somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুন্যের গর্ভে- দ্বিতীয় পর্ব

২৯ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করেছি হোস্টেলের অন্য সবার থেকে কেন জানি আমার সাথে তার ব্যাবহার একটু অন্য রকম। বয়সে তার থেকে আমি একটু ছোট হলেও সে আমার মতামতের যথেষ্ট মুল্যায়ন করত। মাঝে মাঝে আমার রুমে এসে গল্প করত ( গল্প করত না বলে বসে থাকত বলাই শ্রেয়)। কার্ড খেলায় আমি যখন বেশী হেরে যেতাম তখন সে ইচ্ছে করে তার কার্ড খারাপ বলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে বোর্ড পাইয়ে দিত বা সুযোগ দিত। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি একদিন কৌতুহল বশত তার ছুড়ে ফেলা কার্ড উল্টিয়ে দেখলাম যথেষ্ট ভাল কার্ড থাকা সত্বেও সে কল দেয়নি। পরে তাকে এর কারন জিজ্ঞেস করাতে লাজুকভাবে হেসে বলেছিল ’এই..এমনিই’ ।
যদিও আমার প্রতি তার যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল ,তবে যেটাকে সে সহযোগীতা বলে ভেবেছিল সেটাই ছিল আমার মনকষ্টের কারন- কেননা সেটা ছিল আমার খেলোয়াড়ী ব্যক্তিত্বের প্রতি আঘাত - আমি অপমানিত বোধ করেছিলাম।তখনো পর্যন্ত নিজেকে আমি বেশ উচুঁমানের খেলোয়ার মনে করতাম!
দিনের বেলায় আমরা সবাই ক্যান্টিনে বা রেস্টুরেন্টে খেতাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অথবা ছুটির দিনে আমরা সবাই মিলে একসাথে রান্না করতাম ।
সবাইকে তার যোগ্যতা অনুসারে আলাদা আলাদা কাজ দেয়া হত। প্রত্যেকেই অতি উৎসাহের সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করত। আনাড়ী হাতে মসলা বিহীন সে রান্না কতটুকু স্বুসাদু জানিনা তবে তা উপভোগ করতাম।একমাত্র তন্ময় সর্বদা সচেষ্ট থাকত কাজে ফাঁকি দেয়ার। রান্নার ঐ সময়টুকু সে হয় ঘুমিয়ে কাটাত কিংবা অসুখের ভান করত নয়তো জরুরী কাজের ছুতো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেত। স্বভাবতই; সেজন্য সবাই তার প্রতি নাখোশ ছিল!
মাঝে মাঝে সবার চাপের মুখেই সে কাজ করতে বাধ্য হত। কিন্তু কাজের প্রতি তার অমনোযোগ আর আনাড়ীপনা দেখে তারাই আবার তাকে ক্ষান্ত করত ।
ক্যান্টিনের রাশান কুকের হাতে তৈরি খাবার এতই জঘন্য ছিল যে, সারাদিনের বিস্বাদ হয়ে যাওয়া জিহ্বা টাকে স্বস্তি দেয়ার জন্য সন্ধ্যার পরে উঠেপড়ে লাগতাম। প্রতি সন্ধ্যায় বাজার থেকে দু-চারখানা মুরগী কিনে একসাথে ক্যাপসিকাম, পিয়াজ , রশুন আর বাটার দিয়ে ভাজা ভাজা করে পাউরুটি খেতে তখন দারুন স্বুসাদু লাগত।
আমরা যখন সবাই মিলে এককন্ঠে ওদেশী খাবারের চৌদ্দগুস্টি উদ্ধার করতাম, তন্ময় তখন একাগ্রনিষ্ঠ শ্রোতার মত চুপচাপ শুনে যেত কোন মন্তব্য করত না! মাঝে মধ্যে তাকে কমেন্টস করার জন্য জোড়াজুড়ি করলে -বাধ্য হয়েই হয়তোবা বিব্রত মুখে লাজুক হেসে বলত ‘ভালইতো- আমারতো সমস্যা হয়না’।
আমাদের সহপাঠী তন্ময়ের সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ 'হুজুর'(একজন লোককেই সে ভীষন অপছন্দ করত- এটা সে খোলাখুলি বলত) আড়ালে বাগধারার উদ্ধৃতি দিয়ে বলত ‘ও একটা ছাগল।’ তবে এ কথাটা সামনা সামনি বলার দুঃসাহস তার কোন দিনই হয়নি । যদিও দেশী খাবারের প্রতি তার লোভ ছিল অপরিসীম তবুও সে যে কোন বিস্বাদ খাবার খেতে পারত ।
আমার সাথে একটু সম্পর্ক ভালো হওয়ার পর তাকে প্রায়শই দেখতাম আমার অনুপস্থিতিতে আমার বিছানায় এসে শুয়ে থাকতে। প্রথমে ভালো না লাগলেও একসময় তা মেনে নিলাম।
মনে হয় তার নিজের বিছানা থেকে আমার বিছানাই তার বেশী প্রিয় ছিল।
বন্ধুত্ব যখন আরো গাঢ় হল তখন সে আমার পোশাক আশাক ব্যাবহার শুরু করল , যখন ইচ্ছে আমার শার্ট, জ্যাকেট, টুপি, দস্তানা এমনকি ট্রাওজার পর্যন্ত যেটা খুশি সেটা নিজের ভেবে ব্যবহার করত। প্রথম প্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করত; কিন্তু কয়েকদিন বাদেই আর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করল না।
আমার রুমমেটদের কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগত না। তারা আমার শুভাকাঙ্খী সেজে প্রায়শই নিষেধ করত তাকে এতটা প্রশ্রয় দেয়ার জন্য। প্রতিউত্তরে আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম। তন্ময়কে নিষেধ তো করতামই না বরং আরো বেশী বেশী অনুরোধ করতাম তার যখন যেটা প্রয়োজন সেটা যেন দ্বীধা না করে আমাকে সরাসরি বলে।
তারা হয়তো কিছুটা ইর্শান্বিত ছিল তন্ময় ও আমার গভীর বন্ধুত্বের জন্য।..

..গত ছয় মাসে একটাও চিঠি আসেনি তার নামে। সেও কাউকে লেখেনি।
এমনিতেই অথবা বিভিন্ন পার্বনে সবাই যখন তাদের প্রিয়জনের চিঠি নিয়ে উৎফুল্ল থাকত। তন্ময়কে দেখতাম এককোনে বিমর্ষ বদনে বসে আছে। অনেকেই আফসোস করত আহারে বেচারার মনে হয়ত চিঠি লেখার মত তেমন আপনজন কেউ নাই।
আমার কোন চিঠি আসলে বিশেষ করে সেটা যদি আমার প্রেমিকার লেখা হত –তাকে বলতেই সেও যেন ঠিক আমারই মত খুশী হত ,যদিও নিজের মনের ভাব সে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারত না - কিন্তু তার আন্তরিক উপলদ্ধি চাপা থাকত না ।
রাস্তার পাশের কোন ফোন বুথ থেকে তখন দেশে টেলিফোন করার উপায় ছিল না। এক্সচেঞ্জে গিয়ে অপারেটরের কাছ কাঙ্খিত নাম্বার ধরিয়ে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হোত (ভাগ্য সু-প্রসন্ন হলে , কখনওবা একটা ফোন লাইন পেতে সপ্তাহ পেরিয়ে যেত)। মাঝে মধ্যে দলবেধে আমরা যেতাম ফোন করতে। সবাই একসাথে নাম্বার লিখে দিয়ে অপেক্ষার সাথে চলত গল্প গুজব। যে প্রথম লাইন পেত তাকে নিয়ে শুরু হত ভিন্ন ধরনের মজা সেই সাথে বর্ষন চলত কটু বাক্যের - মুলত এর সবই হোত ইর্ষা থেকে। যেন সে আগে লাইন পেয়ে জঘন্য কোন অপরাধ করে ফেলেছে। কথা বলতে নির্দিস্ট ফোন বুথে ঢুকলেই সবাই বিভিন্ন ফাঁক গলে আড়ি পেতে শুনতে চাইতাম তার কথপোকথন।
বাপ মা হলে তবু রক্ষে - বান্ধবী হলে খবর ছিল! দু-চারটা শব্দ কোন মতে কানে এলেই হয়েছে -সপ্তা খানেক তার ঘুম হারাম! দেশে প্রিয়জনের সাথে কথা শেষে সবাই যখন ছল ছল চোখে বেরিয়ে আসত,বিচ্ছেদের বেদনা না-বলা কথা আর ভালবাসার আবেশ কিছুক্ষনের জন্য বিহ্বল করে দিত সবাইকে - চেহারায় তখন আনন্দ আর বেদনার পার্থক্য বোঝা যেত না। উচ্ছল পরিবেশটা কিছুক্ষনের জন্য ভয়ানক থমকে যেত। ফোন রিং বেজে উঠলেই সবাই একসাথে সচকিত হয়ে তাকাত অপারেটরের দিকে– যার ডাক আসত সে অপরাধী মুখে অন্তরের আনন্দকে চেপে রেখে ফোন বুথের দিকে হেটে যেত –তখুনি ফের শুরু হোত সবার সেই উৎপাত!
তন্ময়ও মাঝে মধ্যে যেত আমাদের সঙ্গে তবে কখনই ফোন করত না। সে ফোন করতে যেত একাকী নিঃশব্দে কাউকে না জানিয়ে... দ্বতিয় পর্ব শেষ

আগের পর্বের জন্য; Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৩৩
২৫টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আল্লাহর সাহায্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪০



দুই মেয়ের পরীক্ষা বিধায় আমার স্ত্রীকে লক্ষ্মীপুর রেখে আসতে গিয়েছিলাম। বরিশাল-মজুচৌধুরীর হাট রুটে আমার স্ত্রী যাবে না বলে বেঁকে বসলো। বাধ্য হয়ে চাঁদপুর রুটে যাত্রা ঠিক করলাম। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডয়েজ ভেলে'র প্রকাশিত এই প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ উদ্বেগজনক

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন বাহিনী থেকে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকান্ডে যুক্ত সৈনিকদের ইউ.এন. এর পিস কিপিং মিশনে পাঠানোর বিষয়ে ইউ.এন. এর কর্মকর্তাগণ বেশ উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে ডয়েচ ভেলে ক'দিন আগেই একটি প্রামাণ্যচিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুলের চিন্তার কাবা প্রাচ্য নাকি পাশ্চাত্য?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:০৫


কাজী নজরুলের বড় বিপত্তি তিনি, না গোঁড়া ধর্মীয় লোকের কবি আর অতিমাত্রায় বামের কবি, না হোদাই প্রগতিশীলের কবি। তিনি সরাসরি মধ্যপন্থীর। অনেককেই দেখি নজরুলের কিছু কথা উল্লেখ করে বলেন কাফের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় রিমাল সর্তকতা।

লিখেছেন কাল্পনিক_ভালোবাসা, ২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩

প্রিয় ব্লগারবৃন্দ,
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর ব্লগারদের কাছে যদি স্থানীয় ঝড়ের অবস্থা এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে চিরতরে যুদ্ধ বন্ধের একটা সুযোগ এসেছিল!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩


মনে হয় শুধু মানুষের কল্পনাতেই এমন প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন সম্ভব- যদি বাস্তবে হত তবে কেমন হত ভাবুন তো?
প্রত্যেকটি দেশের সমস্ত রকমের সৈন্যদল ভেঙে দেওয়া; সমস্ত অস্ত্র এবং সমর-সম্ভার, দুর্গ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×