somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শতবর্ষে বিনোদ বিহারী

১০ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়-অবিচার বাল্য বয়সেই গভীরভাবে দাগ কাটে তার হৃদয়ে। আর এ কারণে তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে যোগ দেন তৎকালীন বিপ্লবী দল যুগান্তর-এ। আর এর মাধ্যমে তিনি সংস্পর্শে আসেন চার বিপ্লবীর। এরা হলেন- মাস্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও মধুসূদন দত্ত। আর এদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শৃংখলিত ব্রিটিশ ভারত থেকে ১৮ থেকে
২২ এপ্রিল এই চার দিনের জন্য চট্টগ্রাম স্বাধীন হয়েছিল। বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর শততম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে শীর্ষ নিউজ ডটকম মুখোমুখি হয় এই বিপ্লবীর। তার এই একান্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে আসে তার দীর্ঘ শতবর্ষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা।
চট্টগ্রামের বোয়াখালীর পি.সি.সেন সারোয়াতলী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেখানে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা মাঠে ব্রিটিশ ভারত সরকারের বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়ে আলোচনা করত। বৃদ্ধ, মধ্যবয়স্ক, তরুণসহ সব বয়সের মানুষ তাতে অংশ নিত। বিনোদ বিহারীও মাঝে মাঝে যেতেন সেখানে। আর সেখান থেকে অল্প অল্প করে বিদ্রোহের বীজ দানা বাঁধে তার ভিতরে। আর এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার স্কুলের বিতর্ক প্রতিযোগিতায়।
সেই দিন এক এক করে বক্তব্য দেন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানতে চান আর কেউ বক্তব্য দিবে কি না। ঠিক এমন সময় ছোট্ট বালকটি হাত উপরে তুলে। সেই দিনের বালকটি আর অন্য কেউ না, তিনিই হলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী। সেই দিন তার পুরো ভাষণ জুড়ে ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ আর বিদ্বেষ। পুরো হলরুম প্রকম্পিত করে বাজছিল তার ভাষণ। পুরো হল জুড়ে বিরাজ করছিল পিনপতন নীরবতা।
সেই দিন হল রুমের কারো বুঝতে বাকি ছিল না এ ক্ষোভ একদিন বিদ্রোহে রূপ নিবে। ভাষণের সুবাদে পরিচয় হয়ে গেল একই স্কুলে দশম শ্রেণীর পড়া রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এর সাথে। সেই সময় রামকৃষ্ণ বিশ্বাস বিনোদ বিহারীকে কার্লমার্ক্স-এর বইসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বই পড়তে দিতেন। আর এভাবেই তার মধ্যে আস্তে আস্তে বিপ্লবের বীজ বপন হতে থাকে। আর এভাবেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে যোগ দেন তৎকালীন বিপ্লবী দল যুগান্তর-এ।
গোপনে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার পাশাপাশি পূর্ণোদ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে যান বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায় বাহাদুর বৃত্তি লাভ করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে পাঠরত অবস্থায় তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বাহিনীর সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নেন। এরপর ১৯৩০-এর ১২ এপ্রিল স্থানীয় কংগ্রেস ভবনে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে বিনোদ বিহারী অন্য চার সহযোদ্ধাসহ ১৮ এপ্রিল বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে পুলিশের অস্ত্রাগার দখলে নেন।
এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষ। অস্ত্রাগার দখল করে তারা ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পতাকা উত্তোলন করেন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী গণতন্ত্রী বিপ্লবী সরকারের ঘোষণা দেন। আর এর পরেই একই দিনে পৃথক পৃথকভাবে ফৌজি অস্ত্রাগার, টেলিফোন ভবন, টেলিগ্রাফ অফিস দখলে নেয় বিদ্রোহীরা। এরপরে লাঙ্গলকোট ও ধুম স্টেশনের রেল লাইন উৎপাটন করে চট্টগ্রামের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আর এভাবে ১৮ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারত থেকে চার দিনের জন্য স্বাধীন হয় চট্টগ্রাম।
১৯৩০-এর ২২ এপ্রিল বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে বিদ্রোহীদের চলে সম্মুখ যুদ্ধ। যেটা ইতিহাসে জালালাবাদ যুদ্ধ নামে স্থান করে নিয়েছে। কর্নেল ডেলার স্মিথ ও ক্যাপ্টেন টেইনট-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর তিন শতাধিক সৈন্য সাধারণতন্ত্র বাহিনীর ৫৪ জন সদস্যের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। এ যুদ্ধে বিপ্লবী দলের ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন লোকনাথ বল। যুদ্ধে ১২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হন। আহতদের একজন ছিলেন বিনোদ বিহারী।
সেই যুদ্ধে গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি, তবে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। এরপর তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হন বিনোদ বিহারী এবং ১৯৩৪ সালে জেলে থাকা অবস্থায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ইংরেজিতে এম.এ. ও বি.এল. পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ৪১ সাল থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত তাকে আবার জেলে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। সেই থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ যুক্ত নির্বাচনের আন্দোলনেও বিনোদ বিহারী সোচ্চার ছিলেন। এরপরে তিনি ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতি বিনোদ বিহারী চৌধুরীর যে গভীর ভালোবাসা তারই স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশের নানা প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মানিত করেছে। দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদকেও ভূষিত করা হয়েছে তাকে।
কিন্তু বিপ্লবী বিনোদ বিহারী মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যে মুক্তির জন্য সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন সেই মুক্তি এসেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না সেই মুক্তি বাংলার জনগণ এখনো পায়নি। তবে যে মুক্তির জন্য তিনি সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন বাংলার মানুষ একদিন সেই মুক্তি লাভ করবে সে বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×