somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্র ভাবনা-১

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবিঠাকুরের কবিতায় আমিত্ব

[অল্প পানির মাছ নাকি বেশি লাফায়| খাঁচায় বন্দী পাখির শুনেছি আকাশ সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান| বিজ্ঞজনেরা হয়ত এই লেখার সমালোচনা করারও প্রয়োজন বোধ করবেন না| একুরিয়ামের মাছেরো তো সমুদ্র অবগাহনের সাধ হয়, খাঁচায় বন্দী পাখিরও তো মেঘের সাধে মিতালীর সখ হয়| বোধ করি আমারও রবিঠাকুরের কবিতা নিয়ে লেখার সাধ ও সখ উভয়ই হয়|]

বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোমান্টিক কবি | আঠারো শতকের শেষের দিক থেকে যখন প্রচন্ড শিল্পবোধ মানুষকে তাড়িত করা শুরু করে তারই স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় তার লেখনীতে | 'আমার আমি' বা 'me on mine' রবিঠাকুরের চেতনার মধ্যে ছিল | আমার আমি বোধের একটি নিদর্শন --

"আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুন্নি উঠল রাঙ্গা হয়ে
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠল আলো পুব পশ্চিমে
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম 'সুন্দর'
সুন্দর হল সে | "

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এই কবিতাংশ সম্পর্কে এভাবেই ব্যক্ত করেন--
"কথাগুলো সুন্দর, কিন্তু এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে রোমান্টিকের ভয়ংকর আমিময়তা বা অহমিকা | তিনি কোন কিছুকেই বস্তুগতভাবে মেনে নিচ্ছেন না, স্বীকার করছেন না কারো নিজস্ব বৈশিষ্টকেই; সব কিছুতে তিনি সঞ্চারিত করে দিচ্ছেন নিজেকে | পান্না চুনির নিজস্ব রং যেমন স্বীকার করছেন না, তেমনি স্বীকার করছেন না সূর্যকে ও গোলাপের সৌন্দর্যকে; তাঁর কাছে এসবই তার নিজের সত্তার সম্প্রসারণ |"
কর্তৃবাচ্যের এই প্রাধান্য কবির লেখনীতে বারবার চোখে পড়ে | 'দুই বিঘা জমি' তে কবি যখন নিজেই উপেন হন, তার মাঝে যে দারিদ্র্য-দীনতা-অসহায় ফুটে উঠে তার প্রভাবেই তিনি কেঁদে উঠেন --
"কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই
চেয়ে দেখো মোর আছে বড় জোর মরিবার মত ঠাঁই |"

আবার যখন স্ফুলিঙ্গে গেঁয়ে উঠেন--
"আমি ছিলাম যে বনে সেথায়
গোলাপ উঠিল ফুটে
'ভুলে না আমায়' বলিতে বলিতে
কখন পড়িল লুটে | "

এখানে ফোঁটা গোলাপের সৌন্দর্য মুখ্য নাকি 'গোলাপকে কবির মনে রাখাটাই' প্রধান সেটা আমীমাংসিত প্রশ্ন | কিন্তু ভুলো না আমায় যে একেবারে ফুটন্ত গোলাপের কাছে নগণ্য নয় তা খোলা চোখেই বোঝা যায় | তাই কবি প্রকৃতি পূজারী হয়েও দেবতা, তাপসী হয়েও ভোগবাদী |

কবি কখনো দ্রোহী | কখনো মনে মনে তিনি শিকল ভাঙতে চান | নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে তিনি ব্যাকুল | বিস্ময়ে-বিদ্রোহে-যন্ত্রনায় কবি নিজেকে করেন প্রকাশিত |

"আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগত প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা |"

আধুনিক চেতনার একটি বড় দিক হচ্ছে এই আমিত্ববোধ | মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগকে যেসব বৈশিষ্ট দিয়ে পৃথক করা হয় তার মধ্যে এই আমিত্ব বা আরো বিশাল অর্থে ব্যক্তি স্বাধীনতা কে উল্লেখ করা হয় | আমার মাঝে আমি ই সেরা | এই বোধ বোধ-করি প্রত্যেক মানুষের মাঝেই বিরাজ করে | কিন্তু এর প্রকাশ দুঃস্বাধ্য | রবি ঠাকুর যা করে গেছেন অনায়াসে |
কবির 'আমিত্ব' সবসময় যে প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী হবে তা কিন্তু নয় | কবি কখনো ভুগেছেন প্রচন্ড একাকীত্বে | কখনো বা কবি হয়েছেন স্বপ্নচারী | পরিচয়হীনতা প্রায়ই তাকে গ্রাস করেছে | নিমেষে তিনি বলে উঠেছেন --

"আমি এসেছি নিমেষে, যাইব নিমেষে বই,
আমি আমারে চিনি নে, তোমারে জানি নে,
আমার আলয় কই |"

আমার আমি কে চেনার সেই সুপ্রাচীন দুঃস্বাধ্য অভিপ্রায় কবির মাঝে লুক্কায়িত ছিল | তাই আপন আলয় নিয়ে তিনি সন্দিহান | কবির এই একাকীত্বের পিছনে আছে তার স্বপ্নিল নিস্বঃঙ্গ জগত , যেখানে একই মঞ্চে মঞ্চায়িত হচ্ছে চেনা নাটক অচেনা কুশীলবে | আর সেই কুশীলব সবই কবি নিজে | তাই নিজেকে তিনি প্রকাশিত হতে দেখেন হরেক রূপে, হরেক ভাবে, হরেক স্বভাবে | আবারো অবাক ভাবে দেখি কবিকে নিজের পরিচয় স্বন্ধানে ব্যস্ত –

“সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া |
দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া |”

কবির এই স্বপ্নিল জগতে কখনো ঝড় উঠে | কবি নিজেকে আবিষ্কার করেন অবহেলিত ,প্রচন্ড অসহায়তায় ভুগেন তিনি |অন্তর্নিহিত সম্পদ কে লুন্ঠিত হতে দিতে চান না | আকুতি ফুঁটে উঠে –

“একখানি ছোট খেত আমি একেলা”
অথবা,

“ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি|”

কবি অবগাহিত আমিত্ববোধের বিশাল আবেগে| যেখানে এক রাজ্য, এক পৃথিবী| যেখানে এক রাজা এক কবি, যেখানে দ্রোহে কবি, প্রেমে কবি, জন্মে কবি, মৃত্যুতে কবি, চেতনায়-সঙ্গীতে-মননে কবি নিজেকেই খুঁজে পান| যেখানে কবি স্ববিরোধী| কবি আহবান জানান, কখনো অবজ্ঞা করেন আবার কখনো অনুরোধে সিক্ত হন| বলে উঠেন—

“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে”
অথবা,
“মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ”

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:২০
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×