somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তরাধিকার (গল্প)

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ফারজানাকে পাওয়া গেছে। প্রায় পনেরো বছর পর তাকে ফিরে ফেলাম। এই জনমে তার সাথে দেখা হবে তা কখনোই ভাবিনি। মানুষের জীবনে হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যায়, যা তার কল্পনার সীমানা অতিক্রম করে। আমারও তাই হলো। রেলস্টেশনে গেলেই দেখতাম আমার আশপাশে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই এলাকাটিতে ভবঘুরে মানুষের অভাব নেই। এদের একেকজনের একেক রূপ, কেউ কাঁধে একটা ঝুলি নিয়ে একটানা হাউমাউ করে কথা বলে যায়, কেউ পথচারীদের কাছ থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে দৌড় মারে, কেউবা আবার পথচারীদের মারতে উদ্যত হয়। এই মেয়েটি অন্যরকম, স্টেশনের প্রবেশমুখে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, কাউকে কিছু বলে না, বিরক্ত করে না। স্টেশনের দিকে গেলেই দেখি মেয়েটি আমার পিছু নেয়, কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, পাগলিটি এভাবে তাকায় কেন? একদিন কাছে ডেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে তার হাতে দিতে চাইলাম। মেয়েটি টাকাটা নিল না, আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল, তার চোখ থেকে জল বেরিয়ে পড়ল। অঝোরে কাঁদছে সে, তার চোখের জলের প্লাবন কপোল ভেসে মাটি ছুঁয়ে যেতে লাগল। আশ্চর্য, পাগলিকে টাকা দিতে চাইলাম, ‘পাগলও টাকা চেনে’ বলেই। হাত বাড়িয়ে নেবে তা না, চোখের জল ঝরাচ্ছে! কারো চোখের জল আমি মোটেও সহ্য করতে পারি না, আমার চোখেও জল চলে আসে। মানুষের ভেতরে বেদনা থাকলে নাকি সহজেই চোখ ফেটে জল বের হয়। নিজের বুকে বেদনা লুকোনো বলেই অপরের বেদনা সহ্য হয়না। কারো মানসিক ভারসাম্য হারানোর পেছনেও অবশ্য এক একটা করুণ ইতিহাস লুকিয়ে থাকতে পারে। অথচ সুস্থ মানুষগুলো ‘পাগলের কান্না’ কখনোই আমলে নিতে চায় না। কিন্তু এই মেয়েটির চোখের জল আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। পাগলিটার চোখে-মুখে একটা আভিজাত্য লক্ষ্য করলাম। কী জানি কোন বড়লোকের আদরের দুলালী অতি আবেগতাড়িত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে কি-না? আমি আরো কাছে গেলাম, তাকে আপাদমস্তক খেয়াল করে দেখছি। ও আমার দিকে তাকিয়ে বিষণœ-বেদনাভরা মুখে অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু চোখে একটা লাজুক ভাব। এটা দেখে ফারজানার কথা মনে পড়ে গেল। ফারজানাও বেশ লাজুক ছিল, একটু দুষ্টুমি করলেও সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠত, হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখত। আমার সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে, ওকে ফারজানার মতো মনে হচ্ছে কেন? পাগলিটার চোখ, নাক, ঠোঁট, কপাল, হাতের তালু পরীক্ষিত নয়নে গভীরভাবে পরখ করতে থাকি। সবকিছু ফারজানার সাথে মিলে যাচ্ছে! পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম ওর ঠোঁটের ওপরে ডান পাশের কালো তিলটি দেখে। আমার নাকের ডানপাশেও একটি কালো তিল আছে বলে ফারজানা বলত, ‘আমাদের মধ্যে একটা মিল আছে।’ রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়ানো এই পাগলিটিই ফারজানা, এটা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে অনুশোচনার অনলে পুড়ে যাচ্ছি, জীবনজুড়ে খরা নেমেছে। এ আমি কী করেছিলাম? একটা কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে আমার সেদিনের ‘সাজানো কথাটি’র প্রতিক্রিয়ায় কিশোর বয়সের প্রেমিকা মেয়েটির নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এবং তাকে পনেরো বছর পর রেলস্টেশনের ভবঘুরে মানুষদের সারিতে দেখার এই করুণ ইতিহাস বাকি জীবন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে নীরবে। যদিও সেই কৌশলটির পেছনে এক ধরনের যৌক্তিক বাস্তবতা ছিল। তবুও মনে হচ্ছে, ‘কী যাতনার প্রলয় মাঝে জীবনতরী দোলে, সব খেলাঘর ভেঙে গেল হায়, অমানিশার ছলে।’ পৃথিবীর বার্ষিকগতির মতো মানুষের জীবনটাও একটা চক্রের মধ্যে ঘুরছে। জীবনের এই ঘূর্ণাবর্তে কত করুণ গল্প লুকিয়ে থাকে, কত নির্মম সত্য বয়ে বেড়াতে হয় মানুষকে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় আমিই। সবার জীবনে ‘বাবা’ বলে যে একজন মানুষ থাকেন, কোলে নিয়ে কাঁধে তুলে আদর-স্নেহ দেন, আমি তা কখনোই পাইনি। বাবাকে কখনোই দেখিনি, তিনি কোথায়, কী হয়েছিল তাও আমি জানতে পারিনি। সেই শৈশব থেকেই মনে মনে বাবার কথা ভাবতাম, বাবা কোথায়, আমার বাবা নেই কেন? স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে শিশুদের যে, ‘বাবা’ নামক একটা আলাদা অধ্যায় আছে তা বুঝতেই পারিনি, তবে ভেতরে একটা শূন্যতা বয়ে বেড়াতাম হয়তো। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বন্ধুবান্ধবদের দেখলাম সকালে মা স্কুলে দিয়ে যান, বিকালে বাবা এসে নিয়ে যান। কেবল আমার বেলাতেই অন্যরকম। মা আমাকে স্কুলে দিতেও আসেন, নিতেও আসেন। স্কুল ছুটি হলে বন্ধুরা যখন তাদের বাবার হাত ধরে হেঁটে যেত, তখন বাবা নামক একজন মানুষকে হৃদয় থেকে অনুভব করতাম। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে একজন ‘বাবা’কে স্বপ্নে দেখতাম। দেখতাম, আমাকে কাঁধে চড়িয়ে মেলায় নিয়ে গেছেন বাবা। মেলায় ঘুরে ঘুরে খেলনা পিস্তল, বাঁশি, মাটির ব্যাংক, বাঘের মুখোশ, বেলুন আরো কত কি কিনে দিচ্ছেন। মিঠাইমণ্ডার দোকান থেকে সন্দেশ-বাতাসা কিনে খাওয়াচ্ছেন। এক রাতে আরো কী একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি বাবাকে নিয়ে। সেদিন ঘুমের ভেতরেই ‘আব্বু, আব্বু, আমিও যাবো’ বলে শব্দ করে উঠেছিলাম। আমার চিৎকার শুনে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে ‘কী হয়েছে?’-মায়ের এমন প্রশ্নে ঘুমজড়ানো চোখে থতমত খেয়ে ‘আব্বু’ শব্দটি মুখে আনতেই মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘চুপ করে ঘুমিয়ে থেকো। তোমার কোন বাবা নেই। আমি তোমার মা, আমিই তোমার বাবা। আর কখনোই বাবার কথা বলবে না। তোমার কোন অপূর্ণতা তো রাখিনি আমি। তারপরও বাবাকে লাগবে কেন?’ সেই রাতে মায়ের চোখেমুখে কোন অভিমান-অনুশোচনা দেখিনি। তবুও ‘তোমার কোন বাবা নেই’ বাক্যটি আমার ভেতরে নির্মম বেদনার জন্ম দিয়েছিল, হৃদয়ে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। বুকের জমিন পুড়ে যাচ্ছিল খরার অনলে। সত্যিই মা-ই আমার সবকিছু। তিনি আমার কোন কিছুই অপূর্ণ থাকতে দেন না। যত জিনিসের বায়না ধরি, কোন অজুহাত ছাড়াই সবকিছু কিনে দেন। ‘এটা নিও না’, ‘এটা পরে নিও’ ‘আজ টাকা নেই’ এ জাতীয় কথা তিনি কখনোই বলেন নি। যা বায়না ধরেছি, যা-ই চেয়েছি তা কোন অজুহাত ছাড়াই নীরবে কিনে দিয়েছেন মা। বেতনের সব টাকা আমার পেছনে খরচ করতেন। আমাকে খুশি করার জন্য কতকিছু যে করতেন, আমার সন্তুষ্টিতে তিনি পরম তৃপ্তিবোধ করতেন। ঈদের সময় হলে চার-পাঁচ সেট কাপড় কিনে কয়েকদিন আগে থেকে নিজের হাতে পরাতেন, আমাকে সেজেগুজে দিয়ে ঢং দেখতেন। পূর্বাকাশে সূর্য উঠার সাথে সাথেই আমার মায়ের সংগ্রাম শুরু হতো। ঘুম থেকে ওঠে রান্নাবান্না সেরে প্রথমেই আমাকে ভালোভাবে খাওয়াতেন। নিজের হাতে আমার ইউনিফর্ম পরিয়ে দিয়ে শিশিরভেজা ভোরে ধীরপায়ে আমাকে হাতে ধরে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে যেতেন নিজের স্কুলে। আমার ও মায়ের দুই জনের দুটি স্কুল। মা শিক্ষকতা করেন মাধ্যমিক স্কুলে, আমি পড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অবশ্য আমি ক্লাস সিক্সে ওঠার পর মায়ের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। তখন দু’জনেই একই স্কুলে যেতাম। মা যান পড়াতে, আমি যাই পড়তে। সকাল থেকে টানা পাঁচ-ছয়টি ক্লাস নিয়ে হাঁফিয়ে উঠতেন মা। এরই এক ফাঁকে আমার স্কুল ছুটির সময়ে আমাকে নিতে আসেন। বিকালে তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরে আবার রান্নাবান্না, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, সন্ধ্যায় আমাকে পড়াতে বসানো, নিজের শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন-এভাবে প্রতিটি মুহূর্ত মায়ের শ্রমসাধ্য ব্যস্ততা। একটানা কাজ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তবুও আমাকে কোন কাজ করতে দেন না। ‘তুমি পড়ো’ বলে মা সবকাজ একা সামাল দেন। আমার কোন ভাই-বোনও নেই, আমাদের পরিবার বলতে কেবল আমি এবং মা। শিশু বয়স থেকেই একা একা বড় হচ্ছি, চারপাশে কেবল একজনই ‘মা’। আমার পৃথিবীটা আবর্তিত হয় মাকে ঘিরে, আর মায়ের পৃথিবীটা আবর্তিত হয় আমাকে ঘিরেই। আমাদের এই পৃথিবীটা কত ক্ষুদ্র! এসএসসি পাশের পর প্রথম কলেজে নিয়ে গেলেন মা। ভর্তি ফরম নিয়ে পূরণ করার সময় দেখলাম পিতার কলামটি খালি রেখেছেন। স্কুলে কী লিখতেন আমি জানতে পারিনি। কেননা, মা ওই স্কুলের শিক্ষক বলে সবকিছু তিনিই জমা দিতেন। কলেজের ফরম নেয়ার সময় কর্মকর্তা বাবার কলাম খালি কেন জিজ্ঞ্যেস করলেন। মা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উত্তর দিলেন, ‘ওর বাবা নেই।’ সেদিনও আমার ভেতরে নির্মম বেদনার উদয় হয়েছিল। কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আমাকে আবেগী কণ্ঠে মা বললেন, ‘বাবা রকিব, তুমি এখন বড় হয়েছ। এই বয়সটা ইমোশনাল, উচ্ছৃঙ্খল ও সিদ্ধান্তহীনতার। আবেগের কারণে এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা বড় ভুল করে বসে। এটা বয়সের দোষ। তারপরও সব সময় মনে রাখবে তুমি একজন শিক্ষিকার ছেলে। অন্যদের চেয়ে তোমাকে অনেক বেশি আদর্শবান হতে হবে। সমাজে আমার মানসম্মানের প্রশ্ন অনেক বেশি। তোমাকে অনেক কষ্টে তিল তিল করে বড় করছি। তুমি এমএ পাশ করে একটা চাকরি-বাকরি পেলে আমি অবসর নেব। তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন, বাবা। তোমার কোন আচরণে যেন আমার মানসম্মানের ক্ষতি না হয় সেভাবেই চলবে।’ কৌশলে বুঝিলে বললেন, কলেজে কোন মেয়ের প্রেমের ফাঁদে যেন পা না দিই। কোন নারীর ছলনায় ভুলে যেন মাকে কষ্ট না দিই কখনোই। কথা বলতে বলতে মায়ের চোখের জল টপটপ করে ঝরতে লাগল। মায়ের ভেতরে কতটা ব্যথা-বেদনা লুকিয়ে আছে তা কখনোই আমাকে বুঝতে দেননি। সেদিন আমি নিজেই বুঝে নিলাম। মনে পড়ে গেল ‘বাবা নেই’ কথাটি। আমার চোখেও জল চলে এল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, মা জননীকে কখনোই কষ্ট দিতে পারি না আমি। তারপর থেকে সামনে এক পা বাড়ানোর আগেই আমাকে মায়ের ‘মানসম্মান’ এর কথা চিন্তা করতে হয়েছে। একটু এদিক-ওদিক করতে গেলেই মনে হতো মায়ের সম্মানহানী হতে পারে কিংবা মনে কষ্ট পেতে পারেন। আমি ছাড়া মায়ের পৃথিবীতে আর কেউ নেই, হয়তো আমার জন্যই বেঁচে আছেন তিনি। এ কারণে সব সময় একটা মানসিক চাপ বয়ে বেড়াতাম, এমনকি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দীর্ঘ হতে থাকলেও মনে হতো ‘মা কষ্ট পাবেন।’ কলেজ ক্যাম্পাসে বন্ধুবান্ধবদের উচ্ছ্বল পাঁয়চারীর মাঝেও নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে রাখতাম। সবসময় চিন্তামগ্ন থাকতাম বলে বন্ধুবান্ধব আর স্যারদের কাছে মনে হয়েছিল আমি ‘ভাবুক’, কবিতা-টবিতা লিখি। ক্যাম্পাসে বন্ধুদের রসিকতার ছলে একদিন ‘কবি’ উপাধিও পেয়ে গেলাম, অথচ তখনো কোন কবিতা আমি লিখিনি। তারপর, কীভাবে যে কবিতা লেখার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল জানিনা। শুধু এটা জানি, বন্ধুরা যেহেতু কবি উপাধি দিয়েছিল সেহেতু নামের কবি না হয়ে কাজের কবি হতে চেয়েছিলাম। ক্রমান্বয়ে ভাবনার জগৎটা বিস্তৃত হতে থাকে, কবিতা লিখার সাধনায় ডুবে যাই। প্রথম কবিতাটি লিখেছিলাম বাবাকে নিয়ে, তারপর মা। আমাদের বাংলার শিক্ষক রাহগীর মাহমুদ স্যার কবিতা দুটির বেশ সুনাম করলেন, আরো লিখার অনুপ্রেরণা দিলেন। স্যারের অনুপ্রেরণা পেয়ে আমার উৎসাহ দ্বিগুণ হয়। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠি, কবিতাপ্রেমী তৈরি হতে থাকে। বান্ধবী ফারজানা আমার কবিতাপ্রেমী ছিল, আমি তাকে নিয়ে কবিতা লিখি, কবিতায় তার রূপের গুণগান গাই। প্রতিদিন দেখা হয়, কথা হয়, হাসি-ঠাট্টা আড্ডা হয়। নারীর প্রতি পুরুষের একটা সহজাত দুর্বলতা থাকেই, কৈশোরের উচ্ছ্বল বয়সের আবেগের টান তার তীব্রতা আরো বাড়িয়েছিল। ফারজানা-ই হয়ে যায় আমার সব কবিতার উপাদান। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা-প্রেম। আমাদের সম্পর্ক এত গভীর হয় যে, দু জন দুজনকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না, এক মুহূর্তের বিচ্ছেদ সহ্য হয় না। ফারজানার নয়নের গভীরে পলক রেখে পৃথিবীর সবকিছু ভুলে যাই, এক পলক তাকে দেখার জন্য সাত-সমুদ্র অতিক্রম করতে পারি। তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তায় একবার হেঁটে আসলেও প্রশান্তিতে ভরে ওঠত মন। ও একটু বেশিই আবেগী ছিল, এ কারণে মনে কষ্ট পায় এমন কোন কথা আমি বলিনি। এভাবেই কেটে যায় তিনটি বছর। এতদিনে আমার এই অতি ভালোবাসার বিষয়টি টের পেয়ে যান মা। এক রাতে আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘রকিব, জীবনের সমস্ত কষ্ট মেনে নিয়ে একটা স্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি আমি, ভেবেছিলাম তুমি একদিন এমএ পাশ করবে, চাকরি করবে। আমার সেই স্বপ্ন কি ভেঙে যাবে? তুমি কি আমাকে কষ্ট দেবে?’ আমি মাকে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মা কোন কথা শুনতে রাজি হলেন না। এক কথায় বললেন, ‘আমি সব জেনেছি, তোমার কারণে যদি সমাজে আমাকে নিচু হতে হয়, আমার সম্মানহানী হয়, তাহলে সেদিন থেকে মাকে আর পাবে না-এটা মনে রেখ।’ মা খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন, চোখের জল টলোমল হলো। মায়ের চোখের জল কী করে সহ্য করবো? আমি বললাম, ‘মা, আমি তোমাকে কষ্ট দেবো না, আজ থেকে সব শেষ।’ পরদিন কলেজে গিয়ে ফারজানার সাথে কোন কথা বলিনি। ও ভেবেছিল আমি অভিমান করেছি, মান ভেঙে যাবে। কিন্তু এর পরদিনও কথা না বলায় ও আমার কাছে এল। অনেক কষ্ট হচ্ছিল তবুও ‘পর হয়ে যাওয়ার’ কৌশল খুঁজতে থাকি। অভিধানে চোখ বুলাতে গিয়ে এই শব্দটি কেন যে চোখে পড়ল? ‘ইমপোটেন্ট’। হ্যাঁ, একটা কৌশল পেয়ে গেছি। ফারজানা যেদিন আমার মান ভাঙাতে এসেছিল সেদিনই তাকে বললাম, ‘আমাকে ভুলে যাও, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। বিকজ, আই এ্যাম ইমপোটেন্ট।’ আমার কথা শুনে সে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়, একটি কথাও বলতে পারেনি। ভেবেছিলাম আমার প্রতি ঘৃণা জন্মাবে, ভুলে যাবে। কিন্তু কথাটি নিয়ে সে যে এতটা ‘হার্ট’ হবে সেদিন তা বুঝতে পারিনি। ওইদিনই নিরুদ্দেশ হয়ে যায় ফারজানা, দুপুরে কলেজ থেকে আর বাড়ি ফেরেনি। এত বছর ধরে কোথাও খোঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। শোকে এখনো পাথর হয়ে আছেন তার মা। ওর বাবা আমাকে দেখলেই কাছে টেনে গুমরে কেঁদে ওঠেন। তিনি কেবল জানতেন, ‘ফারজানা আমার বন্ধু।’ ওর বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার চোখেও জল আসে কিন্তু কঠোরভাবে চেপে যাই। সেই ফারজানা এখন রেলস্টেশনে ভবঘুরেদের সারিতে ঘুরে বেড়ায় এ কথা আমি তাদেরকে কীভাবে জানাই? তারপর থেকে আমার সব কাজকর্মে ভুল হয়ে যাচ্ছে। অফিসের কাজে প্রায়ই ভুল করছি। নিজের ভুলের জন্য জবাবদিহি করতে আমার ইগো প্রবলেম হয়, অপরাধবোধ জাগে। এ কারণে চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছি। হৃদয়ে বেদনার উদ্রেক হলে রেলওয়ে পাহাড়ের মাঝামাঝি যে স্থানটি নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি, লতা-গুল্মে ঠাসা প্রায়ই সেখানে গিয়ে একাকী বসে থাকি। সামনে দু’হাঁটু গেড়ে তার ওপর ইউশেফে বেঁকে হাত দুটি রেখে নুইয়ে মাথাটি ডুবিয়ে ঝিম মেরে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এভাবে ‘বিরহী’ শিরোনামে শিল্পীর আঁকা পোর্ট্রেটের জীবন্ত মূর্তি ফুটিয়ে তুলি প্রতিদিন। মাথা তুলে অবাক হয়ে দেখি, শিমুল, জারুল কিংবা পলাশের শরীর বেয়ে উপরে উঠে গেছে মাধবী লতার ঝাঁক। ওদের মধ্যে কী মধুর সখ্যতা! যদি বৃক্ষ হতে পারতাম, লতা-গুল্ম হতাম? প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে শৈশব-কৈশোর কেটেছে বলেই পাহাড়-গাছপালা-লতাগুল্ম আমাকে অদৃশ্য হাতছানিতে কাছে টানে। সময়ে-অসময়ে আমি চলে যাই পাহাড়ে কাছাকাছি, জারুল গাছের ছায়ায়। পনেরো ধরে শহরে বসবাস করছি, চারিদিকে সবকিছুই কৃত্রিম, প্র্যাকটিক্যাল জীবনযাপন তবুও প্রকৃতির মাঝেই সুখ খুঁজে পাই আমি। জীবনের সব হিসেব-নিকাশ গরমিল হয়ে গেল। বয়স পেরিয়ে গেছে, আমি বিয়ে করিনি। আর বিয়ে করার কোন সম্ভাবনাও নেই। অবশ্য বিয়ের জন্য মায়ের চাপ-অনুরোধের অন্ত নেই। তবুও জানি, একদিন মায়ের অনুরোধেও ছেদ পড়বে, আমার পৃথিবীটা শূন্য রবে চিরদিন। সারাজীবন এক ধরনের বিচ্ছেদ বেদনা নীরবে বয়ে বেড়িয়েছেন আমার মা। হয়তো উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও তা পেলাম। বাকি জীবন নীরবে বয়ে বেড়াতে হবে এই বেদনার উত্তরাধিকার। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, মায়ের কাছে অন্তত সান্ত¡না হিসেবে আমি ছিলাম, আমার কেউ নেই, একা। বড়ই একা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×