ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়ার পরই পাকিস্তানের রেডিওতে বেশ ফলাও করে বলা হচ্ছিল আমেরিকা ও চীনসহ মুসলিম দেশগুলো তাদের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আছে।আমাদের দেশীয় দালালেরাও বলতে লাগলো পুর্ব পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠাবে।এই যুদ্ধ জাহাজটি তখন বংগপোসাগরের আসপাশেই নাকি ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল।এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চীনের সরাসরি স্থলপথ ।সেখান দিয়ে চীনে্র সৈন্য ঢুকে পাকিস্তানকে সহায়তা দেবে।
আমাদের টাংগাইল শহর তখন বাঘা সিদ্দিকীর গেরিলা হামলায় পর্যুদস্ত।প্রায় প্রতিদিনই শুনি কেউ ফেরিওয়ালা,কেউ রিক্সাওয়ালা বা কেউবা ভিক্ষুক সেজে মুক্তিবাহিনী নানান গুরুত্বপূর্ন স্থানে গ্রেনেড হামলা করে যাচ্ছে।অনেক মুক্তিসেনাই ছদ্মবেশে রাজাকার বা আল-সামছের সদস্য সেজে বিভন্ন চেকপোস্টে মিলিটারিদের সঙ্গে কাজ করতো।তারা মুক্তিদের জানিয়ে দিত শহরে ঢুকার কোন পয়েন্টে তারা আছে সেই মোতাবেক গেরিলারা অস্র ও গোলাবারুদ ফেরিওয়ালা সেজে সেই দিকদিয়ে নিয়ে আসতো।এবং গেরিলা হামলা চালাতো।আমরা এসব কাহিনী শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠতাম।এইভাবে এসে গেল ১১ই ডিসেম্বর। আমরা বাচ্চারা প্রতিদিনকার মতো ক্রিকেট খেলছিলাম।হঠাৎ বিকেলের আকাশে দেখা গেল ২/৩টা যুদ্ধবিমান চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।আমরা ভাবলাম এদেশের বিমান হবে হয়তো।কারন তার আগেরদিন শুলেছিলাম জামালপুর জেলা মুক্তিসেনারা দখল করে নিয়েছে।আমরা আবারো খেলায় মনযোগ দিলাম। কিন্তু কিছুক্ষন পর দেখা গেল সারি সারি ভারি বিমান আমাদের মাথার উপড় দিয়ে ধীর গতিতে উড়ে যাচ্ছে, আর সেই ফাইটার বিমানগুলো ঘুড়ে ঘুড়ে পাহাড়া দিচ্ছে।আমরা খেলা ছেড়ে অবাক হয়ে এই শত শত সারিবদ্ধ প্লেনের দিকে হা করে তাকিয়ে ভাবছিলাম এর গন্তব্য কোথায়?একটু পরেই দেখলাম প্রতিটা বিমান থেকে বেঙের ছাতার মতো হাজার হাজার সৈন্য প্যারাস্যুট (পরে নামটা জেনেছিলাম)নিয়ে লাফিয়ে পড়ছে! আমরা দৌড়ে গিয়ে জীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারীদের জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি? তারা বললো “ডরো মাত উনলগ চীন ছে আয়া, হামলোগকো হেল্প করনে কে লিয়ে”।আমরা বিশ্বাস করলাম এই কারনে যে তারা (প্যারাট্রুপার)ডিস্ট্রিকের দিকে নামতে ছিল।
টাঙ্গাইলের পুংলীতে ভারতীয় বাহিনীর অবতরন
এই এক বয়স ছিল,আমরা ভো দৌড় সেই চাইনিজ আর্মী দেখবো বলে।দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা যখন কুমুদিনী মহিলা কলেজের নিকট(ডিস্ট্রিক বোর্ডের কাছাকাছি) এলাম চোখে পড়লো মিলিটারি ও রাজাকাররা পজিশন নিতে ব্যস্ত! আমরা এক রাজাকারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ঐ বেঙের ছাতাগুলো কোথায় নামছে?সে আমাদের ধমক দিয়ে বললো ভাগ জলদি ওগুলি ইন্ডিয়ান আর্মী।আমরা তখন ভয় পেয়ে গেলাম এবং যে যার বাড়ীর দিকে উল্টো দৌড়াতে লাগালাম।
কিছুক্ষন পর রাস্তায় যেতে যেতেই দেখলাম মিলিটারিরা ট্রাকে/জীপে করে ঢাকা অভিমুখে ভাগা শুরু করেছে।যৌথ বাহিনী নাকি দুই ঘন্টার সময় দিয়েছিল তাদের ভেগে যাওয়ার জন্য।আমি যখন বাসায় পৌছলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে,দেখি ছোটরা সবাই মাটির বাংকারে আশ্রয় নিয়ে আছে আর আম্মা-আব্বা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এতক্ষনে সবাই জেনে গিয়েছে টাংগাইল শহর এখন মুক্তিসেনা ও ভারতীয় সেনাদের দখলে।কিন্তু মিলিটারিরা যেতে যেতে আমাদের আক্রমনও করতে পারে এই ভেবে কেউ বাড়ীর বাইরে যায়নি বা সেই রাতে আনন্দ মিছিলও বের হয়নি।তবে মুক্তিসেনারা স্টেনগানের গুলি আকাশে মেরে প্রায় সারা রাতই আনন্দ উল্লাস করেছে।আমি ঘুম থেকে খুব সকালে উঠেই রাস্তায় নেমে এলাম। সারা রাস্তা তখন মুক্তিসেনা আর সাধারন জনতার মিছিলে মিছিলে ভরপুর। অনেক ট্রাক মিছিলও বের হয়েছিল,আমি অনেক চেস্টায় একটা ট্রাক মিছিলে উঠে পড়লাম।শ্লোগান ধরলাম জয় বাংলা,তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব,জেলের তালা ভাংবো শেখ মুজিবকে আনবো,মুক্তিযোদ্ধা লও ছালাম,মুক্তি যুদ্ধের মহানায়ক লতিফ সিদ্দিক।এই পর্যায়ে আমাদের ট্রাক হাত উচিয়ে একমুক্তি যোদ্ধা শুধরে দিলেন,বলো কাদের সিদ্দিক।প্রকৃতপক্ষে আমরা জানতাম লতিফ সিদ্দিক টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার কিন্তু যুদ্ধের পরে জানলাম তিনি কলকাতার গিয়ে বসে ছিলেন।আর তার ছোটভাই কাদের সিদ্দিক এই মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করে মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাঘা সিদ্দিকী খেতাব পেয়েছেন। আমরা লতিফ সিদ্দিকীকে চাক্ষুষ দেখলেও কেউ কাদের সিদ্দিকীকে দেখিনি আর যুদ্ধের আগে তার নামও শুনিনি।তাই তাকে দেখার আশায় এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগলাম।
বিকেলে আমাদের সেই ক্রিকেট খেলার মাঠে দেখলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়েছে।সেখানে এই প্রথম শিখ ধর্মের লোক দেখলাম।তারা আমাদের দেখে নাম জিজ্ঞেস করে চানার ডাল ও রুটি খেতে ডাকলো,আমরা ঘুড়ে ফিরে তাদেরকে দেখতে লাগলাম।সেখানেই শুনলাম কাদের সিদ্দিক পরদিন বিন্দুবাসিনী স্কুলের মাঠে বিজয় উৎসব করবেন।আমরা খুশী হয়ে বাড়ীতে গিয়ে খবরটা জানালাম।
বংগবীর বাঘা সিদ্দিক
পরদিন সেখানে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষের ঢল।স্কুলের ছাদে স্টেজ বানিয়েছে।মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত করিম, সবুরখান(তিনি রাজমিস্ত্রি ছিলেন) , ব্রিগেডিয়ার ফজলুসহ নাম মনে নেই আরো অনেকেই ছাদের উপড় দাঁড়িয়ে আছেন।আমি ও আমার আসপাশের সকলের চোখই তখন খুজে ফিরছিল সেই কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিক ওরফে বাঘা সিদ্দিককে দেখার জন্য। জনসভার প্রায় সবাই এসেছে একনজর কাদের সিদ্দিককে দেখবে বলে! অবশেষে তিনি এলেন একদল দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে।দেখলাম ২০/২২ বছরের তরুন লম্বা-পাতলা দেহের মাথায় কুকড়ানো চুল আর তাতে ছিল হেট,হাতে একটা বেত ও পড়নে ছিল খাকি রঙ্গের আর্মী ড্রেস আর তাতে অনেক প্রকার ব্যাজ লাগানো।তিনি স্টেজে ঊঠার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার জনতা তার নেমে জিন্দাবাদ দেয়া শুরু করলো।তিনি খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে ভাষন দিলেন।তিনি বলেছেলেন যুদ্ধ শেষ হয়নি,ঢাকাসহ সারা বাংলা মুক্ত করতে হবে, শেখ মুজিবকে করাচি থেকে মুক্ত করে তবেই যুদ্ধ শেষ হবে।রাজাকারদের অত্যাচারের কথা বলে তাদের ক্ষমা না করার কথা দেন।টাঙ্গাইলের বড় রাজাকার খালেক প্রফেসরকে ৭০হাত মাটির নিচ থেকে হলেও ধরে এনে শাস্তি দেয়ার ঘোষনা দেন।তারপর সেখানে উপস্থিত করেন নাগড়পুরের রাজাকার কমান্ডার নজরুল ও টাঙ্গাইল শহরের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার খোকাকে।জনতাকে তিনি প্রশ্ন করেন এদের শাস্তি কি হতে পারে? সবাই সমস্বরে রায় দেন মৃত্যু।তিনি প্রথমে নজরুলকে তার পাশের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের হাতে তুলে দিলেন তারা কালক্ষেপন না করে তাকে বেনয়েট দ্বারা প্রকাশ্যে চার্জ করে নিচে ফেলে দিলেন।উত্তেজিত জনতা বাকী কাজ পায়ে দলিত করে শেষ করলেন। তারপর নিয়ে আসা হলো কুখ্যাত রাজাকার খোকাকে,ব্রিগেডিয়ার ফজলু তার লম্বাচুলে ধরে টান দিতেই রাজাকারের ঘাড়টা ভেঙ্গে গিয়ে হেলে পড়লো, তারপর বুকটা পেছন থেকে টান দিয়ে ভেঙ্গে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিলেন,উপস্থিত জনতা তাকেও পদদলিত করলেন।যারা কম জোরের লোক ছিল তারা দিকবিদিগ ছুটোছুটি করে চলে গেল।এভাবেই শেষ হলো সেদিনকার জনসভা।
পরদিন মুক্তিসেনারা ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিলে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দিলেন যুদ্ধের জন্য।এবং দুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানী বাহিনী সারেন্ডার করার পর আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।
প্রথম পর্ব
Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব
Click This Link