somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনে আছেÑব্ল্যাকআউ...ফিরোজ এহ্তেশাম

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মনে আছেÑব্ল্যাকআউট
ফিরোজ এহ্তেশাম
ভোর। দিগন্তব্যাপী ধানতে। দূরে, েেতর আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছেন একজন বাউল। তাঁর পরনে লাল পোশাক, কাঁধে ঝোলানো শিঙা। যেতে যেতে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর আকাশের দিকে মুখ করে বাজিয়ে দিলেন তাঁর শিঙা। সেই শিঙার ধ্বনি যেন ঘোষণা করে দিল দিনের এই সূচনালগ্নটিকে। আর এভাবেই, একইসাথে সূচনা ঘটল ‘ব্ল্যাকআউটে’র। ব্ল্যাকআউটÑটোকন ঠাকুর রচিত ও পরিচালিত এই ভিডিও ফিল্মটি প্রথমবার দেখানো হয় রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, দ্বিতীয়বার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। দুই কেন্দ্রেই আমি গিয়েছিলাম সিনেমাটি দেখতে। ‘ফিল্মলাইনে’ এটাই টোকনের প্রথম কাজ। টোকন তাঁর প্রথম কাজটার বাংলা নাম দিয়েছেন ‘মনে নেই’।
আমি একজন সাধারণ দর্শকমাত্র, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ নই। ফলে সিনেমার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আমার অনায়ত্ব। তাই একজন সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকেই এই সিনেমা সম্পর্কে আমার অনুভূতিগুলো বলার চেষ্টা করব।
তা, ‘মনে নেই’ দেখে প্রথমেই যা আমার মনে হয়েছিল, তা মনে আছে। মনে হয়েছিলÑবাহ্, ভালোই তো! টোকনের সাহস আছে অন্যরকম কিছু করার। এমনকি সিনেমার বাণিজ্যিক দিকটির কথা ভেবেও তিনি কোথাও আপোশ করেন নাই।
সিনেমাটিতে কিছু চরিত্র তো দারুণ অভিনয় করেছে। ভালো অভিনয় এবং সিনেমার অধিকাংশ জুড়ে উপস্থিতির কারণে প্রধান চরিত্র দুটির কথা দর্শকদের মনে না থেকে উপায় নাই। তবে ছোট্ট একটি জায়গায় অভিনয় করেও যিনি দর্শকদের মনে দাগ কেটেছেন কিংবা যাঁর অভিনয় আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাঁর নাম জুয়েনা ফেরদৌস মিতুল। মাদলের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। যাকে বলে ‘পারফেক্ট পারফর্ম’, স্বল্প সময়ের ছোট্ট এই চরিত্রটিতে তা-ই করে দেখিয়েছেন তিনি। মনে হয়েছে এই চরিত্রে এর চেয়ে ভালো অভিনয় সম্ভব ছিল না। এই চরিত্রের জন্য তাঁকে নির্বাচন করাটা যথাযথ হয়েছে।
সিনেমাটির আবহ সংগীত সুন্দর, অ্যানিমেশনের কাজ প্রশংসাযোগ্য, ফুটেজের ব্যবহার বুদ্ধিদীপ্ত, সংলাপেও কৃত্রিমতা নাই। সর্বোপরি এডিটিঙে রয়েছে মুন্সিয়ানার ছোঁয়া। এসব তো গেল ইতিবাচক দিক। নেগেটিভ দিক কী কিছুই নেই? আছে। কিছু চরিত্রের অভিনয় সাবলীল মনে হয় নাই। কোথাও কোথাও শব্দধারণের অসতর্কতার জন্য সংলাপ বুঝতে কষ্ট হয় কিংবা কষ্ট করেও বোঝা যায় না (আর হায়, ততণে সাবটাইটেলও মুছে যায়)।
ব্ল্যাকআউটে কিছু বাস্তব চরিত্রকে, যাকে বলে ডকু-ক্যারেক্টার, অবিকল হাজির করা হয়েছেÑসংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ, চিত্রশিল্পী ধ্র“ব এষ, চারুকলার মাটির অলংকার বিক্রেতা দাদু মমিন আলী মৃধা, বাঁশিওয়ালা লাবু মিয়া, চা-সিগারেটের দোকানদার আজাদ... ও বিমল বাউল।
প্রথম যে দৃশ্যটি দিয়ে ‘ব্ল্যাকআউট’ ও এই লেখাটির শুরু, সেটি একটি স্বপ্নদৃশ্য। স্বপ্নটি দেখছেন একজন কবি। নাম তাঁর মাদল। স্বপ্নে অতীতের ফেলে আসা সবুজ ভোর আর দিগন্তবিস্তৃত গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে কবির ঘুম ভাঙে বর্তমানে, দুপুর ১২টায়, ঢাকা শহরের ৭ তলা বাড়ির টপ ফোরে, সংকীর্ণ এক চিলেকোঠায়। এইভাবে প্রথমেই দুটি দৃশ্যের মধ্যে কতকগুলো বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব ও ঐক্য দিয়েই শুরু হয় ফিল্মটি। এরপর বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাথরুমে যেতে থাকা রুমমেট রাফিকে মাদল জিজ্ঞাসা করে, কয়টা বাজে, আজকে কী বার। তারপরই বিছানার পাশে রাখা টইটম্বুর অ্যাশট্রে উল্টে ফেলে অসর্তকতায়।
মাদলÑফাশব্যাকে আটকে যাওয়া স্মৃতিকাতর, অন্তর্মুখী এক যুবক। তার সিংহভাগ বর্তমান জুড়ে কেবল অতীত-অতীত। সে এখন কবিতা লেখে না, শুধু অতীতের জাবর কাটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার অতীতও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। শাল্মলীর মুখও আর মনে পড়ে না। খালি ‘ব্ল্যাকআউট-ব্ল্যাকআউট’ লাগে।
রাফি চিত্রশিল্পী। তার প্রেমের সম্ভাবনা। তার ছবির মডেল মিটিকে সে কল্পনা করে। মিটি সুন্দর ও উচ্চাকাক্সী। যথারীতি একদিন সে তার রূপ নিয়ে চলে যায় দূরে, বিজ্ঞাপনের মডেল হতে, বিদেশে। তাকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলো রাফি কালো রংতুলিতে মুছে ফেলে, পুড়িয়ে ফেলে তার জন্য কেনা শাড়ি। তারপর দুই বন্ধু এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়, গলা জড়িয়ে নাচতে থাকে। শেষে বিছানায় শুয়ে পড়ে ‘কুকুর কুকুরিসম ডাকাডাকি করে’। অতি সংেেপ এই হলো ব্ল্যাকআউট। একইসাথে স্মৃতিকাতরতা ও বিস্মরণ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, রোমান্টিক কল্পনা ও দগদগে বাস্তবতা আর ফাঁকে ফাঁকে কলবেলের হঠাৎ সচকিত করা হ্রেষাধ্বনির মতো জীবনের উদ্দমতাÑএসবের সমন্বয় ও মিথষ্ক্রিয়াই টোকন ঠাকুরের ব্ল্যাকআউট।
ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক দিক সেটা ব্যক্তিসাপে ব্যাপার, তবে মনে হয়েছে ব্ল্যাকআউট আমাদের ভেতর অস্থিরতাই তৈরী করে, প্রশান্তি নয়। কাজেই যারা তথাকথিতভাবে বিনোদিত হতে কিংবা ‘শান্তি লাভ করতে’ ফিল্মটি দেখতে বসবেন তাদের বাসনা কিন্তু অপূর্ণই থেকে যাবে। বরং তারা নড়েচড়ে বসতে পারেন, মানে ‘অস্থির’ হতে পারেন। এই অস্থিরতা হয়তো মূল চরিত্র দুটির ‘অসাধারণ’ জীবন যাপনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে, পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে, অনিশ্চয়তা, অপারগতা, ব্যর্থতা, আর অবদমিত কামনার অসহায়ত্ব থেকে উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দর্শকের ভেতরে। টোকন ঠাকুরকে যারা চেনেন তারা জানেন তিনি একাধারে দুই শিল্পীÑকবি ও চিত্রকর। এ থেকে মনে হতে পারে মাদল (কবি) ও রাফি (চিত্রকর) বুঝি টোকনেরই খণ্ডিত দুই শিল্পীসত্তা, এবং সেই অর্থে ব্ল্যাকআউট তাঁর আÍজৈবনিক ফিল্ম। হতে পারে। হলে কোনো তিও নাই। কিন্তু এখানে তৃতীয় একটি মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তা হলো টোকন ঠাকুরের ফিল্মমেকার হিসাবে আÍপ্রকাশ। হয়তো যা তাঁর কবিতা ও চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে বলা সম্ভব হয়নি, তা-ই প্রকাশ করেছেন এই ফিল্মের মাধ্যমে। তাই আমি পরিচালকের এইসব ব্যক্তিতথ্য ভুলে গিয়ে কেবল একজন ফিল্মমেকারের কাজ হিসাবেই ফিল্মটিকে বিচার করার পপাতি। তথাকথিত ব্যবসা-সফল ও জনপ্রিয় সিনেমার তালিকায় যে ব্ল্যাকআউটকে পাওয়া যাবে না তা হয়তো টোকনও জানেন। তবে তাঁর অকপট সাহসী উপস্থাপনার জন্য এই ফিল্মটি বাংলাদেশের সিনেমায় ‘অন্যরকম কাজ’ হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×