somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃষ্টির গান: ইরাকি কবি বদর শাকির আল-সাঈয়াব এর একটি কবিতা

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“বৃষ্টির ভিতর একদিন জেগে উঠবে ইরাক!” সেই ১৯৫০ সালেই চিৎকার করে উঠেছিলেন ইরাকি কবি বদর শাকির আল-সাঈয়াব (১৯২৬-১৯৬৪); যাকে আধুনিক আরবি কবিতার জীবনানন্দ হিসেবে গন্য করা যায়। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী কবিতাসমূহ আধুনিক আরবি কাব্যের ধারা আমূল পালটে দিয়েছিল। ছন্দের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার নিমিত্তে চল্লিশের দশকের শেষের দিকে সাঈয়াব তাঁর কাব্যসতীর্থদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ফ্রি ভার্স আন্দোলন । কবিতায় নিপুন কৌশলে ব্যবহার করেছেন মিথ - ‘বৃষ্টির গান’ সেই বিস্ময়কর সাক্ষ্য বহন করছে । সাঈয়াব এর আরেকটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সমাজবাস্তবতা। দারিদ্রক্লিস্ট ইরাকের জরাজীর্ণ প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়-যা তাকে উন্নীত করেছে একজন সৎ ও প্রত্যক্ষদর্শী এশিয় কবি হিসেবে।

‘বৃষ্টির গান’

তোমার ও দুটি চোখ যেন ঊষার আলোয় পামের দুটি বন
কিংবা জোছনায় ঝলমলে দুটি ব্যালকনি;
যখন তারা হাসে, তোমার দুটি চোখ, কুঞ্জেবনে দুলে ওঠে পত্রালি,
এবং নদীতে চাঁদের মতন নৃত্যরত হয়ে ওঠে আলোরা
প্রভাতের বৈঠার মৃদু আঘাত তরঙ্গের
যেনবা নক্ষত্ররা নিজস্ব গভীরতায় স্পন্দনশীল।

তোমার ও দুটি চোখ যেন আলোক-ভেদ্য দুঃখার্ত কুয়াশায় নিমজ্জ্বিত;
যেনবা রাত্রির কষাঘাতে পড়েছে সমুদ্র;

এখানে রয়েছে বসন্তের কাঁপুনি আর শীতের উষ্ণতা
এবং জন্ম ও মৃত্যু, আলো ও অন্ধকার;
চিরকালীন কান্না কাঁপে আমার আত্বায়
আর চাঁদ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা শিশুর মতন
সমস্ত আকাশজুড়ে বন্য অনুপ্রেরণা ।

যেন কুয়াশার তোরণ পান করছে মেঘেরা
তারপর বিন্দু বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে...
যেন উদ্যানে কলতানরত শিশু সব ।

বৃষ্টির গান।
গাছের পাখিদের নীরবতার মৃদু খসখসানি।
টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

বৃষ্টি পড়ে।
সব কিছু হাই তুলছে, নিচের মেঘ থেকে
ভারী কান্নার অবিরাম পতন।
যেমন ঘুমের আগে শিশুর কান্না

ওর মা সর্ম্পকে ( এক বছর আগে সে তার মাকে জাগাতে গিয়েছিল, পায়নি মাকে,
ওকে বলা হয়েছিল, কেননা সে জিজ্ঞেস করছিল,
আগামী পরশু তোমার মা ফিরে আসবে
তোমার মাকে যে ফিরে আসতেই হবে,
যদিও ওর খেলার সাথীরা ফিসফিস করত ঐ যে মা
পাহাড়ের দিকে, চিরদিনের জন্য শায়িত,
চারপাশের মাটি খাচ্ছে, পান করছে বৃষ্টিজল;
যেন নিঃসহায় জেলে গুটিয়ে নিচ্ছে তার জাল
দুষছে জল ও ভাগ্যকে
আর অস্তগামী চাঁদের আলোয় গাইছে গান।

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

তুমি কি জান বৃষ্টিরা কী দুঃখ বয়ে আনতে পারে?
তুমি কি জান কীভাবে নদীনালা কাঁদে যখন ঝরে অবিরল জল?
তুমি কি জান বৃষ্টির ভিতর দাঁড়িয়ে একজন নিঃসঙ্গ মানুষের কীরকম অনুভূতি হয়?
অশেষ, ভাঙা রক্তের মতো, ক্ষুধার্ত জনগন, প্রেমের মতন,
শিশুদের মতন, মৃতের মতন, অশেষ বৃষ্টি,

তোমার ও দুটি চোখ আমাকে নিয়ে যায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ভিতর

ঝিনুক ও নক্ষত্রসহ পারস্য উপসাগরের বজ্রপাত
আছড়ে পড়ে ইরাকের উপকূলে।
যেনবা ওসব থেকে খুলে যাবে একটি ভোর, অথচ রাত্রি ওসবের ওপর
বিছিয়ে দিয়েছে তার রক্তভেজা চাদর । উপসাগরের প্রতি আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি: ‘ওহ্, উপসাগর
মুক্তা, ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত!’
আর প্রতিধ্বনি উত্তর দিল
যেনবা হাহাকার:
‘ওহ্, উপসাগর,
ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত’।

আমি যেন শুনতে পাচ্ছি ইরাক কর্ষন করছে বজ্র
মজুদ করছে বিদ্যুৎ পাহাড়ে সমতলে,
যদি সীলমোহর ভেঙ্গে ফেলে লোকে
লুপ্ত সামুদ জাতির মতো বাতাস উপত্যকা করে ত্যাগ ।

আমি যেন শুনতে পাচ্ছি পাম গাছেরা পান করছে বৃষ্টি,
শোনো, একটি শোকার্ত গ্রাম আর তার অধিবাসীদের হাহাকার
উপসাগরে দাঁড় ও পালের সংগ্রামে
ঝড়ো বাতাস আর বজ্রপাত,,,গাইছে
বৃষ্টি বৃষ্টি

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

আর ইরাকে ক্ষুধা ...
এখানে ফসল কাটার মরশুমে সমস্ত শষ্যাদি পড়ে ছড়িয়ে
গোগ্রাসে সেসব গেলে কাক ও পঙ্গপালের দল
শস্যভান্ডার ও পাথরের যাঁতা ঘোরে বারবার
মানুষসহ গমের কল ফসলের মাঠে হয় রুপান্তরিত

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
বৃষ্টি পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়

চলে যাওয়ার সময় কত কান্না আমরা কেঁদেছি রাতে
বৃষ্টির দোহাই দিই আমরা, দোষ না পড়ার কথা ভাবি

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

শিশুকাল থেকেই, আকাশ
শীতকালে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকত
আর বৃষ্টি ঝরত,
আর প্রতি বছর পৃথিবী সবুজ হয়ে উঠলে আমরা ক্ষুধা বোধ করতাম
ক্ষুধা ছাড়া ইরাকের একটি বছরও কাটত না।

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

ফুলের বীজ থেকে হলুদ কিংবা লাল রঙের কুঁড়ি বেরোত।
ক্ষুধার্ত আর নগ্ন মানুষেরা কাঁদত
আর রক্ত ঝরত দাসের
হাসত নতুন ভোরের প্রতি চেয়ে ।
নবজাতকের ঠোঁটে গোলাপি স্তনবৃন্ত
আগামী নতুন বিশ্বের, নতুন জীবনের যাত্রী ...

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

বৃষ্টির ভিতর একদিন জেগে উঠবে ইরাক!

আমি উপসাগরের প্রতি চিৎকার করে কেঁদে উঠি: ‘ওহ্, উপসাগর
মুক্তা, ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত’
আর প্রতিধ্বনিত হল
যেনবা হাহাকার:
‘ওহ্, উপসাগর,
ঝিনুক ও মৃত্যুর দূত’।

এবং উপসাগরের পর্যাপ্ত উপহার উপকূলের বালির ওপর
ছড়ায় ফেনা ও ঝিনুক
আর ডুবে যাওয়া অভিবাসীর কঙ্কাল
যারা চিরদিনের জন্য মৃত্যু পান করেছিল
উপসাগরের অতল হতে, এর স্তব্দতা থেকে,
আর অজস্র সরীসৃপ ইরাকে পান করে নির্যাস
একটি ফুল থেকে ফোরাত নদী লাভ করে শিশিরের পুষ্টি ...
আমি প্রতিধ্বনি শুনি
উপসাগর থেকে ভেসে আসছে :
বৃষ্টি

টিপ টিপ টিপ টিপ বৃষ্টি
ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে বৃষ্টি

বৃষ্টির প্রতি ফোঁটায়

ফুলের বীজ থেকে বেরোত হলুদ কিংবা লাল রঙের কুঁড়ি ।
আর নগ্ন ক্ষুধার্ত মানুষেরা সব কাঁদত
আর রক্ত ঝরত দাসের
নতুন ভোরের প্রতি চেয়ে হাসত ।
নবজাতকের ঠোঁটে গোলাপি স্তনবৃন্ত
আগামী নতুন বিশ্ব, জীবনের যাত্রী!

আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ: লেনা জাঈয়ূসি এবং খ্রিস্টফার মিডলটন।


৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×