somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাপগল্প: হলদে আগুন মেয়ে

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় এম এ আজিজ ষ্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের ফুটপাথে।রাত দশটায়।হপ্তাখানেক আগে।

পুরো দিনটায় বিষণ্ণ ছিলো আমার জন্যে।যাপিত জীবনের কষ্টমাখা নষ্টালজিয়ায় ভুগে শেষ বিকেলের রোদে বেরিয়ে পড়লাম আবাসিক খাঁচার দরোজায় তালা মেরে।শীতের রোদ।তার উপর শেষ বিকেল।ওম ছিলো।কিন্তু তপ্ত রোদে হাঁটার অভ্যেসে অভ্যস্থ আমার প্রশান্তি ছিলো না।
মুঠোফোন টা বারবার জিন্স থেকে হাত-হাত থেকে জিন্সে ঘুরছিলো শুধু।বোকার মত এখনো মুখস্থ এগারোটি সংখ্যায় জানান দিতে ইচ্ছে করে,আমি রোদে রোদে ঘুরছি।জানি,তা আর সম্ভবপর নয়।সংখ্যাগুলো বোবা।সংখ্যার ওপাশে এখন আর কেউ অপেক্ষা করে না।
সিগারেটের প্যাকেটে রয়ে যাওয়া ছয়টা শলাকা আর ফুরিয়ে আসা দেশলাইয়ের কাঠিগুলো সম্বল করে হাঁটা ধরলাম আনমনে।পুরুষতান্ত্রিক চোখে কলেজ ফেরত মেয়েদের মুখশ্রী-দেহশ্রী,নিমগ্ন কুকুরের ডাস্টবিনে খাবার অনুসন্ধানের মোহ আর পথশিশুদের কলহের উত্তেজনা গায়ে মেখে মেখে পথচলা।সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁকে সূর্যদেব কখন প্রয়াত হলেন তা আর বোঝা গেলো না শহুরে আলোময়তার চক্রান্তে!
গোধূলীর বিদায়টা যা কিছুটা দৃশ্যমান ছিলো সেন্ট মেরীর গির্জার দেয়ালে।কোলাহল মুখর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনি'র আঙিনা পেরিয়ে সেঁধিয়ে যাই হঠাৎ পুষ্প কাননের আড্ডায়।বসতে না বসতেই হাতে চায়ের গেলাস আর সিগারেট! ঘন্টা দুয়েক পরে তসলিমা যে নারী স্বাধীনতার অপব্যাখ্যা মানেন,নাহিদ জটিল কাজ দেখিয়েছেন,যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করলে সরকারের খবর আছে,জাকির নায়েক হাস্যকর মানুষ,বারাক ওবামা শান্তিপুরষ্কার পাবার মত কিছু করেন নি তেমন ইত্যাদি ব্যপারে একমত দ্বিমত হয়ে পা বাড়াই সম্মুখ সড়কে।
মানিব্যাগের চিপায় দুইটাকার একমাত্র নোট টি দেখে নজরুল স্কয়ারের কোণার ষ্টল হতে এক কাপ চা খাওয়ার মত পাল্টালাম।নিঃস্ব হয়ে পথ হাঁটার সুখে বিষণ্ণতা হালকা হয়ে যাচ্ছিলো।সিকিউরিটি মানি হিসেবে রাখা পাঁচশ' টাকার নোট টির কথা ইচ্ছে করেই ভুলে থাকি।মোহগ্রস্থ হয়ে প্রিয়কারো পাশে বসে কপর্দকহীন পৌঁছে গিয়েছিলাম একবার রাজধানীতে।ধার করে পরে ফিরে আসার লজ্জায় আর সেই প্রিয় কারোর ধমক-উপদেশ বশবর্তী হয়ে নোট টিকে মানিব্যাগে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দী করে ফেলেছিলাম।এখন অবশ্য আর সিকিউরিটি মানির দরকার নেই।
অলি গলি ঘুরে শেষে দাঁড়ালাম এম এ আজিজের পুব পাশে।রাত দশটার অন্ধকার কিছুটা জমাট বেঁধেছিলো।দাঁড়িয়ে যান্ত্রিক সাঁই সাঁই ছুটে চলা দেখছি।কিছুটা ঘোরে থাকায় চমকে উঠেছিলাম শব্দ দুটোয়।
"কত দেবেন?"

তাকিয়ে দেখি শব্দদ্বয় নিক্ষেপ করে প্রত্যুত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে একটা মেয়ে।বয়স বিশের নিচেই হবে।সাধাসিধে সালোয়ার কামিজ ওড়না।পায়ে সস্তা স্যান্ডেল।বোধহয়,হকার্সের ফুটপাথ হতে কেনা।মুখশ্রী বোঝার মত পর্যাপ্ত আলো নেই।
"কত দেব মানে!!" আমার গলায় অবাক সুর।
"আমারে নিলে একশ টেকা দিলেই অইব।"
"আমি তোমাকে কোথায় নেব!!আর আমার কাছে টাকাও নেই।"

মেয়ে টা কথা বলে না আর।সরে গিয়ে রাস্তার মুখোমুখি দাঁড়ায়।একবার ফিরেও চায়।
বুঝতে পারি,সভ্য সমাজের গোলটেবিলের সমবেদনা-লুকিয়ে রাখা ঘৃণা আর অন্ধকারের নির্যাতিতাদের একজন।
মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।ফিরে চায় সে।চোখে উপহাস?মনে হয়।সাথে বোধহয় বিদ্রুপও আছে!

"একশ টাকা দেব তোমাকে।"অনুচ্চ কন্ঠে বলি।
"আপনের কাছে ত টেকা নাই।টেকা ছাড়া কাম অইব না।"
"টাকা আছে।"
"আপনের জায়গায় যাইতে হইলে রিকশা নিতে অইব।ভাড়া আপনের।"
"আমার কোন জায়গা নেই।"
"আমার বাসায় যাইবেন?"
"যাবো।"
"আসেন আমার লগে।"

মেয়েটা হাঁটা শুরু করে।আমি তাকে অনুসরণ করি।চুপচাপ।
আলো এড়িয়ে এড়িয়ে মেয়েটা ঢুকে পড়ে কানা গলিতে।পাশাপাশি দু'জন হাঁটতে গেলে গায়ে গায়ে লেগে যায়।কিছু টা সরে হাঁটি।
মেয়েটা বিদ্রুপের হাসি হাসে।
"একটু পরে আমারে নিয়া শুইবেন।এহন গায়ে লাগলে ঘেন্না করতাছেন ক্যান?"

মেয়েটার হাসি থামে না।হাসি টা চেনা মনে হচ্ছে।বিগত সময়ের অনেকগুলো রাতের দুপুর সময়ে বুকের উপর যে হাসি টা শুনতাম,অনেকটা সেরকম।
কামিজ টা তুলে কোমর থেকে চাবি খসিয়ে মেয়েটা যে ঘরটা খোলে তার সাথে সৌখিন মানুষ দের পোষা কবুতরের ঘরের মিল আছে।
ঘরে দেয়াল ঘেঁষে একটা সস্তা খাট।বিছানায় ফুলতোলা চাদর।জোড়া বালিশ।কভারে সুতোয় বোনা..""যাও পাখি বল তারে,সে যেন ভুলে না মোরে.।""
আমি অবাক হই।যাক,মেয়েটার তাহলে স্বপ্ন আছে! স্বপ্ন যেন তাকে ভুলে না যায় সে আকুতি ও আছে!!

লালচে আলোয় মেয়েটা কে দেখি।বুকের উপর থেকে একটানে ফেলে দেয়া ওড়নার উপর পা তুলে বসা মেয়েটার মুখে হলুদাভ একটা আভা আছে!!
নাতিদীর্ঘ চুলের সাথে রঙ মিলিয়ে চোখ আর নাকে চিকচিক ঘাম হয়তো একটা প্রেম প্রেম ভাবের সৃষ্টি করতে পারত,যদি না পাতলা ঠোঁটে বিচ্ছিরি লাল লিপিষ্টিক না থাকতো!

"লিপিষ্টিক টা মুছে ফেলো।বমি পাচ্ছে।"

খিলখিল হাসি হেসে মেয়েটা কামিজের কোণায় মুছে ফেলে।তলপেট টা দৃশ্যমান হয়।মসৃন।আমার দৃষ্টির গন্তব্য বুঝে হাসির বেগ বাড়ে তার।

"আসেন।তাকাই রইছেন ক্যান?গায়ে হাত দেন।মজা লন।নাকি ঘেন্না লাগতাছে?"
আমি পাশে বসি।কামিজ টাকে উল্টিয়ে খুলতে যায় সে।হাত ধরে থামিয়ে দেই।
"নাম কি তোমার?" আমি প্রশ্ন করি।
"নাম দিয়া কি করবেন?কোন ধর্মের জানবার চান?আমাগো কোন ধর্ম নাই।আপনে টেকা দিবেন।মজা লইবেন।কথা কইলে ত আর টেকা দিবেন না।"
"দেব।"
কত দিবেন?" মেয়েটা হাসে।
"ওড়না টা গায়ে জড়াও।" সে জড়ায়।
"কি নাম তোমার?"
"একসময় নাম ছিলো।এহন নাই।" হাসে সে।কিন্তু হাসির ভেতর একটা কান্না প্রকট হয়ে উঠে।
"আপনে একখান নাম দ্যান।" হাসে সে।
"আমি কি নাম দেব?"
"দ্যান যা খুশি।"

আমার মনে হয়,মেয়েটার নাম হওয়া উচিৎ জ্যোতি।মেয়েটার মুখে একটা হলদে জ্যোতি ভাব আছে।অনেকটা গায়ে হলুদের ষ্টেজে গোসল শেষে বসে থাকা কনের মত।এই মেয়েটার কি বিয়ে হবে?মনে হয় না।এদের কেউ বিয়ে করে না।টাকার বিনিময়ে কিছুক্ষণ স্বামী সাজে শুধু।বিয়ে হলে মেয়েটার কোন হলুদ কিনতে হতো না।

"জ্যোতি?"
"আচ্ছা।" সে মেনে নেয়।
"এটা কেন লিখেছো?" বালিশ টা দেখাই তাকে।
"এমনি।আগে লিখছিলাম।শখ কইরা।এহন শখ আর নাই।" জ্যোতি এবার আর হাসে না।
"কেন?কি হয়েছে শখের?"
"সেটা আপনের জাননের কি কাম?এত কথা জিগান ক্যান?"
"তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?"
"রাগবো না?আপনের কাছে টেকা নাই।সেটা কইলেই অইতো।আমার টাইম লস করতাছেন।" সে রাগী গলায় বলে।
"টাকা নাই তুমি কিভাবে বুঝলে?"
"থাকলে এত কথা কইতেন না।বেবাকতের মত আমার সালোয়ার কামিজ ধইরা টানাটানি শুরু কইরা দিতেন।"
"আমি টাকা দেব।তুমি কথা বলো।টানাটানি পরে করা যাবে।"
"শুনেন।আমি আমার কথা কাওরে বলিনা।আপনে বিছানায় আসেন।মজা নেন।টেকা লাগব না।নাকি ঘেন্না করতাছেন?" জ্যোতি আবার হাসে।
"না।ঘেন্না লাগছে না।অবাক লাগছে।তোমার মত এত সুন্দর একটা মেয়ে এ পথে কেন?"
"অবাক লাগনের কি আছে?আমি খারাপ মাইয়া।আমাগো জন্মে দোষ আছে।" হাসি মুছে যায় জ্যোতির।চোখে একটা কষ্ট ফুটে উঠে।
"জ্যোতি,মিথ্যে বলছো কেন?তোমার চোখ বলছে,তোমার কষ্ট আছে।আমাকে কষ্টের কথাগুলো বলো।" আমি হাত ধরি তার।

জ্যোতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলা শুরু করে।





{দ্বিতীয় কিস্তিতে সমাপ্য।}
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১১:৫১
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×