ভাবনামা : ৫
দেশ জুড়িয়া কৈফিয়তের বোর্ড বসিয়াছে। সূর্যমুখি থেকে সূর্য বিমূখি হওয়া পর্যন্ত যেন মুক্তি নাই- কৈফিয়ত চলে।
এখন কি করিতেছেন?
বলিলাম, লেখা-লেখি।
পুনরায় জানিতে চাওয়া, কোন কাগজে?
বলিলাম, কোন কাগজে না।
উত্তরে ব্যর্থ। কেননা, বোর্ড অধিবাসিরা লেখা-লেখি বলিতে বুঝিয়া থাকে রিপোর্টিং অর্থাৎ সাংবাদিকতা।
বুঝিলাম, বই লেখা, লেখা-লেখি নয়। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা, ইতিহাস, গবেষণা কোন কিছুই লেখা-লেখি নয়, তথা কাজও নয়; যদি তাহা মাইনেভুক্ত কাগজে ছাপা না হয়। আর বুঝিলাম লেখা-লেখির দোকান আছে, যেখানে ‘ছাড়পত্র’ দেয়া হয়; লেখক ছাড়পত্র। খুঁজিতে থাকিলাম, সে ছাড়পত্র কে দেয়! বোর্ড অধিবাসিরা না কি দোকানদার? বুঝিলাম, মূলত দোকানদার; আর বোর্ড অধিবাসিরা দোকান নির্মিত। আরো খোলসা করিয়া বলিলে, পত্রিকা বা মিডিয়াই এই দোকানি-- যাহারা ছাড়পত্র দিলেই হয় লেখক, না দিলে নয়। খেয়াল করিলাম, প্রতিষ্ঠিত হাটে দোকানি কাহাকে ছাড়পত্র দেয়-- যে, দোকানির বমি গলধকরণ করে, আর প্রয়োজনমত তাহা উগরায়। আর দোকানির ঔরসজাত বোর্ড অধিবাসিরা ঐ বমি চাটিয়া চাটিয়া বলে, ‘আহা! কি লেখায় না পড়িলাম!!’
এবার মনে হইলো, মোর পরিচয় লেখক না হওয়ায় ভাল। কারণ, আমি কাজ করিয়া থাকি, সুতরাং মোর পরিচয় হইবে কাজী। কেননা, কর্ম করিলে কর্মী হয় সেহেতু কাজ করিলে কাজী।
কিন্তু ধাঁধার যেন শেষ হইল না; কারণ কাজ কি? কাজের ব্যাকরণ লইয়াও গোল বাধিল-- ‘ইহা নয়, উহা কাজ; উহা নয়, ইহা...’ গোলের আর শেষ নাই! কেহ বলিল, মাঠে চাষ কাজ; কেহ বলিল, মিলে লেবারি কাজ; কেহ বা বলিল, আফিসের কেরানীগিরি কাজ...
পাল্টা পক্ষ উল্টা বলিল, তাহা হইলে তো মল ত্যাগও কাজ, খাদ্য খাওয়া, ঘুমপড়া, যৌন কর্মও কাজ।
ছিঁ-ছিঁ, কিসের মধ্যে কি! মূল পক্ষ বুঝাইয়া বলিল, ঐ সবই তো ব্যক্তিগত-জৈব সত্তার সুখ।
পাল্টা পক্ষ গুছাইয়া আনে, চাষের ফলন, লেবারির মুজুরি আর কেরানীর বেতন কি আপনা দেহদীগের সুখ নিমিত্তে নয়?
গোল আরো উত্তপ্ত হইল। উত্তপ্ত গতির মিথষ্ক্রিয়ায় নতুন ব্যাকরণ জন্মিল।
‘কাজ হইল তাহায়-- যাহা উপাসনা অথবা জেহাদ।’ লেখা-লেখিই উপাসনা যাহা, তুলিয়া ধরে দোকানির খোলনলচে। প্রতিস্থাপিত করিয়া থাকে তাহাদের পণ্ডিতি ব্যাকরণের স্থলে প্রকৃতির কানুন-- যেখানে পতি’র মৃত্যু ঘটিয়া থাকে, দাস-প্রভুর বিলোপ হইয়া থাকে, ঘুচিয়া যায় অহমের আশরাফ, সকল মাকলুকাত হইয়া ওঠে সম-অনিবার্য। লেখনির কাজ তো ইহাই। ফলে, পত্রিকার বিপরীতে পত্রিকা, লেখার বিরুদ্ধে লেখা, এইখানে নাজেল হওয়া ক্ষেত্রের নাম ‘জেহাদ’। এই জেহাদে অংশ নেয়ায় কাজ। বোর্ড অধিবাসীরা যত দ্রুত এই কাজ বুঝিতে পারিবে তত তাড়াতাড়ি তাহারা গাঁথুনি শুরু করিবে আপনার ইতিহাস-- মানুষের ইতিহাস।
১৮ সেপ্টেম্বর ০৯, যশোর।