“বৃষ্টির ভিতর একদিন জেগে উঠবে ইরাক!” সেই ১৯৫০ সালেই চিৎকার করে উঠেছিলেন ইরাকি কবি বদর শাকির আল-সাঈয়াব (১৯২৬-১৯৬৪); যাকে আধুনিক আরবি কবিতার জীবনানন্দ হিসেবে গন্য করা যায়। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী কবিতাসমূহ আধুনিক আরবি কাব্যের ধারা আমূল পালটে দিয়েছিল। ছন্দের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার নিমিত্তে চল্লিশের দশকের শেষের দিকে সাঈয়াব তাঁর কাব্যসতীর্থদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ফ্রি ভার্স আন্দোলন । কবিতায় নিপুন কৌশলে ব্যবহার করেছেন মিথ - ‘বৃষ্টির গান’ সেই বিস্ময়কর সাক্ষ্য বহন করছে । সাঈয়াব এর আরেকটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সমাজবাস্তবতা। দারিদ্রক্লিস্ট ইরাকের জরাজীর্ণ প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়-যা তাকে উন্নীত করেছে একজন সৎ ও প্রত্যক্ষদর্শী এশিয় কবি হিসেবে।
‘বৃষ্টির গান’
তোমার ও দুটি চোখ যেন ঊষার আলোয় পামের দুটি বন
কিংবা জোছনায় ঝলমলে দুটি ব্যালকনি;
যখন তারা হাসে, তোমার দুটি চোখ, কুঞ্জেবনে দুলে ওঠে পত্রালি,
এবং নদীতে চাঁদের মতন নৃত্যরত হয়ে ওঠে আলোরা
প্রভাতের বৈঠার মৃদু আঘাত তরঙ্গের
যেনবা নক্ষত্ররা নিজস্ব গভীরতায় স্পন্দনশীল।
তোমার ও দুটি চোখ যেন আলোক-ভেদ্য দুঃখার্ত কুয়াশায় নিমজ্জ্বিত;
যেনবা রাত্রির কষাঘাতে পড়েছে সমুদ্র;
এখানে রয়েছে বসন্তের কাঁপুনি আর শীতের উষ্ণতা
এবং জন্ম ও মৃত্যু, আলো ও অন্ধকার;
চিরকালীন কান্না কাঁপে আমার আত্বায়
আর চাঁদ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা শিশুর মতন
সমস্ত আকাশজুড়ে বন্য অনুপ্রেরণা ।
যেন কুয়াশার তোরণ পান করছে মেঘেরা
তারপর বিন্দু বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে...
যেন উদ্যানে কলতানরত শিশু সব ।
বৃষ্টির গান।
গাছের পাখিদের নীরবতার মৃদু খসখসানি।
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
বৃষ্টি পড়ে।
সব কিছু হাই তুলছে, নিচের মেঘ থেকে
ভারী কান্নার অবিরাম পতন।
যেমন ঘুমের আগে শিশুর কান্না
ওর মা সর্ম্পকে ( এক বছর আগে সে তার মাকে জাগাতে গিয়েছিল, পায়নি মাকে,
ওকে বলা হয়েছিল, কেননা সে জিজ্ঞেস করছিল,
আগামী পরশু তোমার মা ফিরে আসবে
তোমার মাকে যে ফিরে আসতেই হবে,
যদিও ওর খেলার সাথীরা ফিসফিস করত ঐ যে মা
পাহাড়ের দিকে, চিরদিনের জন্য শায়িত,
চারপাশের মাটি খাচ্ছে, পান করছে বৃষ্টিজল;
যেন নিঃসহায় জেলে গুটিয়ে নিচ্ছে তার জাল
দুষছে জল ও ভাগ্যকে
আর অস্তগামী চাঁদের আলোয় গাইছে গান।
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
তুমি কি জান বৃষ্টিরা কী দুঃখ বয়ে আনতে পারে?
তুমি কি জান কীভাবে নদীনালা কাঁদে যখন ঝরে অবিরল জল?
তুমি কি জান বৃষ্টির ভিতর দাঁড়িয়ে একজন নিঃসঙ্গ মানুষের কীরকম অনুভূতি হয়?
অশেষ, ভাঙা রক্তের মতো, ক্ষুধার্ত জনগন, প্রেমের মতন,
শিশুদের মতন, মৃতের মতন, অশেষ বৃষ্টি,
তোমার ও দুটি চোখ আমাকে নিয়ে যায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ভিতর
ঝিনুক ও নক্ষত্রসহ পারস্য উপসাগরের বজ্রপাত
আছড়ে পড়ে ইরাকের উপকূলে।
যেনবা ওসব থেকে খুলে যাবে একটি ভোর, অথচ রাত্রি ওসবের ওপর
বিছিয়ে দিয়েছে তার রক্তভেজা চাদর । উপসাগরের প্রতি আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি: ‘ওহ্, উপসাগর
মুক্তা, ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত!’
আর প্রতিধ্বনি উত্তর দিল
যেনবা হাহাকার:
‘ওহ্, উপসাগর,
ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত’।
আমি যেন শুনতে পাচ্ছি ইরাক কর্ষন করছে বজ্র
মজুদ করছে বিদ্যুৎ পাহাড়ে সমতলে,
যদি সীলমোহর ভেঙ্গে ফেলে লোকে
লুপ্ত সামুদ জাতির মতো বাতাস উপত্যকা করে ত্যাগ ।
আমি যেন শুনতে পাচ্ছি পাম গাছেরা পান করছে বৃষ্টি,
শোনো, একটি শোকার্ত গ্রাম আর তার অধিবাসীদের হাহাকার
উপসাগরে দাঁড় ও পালের সংগ্রামে
ঝড়ো বাতাস আর বজ্রপাত,,,গাইছে
বৃষ্টি বৃষ্টি
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
আর ইরাকে ক্ষুধা ...
এখানে ফসল কাটার মরশুমে সমস্ত শষ্যাদি পড়ে ছড়িয়ে
গোগ্রাসে সেসব গেলে কাক ও পঙ্গপালের দল
শস্যভান্ডার ও পাথরের যাঁতা ঘোরে বারবার
মানুষসহ গমের কল ফসলের মাঠে হয় রুপান্তরিত
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
বৃষ্টি পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়
চলে যাওয়ার সময় কত কান্না আমরা কেঁদেছি রাতে
বৃষ্টির দোহাই দিই আমরা, দোষ না পড়ার কথা ভাবি
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
শিশুকাল থেকেই, আকাশ
শীতকালে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকত
আর বৃষ্টি ঝরত,
আর প্রতি বছর পৃথিবী সবুজ হয়ে উঠলে আমরা ক্ষুধা বোধ করতাম
ক্ষুধা ছাড়া ইরাকের একটি বছরও কাটত না।
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
ফুলের বীজ থেকে হলুদ কিংবা লাল রঙের কুঁড়ি বেরোত।
ক্ষুধার্ত আর নগ্ন মানুষেরা কাঁদত
আর রক্ত ঝরত দাসের
হাসত নতুন ভোরের প্রতি চেয়ে ।
নবজাতকের ঠোঁটে গোলাপি স্তনবৃন্ত
আগামী নতুন বিশ্বের, নতুন জীবনের যাত্রী ...
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
বৃষ্টির ভিতর একদিন জেগে উঠবে ইরাক!
আমি উপসাগরের প্রতি চিৎকার করে কেঁদে উঠি: ‘ওহ্, উপসাগর
মুক্তা, ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত’
আর প্রতিধ্বনিত হল
যেনবা হাহাকার:
‘ওহ্, উপসাগর,
ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত’।
এবং উপসাগরের পর্যাপ্ত উপহার উপকূলের বালির ওপর
ছড়ায় ফেনা ও ঝিনুক
আর ডুবে যাওয়া অভিবাসীর কঙ্কাল
যারা চিরদিনের জন্য মৃত্যু পান করেছিল
উপসাগরের অতল হতে, এর স্তব্দতা থেকে,
আর অজস্র সরীসৃপ ইরাকে পান করে নির্যাস
একটি ফুল থেকে ফোরাত নদী লাভ করে শিশিরের পুষ্টি ...
আমি প্রতিধ্বনি শুনি
উপসাগর থেকে ভেসে আসছে :
বৃষ্টি
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি
বৃষ্টির প্রতি ফোঁটায়
ফুলের বীজ থেকে বেরোত হলুদ কিংবা লাল রঙের কুঁড়ি ।
আর নগ্ন ক্ষুধার্ত মানুষেরা সব কাঁদত
আর রক্ত ঝরত দাসের
নতুন ভোরের প্রতি চেয়ে হাসত ।
নবজাতকের ঠোঁটে গোলাপি স্তনবৃন্ত
আগামী নতুন বিশ্ব, জীবনের যাত্রী!
আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ: লেনা জাঈয়ূসি এবং খ্রিস্টফার মিডলটন।