somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশে তখন জোছনা ছিল

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দরজা খুলে দেবার পর আসিফ একবার নীরার দিকে তাকাল। টকটকে লাল চোখে আসিফ কিছু একটা বলতে চাইলেও মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলনা। টলতে টলতে পড়ে যাচ্ছিল, নীরা ধরল তাকে। ড্রাইভার কিছু না বলে নীচে চলে গেল। আসিফকে জড়িয়ে ধরে সে বেড রুমে নিয়ে আসল। বিছানায় শুইয়ে দিল, জুতা খুলে নিল। আসিফের কোন হুশ নেই তখন।

বেডরুমের লাইটটি বন্ধ করে দিয়ে নীরা ব্যালকনিতে এসে রকিং চেয়ারটাতে বসল। কলিং বেলের শব্দ হওয়ার আগেও সে এখানেই বসে ছিল। বাইরে জোছনার বান ডেকেছে। ঘোর লাগানো জোছনা। এমন জোছনায় নিজেকে ধরে রাখা বড্ড কঠিন। মন আকুপাকু করে, ছুটে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে অসীমের মাঝে । কি যেন একটা পাখী আছে নাম মনে করতে পারছেনা, মৃত্যুর আগে সে অসীম পানে উড়তে শুরু করে, নীরার ও ঠিক এমনটিই ইচ্ছা করছে, এমন জোছনা মাতাল রাতে সোজা অসীম পানে উড়ে যেতে।

আসিফের কথা মনে পড়তেই নীরার মনটা খারাপ হয়ে গেলে। ও আজকে আকন্ঠ ডুবিয়ে মদ খেয়ে এসেছে। মদ খেয়েছে নীরা এই জন্য মাইন্ড করেনি, আসিফের এ ধরনের কোন অভ্যাস ও নেই। বছরে দুতিনবার সে এ কাজটি করে অফিসের কোন ককটেল পার্টি থাকলে তখন। নরমালি সে মদের আশেপাশেও হাঁটেনা। স্বামী হিসেবেও ওর বিরুদ্ধে তার কোন কমপ্লেইন নেই। সত্যিকথা বলতে কি দাম্পত্য জীবনে তাদের বোঝাপড়া খুবই ভাল, এবং তারা যে সুখী এটা তাদের আচরনেও প্রকাশ পাই।

নীরার মন খারাপ এমন রুপালী রাতে বের হতে না পারার জন্য। প্রায় প্রতিটি পূর্ণিমার এমন রাতে ওরা দুজন গাড়ী নিয়ে বের হয়ে পড়ে। সোজা আশুলিয়ার দিকে ছুটে যায়, বিলের মাঝখান দিয়ে যাওয়া রাস্তাটায় যখন গাড়ী ছুটে যায় তখন দুপাশের মায়াবী দৃশ্যে যে কারও মাথা খারাপ হয়ে যাবে। নিসর্গপ্রেমীর জন্য এর চেয়ে ভাল কোন দৃশ্য হতে পারেনা। দুপাশে টলটলে পানি, তাতে যেন রুপালী আলো গলে গলে পড়ছে। নীরার তখন ইচ্ছে করে ইশ যদি ঐ আলোটাকে ধরা যেত, সে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায় ঝরে পরা জোছনা।

আসিফ যে খুব ভাল আবৃত্তি করে তা না, বলতে গেলে সেটা আবৃত্তিও হয়না। তবুও সে কস্ট করে নজরুলের চাঁদ নিয়া লেখা কিছু কবিতার লাইন সে মুখস্ত করে ফেলেছে। এমন জোছনা মাতাল রাতে তারা যখন ঘুরতে বের হয় দুজনে খুব বেশী কথা বলেনা। আসিফ চুপচাপ গাড়ী চালাতে থাকে, আর নীরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ইন্জিনের হালকা শব্দ আর হঠাৎ হঠাৎ ছুটে যাওয়া বিপরীত ডিক থেকে আসা গাড়ীর শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ থাকেনা এসময়। এমন নীরবতা ভেঙ্গে আসিফ হঠাৎ করে দুয়েকটি লাইন বলে উঠে, আনমনা নীরা হঠাৎ চমকে উঠে, তখন আসিফ লাইন গুলো আবার বলে।

রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে নীরাও আজ সে লাইন গুলোয় মনে মনে বলে:

আবার ভালোবাসার সাধ জাগে
সেই পুরাতন চাদ আবার নতুন লাগে । ।

এই লাইন দুটো তার অনেক পছন্দের।

আসিফের কোট করা আরোও কিছু লাইনের মাঝে আছে

আধো রাতে যদি ঘুম ভেংগে যায় চাদ নেহারিয়া প্রিয়
মোরে যদি মনে পড়ে বাতায়ন বন্ধ করে দিয়ো । ।

এই লাইন দুটো শুনলে নীরার মন খারাপ হয়ে যায়।

ঠিক বীলের মাঝ খান দিয়ে যখন তারা যায় তখন আসিফ বলে উঠে,

চাদ হেরিছে চাদ মুখ তার সরশীর আরশিতে
নাচে তরংগ , বাসনা ভংগ , সেই অংগ পরশিতে । ।

নীরা এর মানে না বোঝায় সে ব্যাখ্যা ও করে দেয়: : চাদ তার রুপ পৃথিবীর নদীতে দেখছে... কিন্তু নদীর পানি নড়ে ওঠায় সে আশা ভংগ..

ভাবতে ভাবতে নীরার মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। সেও আওড়াতে থাকে:

কেউ জ্বালে না আর আলো ,
তার চির দুখের রাতি
কেউ দ্বার খুলে জাগে
চায় নব চাদের তীথি
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
অতীত দিনের সৃতি । ।

নীরা চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে বেডরুমে। জানালা দিয়ে আসা আলোয় আসিফের মুখের দিকে তাকায়, হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে অগোছালো হয়ে সে ঘুমুচ্ছে। মনে মনে ভাবে পার্টিটা আজকে না হলেই কি হতনা, আর অন্য কোন দিন কি ছিলনা। আবারও সে বারান্দায় এসে বসে। হঠাৎ করে তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়।

মদ কি জিনিস সে তখন বুঝতনা। টিভিতে বাংলা সিনেমায় দেখত কিছু লোক ঢকঢক করে বোতল থেকে লাল রং এর পানি খেয়ে মারামারি করত। বাবা মার কাছে জানতে চাইলে তারা বলেছিল এটা মদ, খারাপ মানুষরা খায়, খেয়ে মারামারি করে।এর কিছু পরের ঘটনা।

তখন সে টু কি থ্রীতে পড়ে। বাবার সাথে সে মাসুদ আংকেলের বাসায় গিয়েছিল। মাসুদ আংকেলের মেয়ে রুবী আপু তখন ফাইভে পড়ে। আংকেল আপুকে ডেকে বললেন মা নীরা মামণীকে তোমার সাথে নাও, আর চকলেট খেতে দাও। রুবী আপু তাকে নিয়ে বাবার বেডরুমে গিয়ে ছোট্ট একটা ফ্রীজ খুলে চকলেট বের করে দিল। হঠাৎ সে ফ্রীজে থাকা কয়েকটি বোতলের দিকে তার চোখ পড়ল। রুবী আপুর কাছে জানতে চাওয়ায় সে বলল এটা মদ। নীরা যেন আকাশ থেকে পড়ল, মদ কে খায়। রুবী জানাল আমার বাবা মাঝে মাঝে খায়। তোমার আব্বুতো তাহলে খারাপ মানুষ নীরা সোজা বলে বসল। রুবী ক্ষেপে গিয়ে বলল আমার আব্বু খারাপ না, তোমার আব্বুও তো খায়। নীরা তড়িৎ জবাব দেয় না, আমার আব্বু এসব বাঝে জিনিস খায়না। রুবী তখন তাকে বলে, যেদিন দেখবে তোমার আব্বু অনেক রাত করে বাড়ি ফিরছে বুঝবে সেদিন তোমার আব্বুও মদ খেয়ে এসেছে। মদ খেলে মুখ দিয়ে গন্দ বের হয়, তারপর দেখবে তখন তোমার আব্বু তোমার আম্মুকে বকাঝকা করছে। নীরা প্রতিবাদ করে বলল আমার আব্বু কখন ও রাতে দেরী করেনা, আর আমার আম্মুকেও বকেনা।

সেদিনের পর থেকে নীরা যেন অপেক্ষা করতে থাকে কোন দিন তার বাবা দেরী করে ফিরবে সে দিনটার জন্য। হঠাৎ করে একদিন দশটা বেজে যাবার পরও তার বাবা বাসায় ফিরে আসেনি। সে নিশ্চিত হয়ে গেল আজ তার বাবা মদ খেয়ে বাড়ী ফিরবে। কান্না কান্না গলায় মার কাছে জানতে চাওয়ায় মা বলল আজ তোমার আব্বুর অফিসে অডিট চলছে, তাই দেরী হবে। অডিট কি সে তখন ও বুঝেনা, তার শুধু মনে হতে লাগল আজ তার বাবা মদ খেয়ে ফিরবে।

এগারটা বেজে যাবার পর সে পুরোপুরি কান্নাকাটি শুরু করে দিল। অনেক বার জানতে চাইবার পরও সে মাকে কিছু বললনা, শুধু একটা কথায় বলতে লাগল বাবা আসতেছেনা কেন, ঘুমোতে যেতেও সে রাজী হয়নি।

অনেকক্ষন পরে তার বাবা বাসায় ফিরল। নীরা তখন বেডরুমের খাটে বসে আছে, চোখ ছলছল। বাবা বেডরূমে ঢুকতেই সোজা বাবার চোখে চোখে তাকিয়ে বলল বাবা তুমি এদিকে আস। তার মা পাশ থেকে বললেন তোমার মেয়ে অনেকক্ষন ধরে কাঁদছে, কি কারনে সেটা আমাকে বলছেনা, তুমি দেখ।

নীরা খাটের উপর দাঁড়িয়ে গেল, তবুও বাবা তার চেয়ে লম্বা। সে কোন কথা না বলে বাবার টাই ধরে টান দিল, বাবা বললেন কি হয়েছে মা। তোমার মুখটা আমার মুখের কাছে আন, কোন কথা না বলে বাবা ও মুখ এগিয়ে দিলে হয়ত মেয়ে চুমু দিবে ভেবে।

সাথে সাথে নীরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল আর বলল তোমার মুখ থেকে কোন গন্ধ বের হচ্ছেনা কেন। মদ খেলেত গন্ধ বের হবার কথা। বাবাত অবাক, আর তার কান্না বাড়ছেই। বাবা বলল মা এসব কি বলছ। হ্যাঁ রুবী আপু আমাকে বলেছে , বাবারা অফিস থেকে দেরী করে ফিরলে তখন তারা মদ খেয়ে আসে, মুখ দিয়ে গন্ধ বের হয়।

নীরার বাবা মা দুজনের চোখই বিস্ফোরিত, মেয়ে এসব কি বলছে। বাবা তাকে কোলে তুলে নিলেন, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন কি হয়েছে মা বলত। তখন সে সব খুলে বলল।

সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতে নীরা নিজে নিজেই হেসে উঠল।

একাকী বসে থাকতে তার আর ভাল লাগছেনা। সে উঠে এল । বেডরুমে ঢুকেই তার আসিফের মুখ খানা চোখে পড়ল, তাতে জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো পড়ে কি যে মায়াময় লাগছে, নীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আসিফ দেখলে বুঝত কি গভীর ভালবাসার দৃষ্টিতে নীরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কতক্ষন ধরে অমন করে তাকিয়ে আছে নীরা জানেনা, হঠাৎ করে তার নজরুলের লেখা আরেকটি লাইন মনে পড়ল,

কলংক ও জোস্নায় মিশা তুমি সুন্দর চাঁদ ।।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৩৩
২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×