্রিক দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দল গঠিত হয়। এ দল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সত্তরের দশকে নাট্য চর্চা, আশির দশকে আবৃত্তি চর্চার জন্য বিভিন্ন সংগঠন এখানে কার্যক্রম শুরু করে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মূলত হল সংসদ ও ডাকসুর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কিন্তু ১৯ বছরের বেশী সময় ধরে হল সংসদ ও ডাকসু অনুপস্থিত থাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে কিছুটা স্থবিরতা চলে আসে। আর স্থবিরতা দূর করতে টিএসসির মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে নিয়মিত। ডাকসুর জন্য প্রদত্ত বরাদ্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বর্তমানে টিএসসির সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যয় করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের এক্সট্রা একাডেমিক কার্যক্রম, খাবার দাবার এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মিলনস্থল হিসেবে টিএসসি স্থাপিত হয়। কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সহশিক্ষা কার্যক্রম চর্চা, প্রশিক্ষণ এবং উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য স্থাপিত হলেও বর্তমানে এ কেন্দ্র ঢাকা তথা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বিশেষ অবদান রেখে আসছে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ অতীত আছে, আছে ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিবছর আয়োজন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। ঈদ-পূর্বমেলা, বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালবাসা দিবস, বিশ্ব বন্ধু দিবস সাফল্যজনকভাবে শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন হল এবং বাইরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সর্বত্র মুখরিত থাকে। প্রতিবছর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্লাস বহির্ভূত নানা প্রকার চিত্ত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের নবীনবরণ ও বিদায় ছাত্র-ছাত্রীদের বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের জন্য কেন্দ্রের ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে দেড় হাজার জনের স্ন্যাকস সরবরাহ করা হয়। ক্যাফেটেরিয়ায় ১১শ জনের দুপুরের খাবারের সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিশেষ খাবার সরবরাহ করা হয়। টিএসসিতে রয়েছে একটি অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া কক্ষ। ছাত্র-ছাত্রীরা সারা বছর এটি ব্যবহার করেন। এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা টেবিল টেনিস, দাবা, ক্যারাম ইত্যাদি খেলা নিয়মিত খেলে থাকে। কেন্দ্রের অতিথি ভবনে সারা বছর দেশী-বিদেশী অতিথিরা অবস্থান করেন।
টিএসসিতে রয়েছে ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক শাহীন ইসলাম। এখান থেকে আর্থিক সমস্যাগ্রস্ত দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের খন্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। ছয়মাস অন্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ জন করে ছাত্র বছরে দুইবার প্রায় ১৫০ জন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে চাকুরী দেয়া হয়। টিএসসিতে অবস্থিত এ দফতর থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মনোচিকিৎসা ও পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিরও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
টিএসসি ব্যবহার ও পরিচালনার জন্য নীতিমালা আছে। কিন্তু দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ টিএসসির কক্ষগুলোর কোনটিই কোন একক সংগঠনের জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দিতে পারে না। টিএসসি পরিচালনার জন্য সিনেট থেকে প্রস্তাবিত নীতিমালায়ও স্থায়ী বরাদ্দের সুযোগ রাখা হয়নি। শুধুমাত্র আবৃত্তি, সঙ্গীত, নাটক প্রভৃতি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মহড়ার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এখানে ছোট-বড় অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে বসেছে। সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমেদ ও অধ্যাপক এ কে আজাদ চেীধুরীর সময়ে বিভিন্নভাবে যে সব সংগঠন এই কেন্দ্রে কার্যালয় স্থাপন করে বসেছে তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ চেষ্টা কখনোই সফল হয়নি। এখনো সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে কথিত কিছু সংগঠন টিএসসির ভেতরে-বাইরে ১৫টি কক্ষ এবং সুইমিংপুলের একাংশ দখল করে রেখেছে। টিএসসির বাইরে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নামে আবার বাণিজ্য হচ্ছে। এখানে প্রতিদিন যত্রতত্র সংগঠনের ব্যানার বসিয়ে রীতিমতো ব্যবসা চলছে। দখলদারমুক্ত করে কিভাবে একটি সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে টিএসসি পরিচালনা করা যায় সেই প্রস্তাবনা রাখার জন্য ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সিনেট সদস্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি একটি নীমিতালা তৈরী করে সিনেটে জমা দিলেও তার কোন বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানা গেছে। বর্তমানে টিএসসিতে ৪৬টি সংগঠনের কার্যক্রম রয়েছে। এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া নামেমাত্র রয়ে তারা রুম দখল করে আছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হলেও গুটিকয়েক সংগঠন ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না।
পড়াশোনার ফাঁকে টিএসসি সবুজ ঘাসে ছাত্রছাত্রীরা আড্ডায় মেতে থাকেন। অনেক শিক্ষার্থী অবসরের পুরো সময়টা টিএসসিতে বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটান। এখানে ওয়াই-ফাই প্রযুক্তির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেটের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
টিএসসির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন আলমগীর হোসেন। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মূলত টিএসসির মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এজন্য টিএসসিতে বার্ষিক সাংস্কৃতিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
সুত্র: ইত্তেফাক
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।
আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!
এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঁচতে হয় নিজের কাছে!
চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন