somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ষ্টেশনের মেয়েরা.........

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার শৈশব কেটেছে লালমনিরহাট রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে রেলওয়ে কোয়ার্টারে। বাসার সামনে সজনে গাছের নীচে সজনে ফুল বিছানো থাকতো। ছোটবেলা থেকে কখনো ফুল ছিঁড়তে পারিনি কোন গাছের। কখনো পায়ে দলে হেঁটে যেতে পারিনি সজনে ফুল। ঘুর পথে হেঁটে যেতাম।
আমাদের বাসার সামনে ফুল বাগানটার পরই বড় আর একটা বাগান ছিলো। এর পাশ দিয়ে মাটির একটা পথ ছিলো যা বড় রাস্তার সাথে মিশেছিলো। আমাদের বাসাটা ছিলো মাঝখানে ।একপাশে লিটু মিঠুরা থাকতো। অন্যপাশে বাবুদারা। শিউলী ফুলের গাছটা ছিলো বাবুদাদের সীমানায়। আর কাঁঠালচাপা ছিলো লিটুদের বাসায়। আমাদের বাসায় ছিলো নয়নতারা ফুলের বিশাল গাছটা। সন্ধ্যা হলেই নানান ফুলের গন্ধে মউমউ করতো চারিদিক। ভয়ে কখনো কাঁঠালচাঁপার গাছটার ওদিকে যাইনি।
মা বলতেন ওখানে নাকি রাতের বেলা সাপ আসে।

আমাদের বারান্দায় বসলে কাঠের খোপ খোপ রেলিং দিয়ে রাস্তার ওপারের স্টেশন দেখা যেতো। সন্ধ্যা হবার একটু আগে ছেড়ে যেতো মোগলহাট যাবার ট্রেনটা। বেশীর ভাব মানুষই যারা যেতো তার বর্ডারে জিনিস চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত ছিলো। মাঝে মাঝে দেখতাম ট্রেনটা নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ছে না। কয়েকজন মহিলাকে ধরে আনতেন ট্রেনের টিটি আর পুলিশরা। এক একজনের শাড়ীর নীচ থেকে বের হতো একের পর এক কাপড়। সব সোয়েটার।প্যান্ট।পায়ে কোমরে শক্ত করে বাঁধা থাকতো কাপড়গুলো। হাঁটতেও পারতোনা। পুরাতন সব কাপড়গুলো ওপাড়ে চালান করে ওপাড় থেকে শাড়ি নিয়ে আসতো ওরা।
প্রতিদিনই ওরা ওভাবে যেতো। যেদিন টাকাপয়সার লেনদেনে ঝামেলা হতো। ওদেরকে নামিয়ে নির্মমভাবে মারতো পুলিশরা।
এত মন খারাপ লাগতো। একটু পরই ওরা আবার সেই ট্রেনে চড়ে চলে যেতো। হয়তো কোন একটা বোঝাপড়া হয়ে যেতো। তখন অবশ্য সেকথা বুঝিনি। সেই মেয়েগুলোকে দিনেরবেলা দেখতাম রাস্তায় ঘুরতে। মা মেয়ে সব এক সাথে ঘুরতো।
রিকশাস্ট্যান্ড পার হয়ে একটু দুরে গেলে রেলওয়ের বিভাগীয় অফিস।
ট্রেন লাইনে কতগুল মালগাড়ি বছরের পর বছর একই জায়গায় ছিলো। ওখানে থাকতও কিছু পরিবার। কিছু মহিলারা এবং তাদের সন্তানেরা।
তাদের জীবন যাপন অদ্ভুত ছিলো।
আসা যাওয়ার পথে অবাক হয়ে দেখতাম।
ওরা কারা?
ওদের বাড়িঘর নেই কেনো।
বিকাল হলে মেয়েগুলো সেজে ঘুরে বেড়ায় কেনো?
মেয়েগুলোর সাজগোজ কেমন চোখে পড়তো। ঠোঁটে আলতার মত কেমন যেনো রং লাগাতো ওরা।
মাকে প্রশ্ন করলে মা ঠিক কিছু বলেননি। মেয়েগুলো দেখতে অনেক কালো হলেও ওদের লম্বা দোহারা গড়নের জন্য সত্যি দারুণ দেখাতো।
এখন পথে আফ্রিকানদের দেখলে স্মৃতির সেই মুখগুলো মনে পড়ে যায়।
এখন ভাবলে কেমন অবাক লাগে! ওরা দেখতে আসলেই ভালো ছিলো।

মাঝে মাঝে খেলতে যাবার সময় ওদের ঝগড়া
চিৎকার শুনেছি। ওদের ছেলেরা ঠেলাগাড়ী চালাতো অনেক ছোটবেলা থেকে। মেয়েগুলো ষ্টেশনে পানি বিক্রি করতো। মালগাড়ির সংসারগুলো ওদের। ভিতরে কোন আসবাব ছিলোনা। শুধু খড় বিছিয়ে থাকতো।
কয়েকবছর পর ওদের আর দেখিনি। মালগাড়িগুলো সরে গেছে লাইন থেকে।

সেই যে ষ্টেশনের মেয়েরা ! ওরা কারা ছিলো বড় হয়ে বুঝেছি।
মাঝে মাঝে পথে ঘাটে ওদের দেখেছি।ওরা কেউ কেউ তখন মধ্যবয়সী।
বাসার সামনে এসে মায়ের কাছে সাহায্য চাইতো। পুরাতন কাপড় চাইতো।
মা বলতেন ওদের মাঝে দুই একজন বীরাঙ্গনাও ছিলো।
যারা কখনো নিজের পরিচয় দেয়নি। মা ওদের সাথে কথা বলে বুঝেছিলেন ওরা ভালো পরিবারের মেয়ে ছিলো। মুক্তিযুদ্ধে বাবা,মা ,ভাইবোন সব হারিয়েছে।

মা কয়েকবছর একটা এন জিওতে কাজ ও করেছিলেন। মা এদের বুঝিয়ে নিয়ে সেই এনজিওতে কাজের ব্যবস্হা করান। মেয়েগুলো ওখানে কেউ সেলাই,কেউ তাঁতের কাজ শেখে।
এরপর অন্ধকার জীবন থেকে ,সেই যে ষ্টেশনের মালগাড়িতে অদ্ভুত সেই জীবন থেকে ওরা সরে এসেছিলো। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে সেই সেন্টারে গেলে দারুন লাগতো আমার।একটা পরিত্যক্ত চার্চে মায়েদের অফিস ছিলো।
আমি সেখানে গেলে পাশের তাঁতের মেশিনগুলো দেখতে যেতাম। কেউ শাড়ি বুনতো আবার কেউ কাপড় সেলাই করতো । আমার ছোটবেলায় দেখা সেই কটকটে রং দেয়া মুখগুলো তখন জীবন যুদ্ধে ম্লান ।তবু একটু যেনো নিরাপত্তা ছিলো। একটু স্বনির্ভরতা।

আমি তখন যুদ্ধের ইতিহাস জানি।
আমি তখন বীরাঙ্গনাদের কথা জানি।
আমি তখন যুদ্ধ শিশুর কথা জানি।
আমি তখন বুঝতে শিখেছি আমাদের দেশের পতাকা যা সবুজ এবং যার বুকে লাল রং।সেই লাল রং অনেক মানুষের রক্তের রং।
সেই সবুজ আমাদের দেশের মায়েদের শাড়ীর রং,বোনেদের শাড়ির রং।
সেই বয়সেই ওদের কাছে নতজানু হয়েছি শ্রদ্ধায়।
সেই শ্রদ্ধা আজ বাড়তে বাড়তে আকাশ সমান।
শুধু মনেহয় ওরা কারা ছিলো জানা হলো না।
ওদের সন্তানরা কিভাবে বড় হলো জানা হলোনা।

এবার বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ,ওরা সবাই কোথায় মা?
ঐ যে সখিনা,সখিনার মা?
ওদের ভাই সাত্তার( যে সম্ভবত যু্দ্ধশিশু ছিলো)।
মা বলেন জানেন না।অনেক বছর জানেন না ওরা কোথায়।
আমরা কয়জনই বা জানি সেইসব সখিনাদের কথা! সখিনার মা বীরাঙ্গনা সহিদার কথা। যু্দ্ধশিশুদের কথা!
চোখ নীচু করে থাকতে হয় ।
আমাদের তো চোখ নামাতেই হয় ওদের দিকে তাকালে!
ওদের স্মৃতির পাতায় দেখলেও!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:০২
৬৪টি মন্তব্য ৬৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×