somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: সবুজ সমাধির দিকে

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলজুড়ে পাহাড় আর পাহাড় । সেসব পাহাড়ে ঘন সবুজ গাছগাছালি আর নানা বর্ণের পাখ-পাখালির ভিড়। তিনি পাহাড়ে যাবেন ঠিক করলেন। আমৃত্যু পাহাড়ে বসবাস করবেন ; কথা বলবেন পাখিদের সঙ্গে, মিশে থাকবেন গাছেদের সঙ্গে । আমৃত্যু ... তারপর এক ধরণের সবুজ সমাধি হয়ে যাবে তার ...

থানচি উপজেলার এই আদিবাসী গ্রামটির নাম পাঙখুঙ। জায়গাটা রুমা থেকে অনেকটাই দক্ষিণ-পুবে এবং প্রায় মায়ানমার সীমান্তসংলগ্ন । নীলাভ জলের বিস্তীর্ণ একটা হ্রদ। হ্রদের ওপর ও হ্রদের চারপাশে অটুট নিস্তব্দতা। হঠাৎ কোনও পাখির চিৎকারে সে নিস্তব্দতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। হ্রদের অনেক ওপরের সমতলে পাঙখুঙ গ্রাম। সাঈদ আহমেদ এসব এলাকা আগেই ঘুরে ফিরে দেখে গেছেন। এলাকাটি বিশেষ করে ম্রো ও খুমি অধ্যুষিত। অবশ্য কয়েক ঘর পাঙ্খোও বাস করে। একটি পাহাড়ি জলস্রোতের ওপর বাঁশের তৈরি ঘর, আপাতত ঠিকানা এখানেই। বাঁশের ঘরটা পাঙখুঙ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাঁশের তৈরি ঘর কে পার্বত্য জেলায় বলে টং। ম্রো ও খুমিরাও কি বাঁশের তৈরি ঘরকে টং বলে? নাকি শুধু চাকমারাই বলে? এ প্রশ্নটি বহুদিনের পুরনো- সাঈদ আহমেদ যখন এই পাহাড়ি গ্রামে প্রথম এসেছিলেন, তখনকার। বাঁশের ঘরে থাকে একজন ম্রো বুড়ো, বুড়োর নাম ঙারুয়া। তামাটে বর্ণের দীর্ঘদেহী বুড়োটির মাথায় সাদা শনের মতন পাকা চুল ও ঘোলাটে চোখ। ম্রো বুড়োটি নিঃসঙ্গ। সম্ভবত সেও নির্জনবাস করছে। সাঈদ আহমেদ গতশীতে এসে এখানেই থাকতে চেয়েছিল। ম্রো বুড়ো তখন আপত্তি করে নি। তাছাড়া খরচ যা লাগে তিনি দেবেন । ঙারুয়া অনেকটা দার্শনিক গোছের। কথা বলে কম । তবে বাংলা ভালো জানে। উল্লেখ্য, বুড়োর একটি পোষা হাতি আছে। হাতির নাম আদম। আশ্চর্য! বান্দরবানের গহীন অরণ্যের হাতির নাম আদম হতে পারে! সাঈদ আহমেদ তখনও জানতেন না-ঐ হাতির পিঠে চড়ে তাকে আরও গভীর অরণ্যের দিকে চলে যেতে হবে ।
সাঈদ আহমেদ-এর নির্জনবাস শুরু হয়। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান রওনা হওয়ার সময়ই বাসে মোবাইল ফোনটা অফ করে দিয়েছিলেন, এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নিচের হ্রদে জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সিগারেট খেতেন দিনে পাঁচটা। প্যাকেটে তখনও তিনটে বেনসন লাইট ছিল, প্যাকেটটাও ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ম্রো বুড়ো বাজার করে, রান্নাবান্না করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা একা একা ঘুরে বেড়ান। পাখিদের গান শোনেন, শোনেন পাতা ঝরার শব্দ। নির্জন পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করেন সাঈদ আহমেদ। ম্রো বুড়োর কাছে ম্রো ভাষা শিখতে শুরু করলেন। নির্জনবাস কিংবা সবুজ সমাধির জন্য ভাষা শেখা অতটা জরুরি নয় যদিও তবে তিনি একটি শখ পূরণ করছেন। তৃতীয় একটি ভাষা শেখার ইচ্ছে তার দীর্ঘদিনের। টুকটাক স্পেনিশ জানেন। ম্রো বুড়ো ঙারুয়া বলে, বলেন-

তুই ঙাঙ -নর খাইয়া কই,
দাম ইয়ালাইদয় পে ...

সাঈদ আহমেদ মেধাবী। তিনি পনুরাবৃত্তি করলেন,

তুই ঙাঙ -নর খাইয়া কই,
দাম ইয়ালাইদয় পে ...

ঙারুয়া মাথা নাড়ে।
কি এর মানে? সাঈদ আহমেদ জিজ্ঞেস করে।
ঙারুয়া বলে, মাছেরা যেমন জলে, মানুষও তেমনি পরিবেশের কারণে সত্যোচ্চারণে বিরত থাকে।
সাঈদ আহমেদ শিউরে উঠলেন।
পরে রোহিঙ্গা গেরিলাদের প্রসঙ্গে এ উক্তিটি মনে পড়বে সাঈদ আহমেদ এর যখন তিনি আদম এর পিঠে চড়ে অরণ্যে আরও গভীরে প্রবেশ করবেন!



৫০ বছর হল ফাদার গেরহার্ড পাঙখুঙ গ্রামে বাস করছেন। গতবারই সাঈদ আহমেদ এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে। এবার সংলাপ বহূদূর গড়াল। ইউরোপ ছেড়ে চলে এলেন যে? সাঈদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন।
লজিক।
মানে! সাঈদ আহমেদ বিস্মিত।
ফাদার গেরহার্ড বললেন, মানে ...আমি আগে দর্শনের অধ্যাপক ছিলাম। আমার বিষয় ছিল হিউমবাদী লজিক্যাল এম্পিরিসিজম। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপীয় দর্শনে লজিকের খুক দাপট ছিল-তবে আমি দর্শনচর্চা করে মনে শান্তি পাইনি। আমি শান্তির আশায় ফ্রানসিসকানদের পবিত্র অডারে যুক্ত হই। যাজকবৃত্তি নিয়ে পলিনেশিয়া চলে যেতাম, শুনলাম ইস্ট পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মুজিব একাই ভীষণ উত্তাল করে ফেলেছেন, সেই ৩৮/৩৯ বছর আগের কথা বলছি আমি। এখানেই চলে এলাম। একেবারে বান্দরবানে। কাজটা সহজ হয়নি। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র আর প্রতিরক্ষা বোধ রয়েছে, খুমিদের দ্বারা কয়েকবার আক্রান্ত হই; ম্রোরা বাঁচায়।
ওহ্!
ফাদার গেরহার্ড বললেন, পরিস্থিতি আজ অনেক বদলে গেছে। পাঙখুঙ গ্রামের প্রায় সবাই খ্রীস্টে বিশ্বাস করেছে। কেবল, ঐ আপনার ঙারুয়া বাদে।
ঙারুয়া মানে, আমি যে ম্রো বুড়োর সঙ্গে থাকি? সাঈদ আহমেদ বিস্মিত।
হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই। আমি তার নাম দিয়েছি অরণ্যবনের সক্রেটিস। ফাদার গেরহার্ড তিক্তকন্ঠে বললেন।
সমাজে সবসময়ই কিছু ব্যাতিক্রমী মানুষ থাকবেই। সাঈদ আহমেদ মৃদু হেসে বললেন।
ফাদার গেরহার্ড বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।
লেলাং খুমি । পাঙখুঙ গ্রামের ২৯ বছর বয়েসি এক খুমি যুবক। সে সাঈদ আহমেদ এর ওপর বিরক্ত । সাঈদ আহমেদ অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলেই আদিবাসী তরুণের অসন্তোষের কথা টের পেয়েছেন। তিনি মনে মনে হাসেন। সাঈদ আহমেদ পাহাড়ে গাছের পাতার ঘ্রান নেন, পাখিদের জীবন অবলোকন করেন। লেলাং খুমিদের পাখিদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলে চলবে না, তাদের নিয়মিত ক্ষিদে পায়- যদিও সে নব্যখ্রিস্টান। তা ছাড়া খুমি গ্রামের কাছে সাঈদ আহমেদ এর উপস্থিতি লেলাং খুমির কাছে অনধিকার চর্চা বলেই মনে হয়। কেননা, ওদের বসবাসের জায়গাটি ওদের কাছে পবিত্র । সাঈদ আহমেদ জানেন: তিনশ বছর আগেও খুমিরা ছিল বার্মায়; ও দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা এখানে এসেছে। তিনশ বছর ধরে বাস করতে করতে পাঙখুঙ গ্রামটি পবিত্র করে তুলেছে লেলাং খুমিরা; সে গ্রামে অচেনা পুরুষের অনুপ্রবেশ সহ্য হবে কেন? সাঈদ আহমেদ লোকটা কে? তাকে তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
সাঈদ আহমেদ সন্ন্যাস নিয়েছেন।
তিনি বিরোধ এড়িয়ে লেলাং খুমির মন জয় করার কথা ভাবলেন । এই পাঙখুঙ গ্রামে বড় জলকষ্ট। সন্ন্যাস গ্রহনের পূর্বে প্রকৌশলী ছিলেন সাঈদ আহমেদ। তিনি মনে মনে ছক কাঁটতে লাগলেন। হ্যাঁ। হ্রদের তীরে স্টিমারের চাকার মতো বিশাল একটি কাঠের চাকা বসিয়ে ওপরে পাঙখুঙ গ্রামে জল তোলা সম্ভব। বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না, বাতাসের গতিই চাকা ঘোরাবে। হ্রদ থেকে ওপরে জল তোলার পরিকল্পনাটির কথা ফাদার গেরহার্ড কে খুলে বললেন সাঈদ আহমেদ। ফাদার গেরহার্ড প্রযুক্তিবিরোধী। তবে বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক বলেই ফাদার গেরহার্ড চমৎকৃত হলেন। বাতাসের চাপে নিচের লেক থেকে জল উঠে আসবে বিশেষ ভাবে নির্মিত চাকায়।
সাঈদ আহমেদ যদিও সংশয়বাদী। মাঠের কিনারায় গীর্জের নকশা এঁকে ফাদার গেরহার্ড কে দেখালেন । স্থাপত্যে গথিক ছাপ। গীর্জের পিছনের বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের হ্রদ ও কাঠের চাকার দৃশ্য পরিপূর্নভাবে দেখা সম্ভব। ফাদার গেরহার্ড চমৎকৃত হলেন।
লেলাং খুমি ফাদার গেরহার্ড এর শিষ্য। সে সবই জানল। সাঈদ আহমেদ সর্ম্পকে রাতারাতি তার দৃষ্টিভঙ্গি গেল বদলে । যুগটা মোবাইল এর । এবং লেলাং খুমি অন্তত দশটি এনজিওর সঙ্গে জড়িত- প্রতি সপ্তাহে একবার থানচি যায়। রুমা যায়। মোবাইল আছে তার। যার ফলে সাঈদ আহমেদের পরিকল্পনার কথাটি ইউরোপ অবধি ছড়িয়ে পড়ে। মূলধারার বাঙালিদের চেয়ে ইউরোপীয়দের কারও কারও দরদ আদিবাসীদের প্রতি অনেক বেশি । বিদেশি দাতা সংস্থাগুলি টাকা দিতে আগ্রহী। শোনা গেল প্রজেক্ট শেষ হলে কোন্ প্রতিমন্ত্রী নাকি আসবেন উদ্বোধন করতে।
সাঈদ আহমেদ অরণ্যের আরও গভীরে পালিয়ে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে এক্ষুনি যাওয়ার দরকার নেই। চাকা তৈরি করতে কম করেও দেড় থেকে দু-বছর লাগবে।



একদিন। সকালবেলায় পিছনের পাহাড়ের ঢালে গাছের ভিড়ে পাতার ফাঁকে রোদের ভিতর একটি সাদা রঙের ঘুঘু দেখে থমকে দাঁড়ালেন সাঈদ আহমেদ। তারপর গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সাঈদ আহমেদ বললেন, কি রে রীমা, তুই এখানে?
২০/২২ বছরের চশমা পরা ফরসা মেয়েটি চমকে উঠল। দ্রুত সিগারেট ফেলে বলল, মামা! তুমি এখানে!
তুই ... তুই কি করছিস এখানে? বোনের মেয়েকে দেখে বিস্ময় কাটছে না সাঈদ আহমেদ এর।
রীমা বলল, কেন তোমার মনে নেই আমি বান্দরবানের এথনিক গ্র“পের ওপর রিসার্চ করছি। জার্মানি থেকে ডিপলোমা করে এলাম না?
ওহ্ হ্যাঁ, তাই তো। আসলে সবুজ সমাধির আশায় পূর্বজীবন ভুলে যেতে চাইছিলেন সাঈদ আহমেদ। ষাট বছরের জীবনে কত কিছু জমেছে। এখন সবুজ সমাধির আগে মুছতে পারছেন কই। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তুই একা এসেছিস?
রীমা বলল, না, না। পান্থ আর আদিত্যরা ঝর্নায় গোছল করতে গেছে। আমার এক জার্মান ফ্রেন্ড আরনল্ড, মিউনিখে থাকে-ও ম্রোদের মিউজিক নিয়ে ডকু করবে । আমরা লোকেশন দেখতে এসেছি। আমি একটা পাখি ফলো করতে করতে এখানে এলাম। সাদা ঘুঘু। আচ্ছা মামা, সাদা ঘুঘু কি বাংলাদেশে পাওয়া যায়?
জানি না। সাঈদ আহমেদ বললেন। জলবায়ূ বদলে যাচ্ছে। বলে সাঈদ আহমেদ কাঁধ ঝাঁকালেন। ওহ্, রীমা তা হলে ম্রোদের মিউজিক নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে। বাঁশ বেত কাঠ এবং পাতা মুড়িয়ে ম্রোরা শ্রুতিমধুর ধ্বনি তুলতে পারে। ওদের মিউজিকের কথা ইউরোপে চলে গেছে। ঙারুয়া রাতের বেলা শোনায় ম্রো-সংগীত। সে সংগীতের অলীক মোহে সাঈদ আহমেদ দিনদিন বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন।
তা তুমি তাহলে এখানে? রীমা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
আর সবাই তোমায় খুঁজে খুঁজে হয়রান। রীমার কন্ঠে অনুযোগ।
সাঈদ আহমেদ হাসলেন। কিছু বললেন না?
তুমি ফিরবে না মামা?
না রে। এখানেই বেশ আছি।
আমারও শহরে ফিরতে ইচ্ছে করে না । রীমা বলল। এখানে পান্থ-আদিত্যদের আচরণ অন্যরকম, কত হেল্পফুল। শহরে পা দিলেই ওরা কেমন বদলে যায়। যেন আমি কেবলই মেয়ে।
তা হলে থাক এখানে। সাঈদ আহমেদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
ধ্যাত, তা কি হয়? রীমা মনে হল লজ্জ্বা পেল। সাঈদ আহমেদ জানেন এই ডিসেম্বরে রীমার এনগেজমেন্ট।
পরের দিনই রীমারা চলে গেল থানচি। রুমা হয়ে চট্টগ্রাম ফিরে যাবে। লেলাং খুমি ওদের সঙ্গে গেল। বিদেশি একটি ডেলিগেশন নাকি আসছে। তারা ওয়াটার প্রজেক্ট পর্যবেক্ষণ করবে।
সাঈদ আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন: আমাকে এখান এখান থেকে চলে যেতে হবে। রীমার মুখে খবর পেয়ে ছেলেমেয়েরা আসবে, ওদের মা আসবে। উদার হৃদয়ের মানুষের সামনে সবসময় দুটি পথ খোলা থাকে: (১) আত্বহত্যা করা। (২) আত্বহত্যা না-করা; এবং দূরের কোনও নির্জন স্থানে সবুজ সমাধি খুঁজে নেওয়া।
সাঈদ আহমেদ সবুজ সমাধির দিকে যাবেন।



এই পাঙখুঙ গ্রামে সাঈদ আহমেদ এর একমাত্র সুহৃদ ম্রো বুড়ো ঙারুয়া ।
বুড়ো কেমন অবিচল আর প্রাকৃতিক। এই বয়েসেও আদম নামক হাতিটিকে ঝর্নাতলায় নিয়ে গিয়ে গা ডলে আর বিচিত্র ভাষায় গান করে। ঙারুয়া কে ফাদার গেরহার্ড বলেন অরণ্যবনের সক্রেটিস। তাকে ধর্মচ্যূত করতে পারেননি তিনি। সেন্ট পল আর সেন্ট অগাস্টিনও পারেন নি। ম্রো বুড়ো ঙারুয়ার যে কি ধর্ম-তা-ই এত দিনেও জানা গেল না।
সাঈদ আহমেদ ঙারুয়া কে সব খুলে বললেন। আমার এখান থেকে চলে যেতে হবে।
ঙারুয়া খানিকক্ষণ কী ভাবল। তারপর বলল, আমাদের অনেক গোত্র, অনেক উপধারা। এদের মধ্যে চিমলুঙরা অরণ্যে আরও গভীরে থাকে । সীমান্তের কাছাকাছি। ওখানে কেবল গাছ আর গাছ। পাখি আর পাখি। ওখানে যেতে চাইলে আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। চিমলুঙরা সহৃদয়। আমি সঙ্গে থাকলে তারা আপনাকে গ্রহন করবে।
সাঈদ আহমেদ যেতে রাজী হলেন।
পরদিন। ভোর ভোর সময়ে আদম এর পিঠে চড়ে বসলেন সাঈদ আহমেদ। ঙারুয়া আগেই চড়ে বসেছে। কার্তিকের কুয়াশার ভিতর দিয়ে পূর্বমূখী পথ। দুপাশে ঘন গাছ। ভিজে যাচ্ছেন সাঈদ আহমেদ। ঙারুয়া নির্বিকার। এ দেশের বুনো পথঘাট সব তার চিরচেনা। পথ হারানোর কোনও ভয়ই নেই। আসলে কোনও পথই যে নেই।
এক সময় রোদ উঠল। পাখি ডাকল। যেতে যেতে আশ্চর্য এক প্রশ্ন করেন সাঈদ আহমেদ। যা যা দেখছি, এসব আসলে কি ঙারুয়া?
উত্তরে ঙারুয়া এক আশ্চর্য উপকথা বলে। অনেক অনেক দিন আগের কথা। সে সময় ঘন কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেই কুয়াশা ফুঁড়ে এক হলুদাভ দেবশিশুর আবির্ভাব হয়েছিল। অকস্মাৎ বর্শা ফলক হাতে ছ’জন বলিষ্ট কৃষ্ণদেহী। সেই হলুদাভ দেবশিশুকে হত্যা করে বসে। মৃত শিশুটির
মাংস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। যা যা দেখছি, মাংস থেকে সেসবের জন্ম হল।
সাঈদ আহমেদ গলার কাছে টক টক স্বাদ টের পেলেন। এখন একটা সিগারেট ধরালে ভালো হত। বিষন্ন হয়ে ভাবলেন উপকথায়ও রক্ত আর রক্ত। যদিও ঙারুয়া এর মিথটি সাঈদ আহমেদ বিশ্বাস করতে থাকেন। ঙারুয়া রাতের বেলা শোনায় ম্রো-সংগীত। সে সংগীতের অলীক মোহে সাঈদ আহমেদ দিনদিন বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন।
যাত্রা বিরতিতে ঙারুয়া এক ভয়ঙ্কর প্রসঙ্গ তুলল। সীমান্তে রোহিঙা গেরিলারারা গোপন ঘাঁটি গড়ে তুলেছে । সাঈদ আহমেদ চমকে উঠলেন। রোহিঙা গেরিলারারা স্বাধীন রোহিঙাভূমি চায়। ঙারুয়া বলল।
না! সাঈদ আহমেদ এর কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ শোনাল।
কেন ? তোমরা চাওনি? ঙারুয়ার কন্ঠস্বরও তীক্ষ্ণ শোনাল।
সাঈদ আহমেদ চুপ করে থাকেন।
ঙারুয়া বলল, তারা গেরিলা হবে না কেন-তারা বার্মাদেশ থেকে নির্বাসিত। নিষ্পেষিত। তাদের ওপর গনহত্যা চালিয়েছে বার্মার সামরিক সরকার।
সাঈদ আহমেদ মাথা নাড়লেন। তিনি জানে নির্যাতিত নির্বাসিতদের একাংশ সমাজবিজ্ঞানের অনিবার্য সূত্র অনুযায়ী গেরিলা হয়ে ওঠে।
ঙারুয়া বলল, রোহিঙ্গা গেরিলাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবেন?
সাঈদ আহমেদ চমকে উঠলেন।
আমি ওদের সমর্থক। ঙারুয়া বলল। ওদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। তোমরাও ওদের গ্রহন করনি। তোমরা অবিচার করছ।
সাঈদ আহমেদ অবাক হয়ে যান। এ রকম সত্য কথা কেউ বলে না। আসলেই তো রোহিঙ্গাদের ওপর অন্যায় করা হচ্ছে। ঙারুয়া বলেছিল: তুই ঙাঙ -নর খাইয়া কই,/ দাম ইয়ালাইদয় পে ...মাছেরা যেমন জলে, মানুষও তেমনি পরিবেশের কারণে সত্যোচ্চারণে বিরত থাকে। সাঈদ আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঙারুয়া অরণ্যবনের সক্রেটিস। অরণ্যবনের সক্রেটিসরাও এখন যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থায় নেয়, অবস্থান নিতে হয়। নিরীহ দার্শনিকতার দিন শেষ! অবস্থান আমাকেও নিতে হবে! কিন্তু, আমি কোন্ পক্ষ নেব?
সাঈদ আহমেদ ক্লান্ত বোধ করেন।
ঙারুয়া আবার আদম এর পিঠে চড়ে বসেছে।
সাঈদ আহমেদও উঠলেন। তখন ঙারুয়া বলেছিল, চিমলুঙরা নাকি সহৃদয়। তবে ওখানকার লোকজন তাকে গ্রহন করবে কিনা সে ভেবে উদ্বেগ বোধ করলেন সাঈদ আহমেদ। রোহিঙ্গা গেরিলাদের সঙ্গে চিমলুঙদের সম্পর্ক কেমন কে জানে। হয়তো আগেকার গভীর শান্তি সেখানে আর নেই। নানা রকম উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সাঈদ আহমেদ সবুজ সমাধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।


তথ্যসূত্র:

তুই ঙাঙ -নর খাইয়া কই,
দাম ইয়ালাইদয় পে ...

এই ম্রো প্রবাদটি পেয়েছি হাফিজ রশিদ খান এর লেখা “নির্বাচিত আদিবাসী গদ্য” বইতে।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:০২
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×