somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন সাধারণ বাবার অতি সাধারণ গল্প!

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(২০০৯ বাবার একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি। সেই অধ্যায়কে নিজের কাছে স্মরণীয় করে রাখতেই এই পোষ্টের অবতারণা)


ছেলেরা একটু মা- ঘেষাঁ হয় আর মেয়েরা বাবা। এটাই নাকি নিয়ম। আমদের ভাইদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমরা তিন ভাই মা বলতে অজ্ঞান। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমার বাবার পোঁড়া কপালই বলতে হবে, কারণ আমাদের কোনো বোন নেই। একটি বোনের জন্য নিদারুণ হাহাকার আমাদের সর্বক্ষণ তারপরও বাবার জন্য আমাদের কারো মনেই তেমন কোনো আফসোস নেই।

আর আমাদের তিন ভাইয়ের এই মা মা স্বভাবের জন্য বাবার মনে ঈর্ষারও কোন কমতি নেই। আম্মু বলেন হিংসা। মা আর আমরা তিন ভাই যখনি একসাথে কোনো বিষয়ে হাসিঠাট্টা বা আড্ডায় মাতি অতি অবশ্যই বাবা এসে দিবেন ঝাড়ি। সারাদিন কিসের এত গল্প গুজব! আর কোনো কাজ নাই? মা পাল্টা ঝাড়ি দেন, তোমার অসুবিধা কি! আমরা একসাথে গল্প করলে কি তোমার হিংসা হয়? আমার হিংসা হবে কেন? এই যে তোমার সাথে কেউ কথা বলে না, সারাদিন কী সব হিসাব কষো (বাবা একাউন্টসে ছিলেন) আর একলা একলা ঘোরো - মা বলেন। আমার সাথে কারো কথা বলার দরকার নাই বলেই বাবা মুখ গোমড়া করে তাঁর নিজের রুমে চলে যান।

বাবার জন্য আমাদের করুনা যে একেবারেই হয়না তা নয় কিন্তু কি করব! যতই দিন যাচ্ছে বাবার কাছ থেকে আমরা ততই যেন দুরে সরে যাচ্ছি। মার সাথে আমরা যতটা ঘনিষ্ট বাবার সাথে দুরুত্ব ঠিক ততটাই। এবং দিনকে দিন এই দুরুত্ব যেন বেড়েই চলেছে। পারতপক্ষে এখন আমরা উনার ছায়াও মাড়াইনা কোন বিশেষ কাজ না থাকলে। অবশ্য এজন্য আমাদের মোটেও দোষ দেয়া যাবেনা, দোষটা উনার অতিমাত্রার বাজখাঁই স্বভাবের। কথায় কথায় ধমক আর ছেলেদের অপদস্হ করে যিনি স্বর্গীয় সুখ পান, ছেলেরা তাঁর কাছ থেকে ''একশ হাত দুরে থাকুন'' নীতি অবলম্বন করে চলবে সেটাইতো স্বভাবিক।

বাবা আধা সরকারী চাকুরী করেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। ২০০৯ এর শুরু হতেই এলপিআর এ আছেন, এ মাসের ৩১ এ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অফিসে যাওয়ার ঝামেলা নেই তাই পুরো সময়টাই বাসায় কাটান আর মাকে জ্বালিয়ে মারেন। এটা এখানে কেন? ওটা সেখানে কেন? সারাদিন রান্নাঘরে কি কর ? মা এসে যে একটু টিভি দেখবেন তারও উপায় নেই, রিমোট বাবা কিছুতেই হাত ছাড়া করবেন না। সারাক্ষণ সংবাদ নয়ত ফুটবল খেলা। মারও আর হিন্দী সিরিয়ালের বউ শাশুড়ির ঝগড়া আগের মতো দেখা হয়ে উঠেনা। ইদানিং প্রায়ই বাবা মার রিমোট কাড়াকাড়ির দৃশ্য চোখে পড়ে।

আমার বাবার বরাবরই দয়ামায়া একটু কম, সীমার টাইপ যাকে বলে। যেটুকু দেখাতেন মা তার নাম দিয়েছেন 'আলগা দরদ'। পড়ালেখার জন্য কত মারই না খেয়েছি উনার হাতে। ক্লাস সিক্স সেভেন পর্যন্ত আমাদের বড় দুভাইয়ের পিঠ উনি জেব্রাক্রসিং বানিয়ে রেখেছিলেন। শুক্রবার ছিল আমাদের জন্য বিশেষ আতংকের একটি দিন। বাবা ঐদিন বাসায় থাকতেন আর আমাদের দু ভাইকে ইংরেজীতে রচনা আর দরখাস্ত লিখতে দিতেন, পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন যমের মতো বেত হাতে। বানান ভুল হলেই.........। কেয়ামতের দিনও মনে হয় অতটা আতংকের হবেনা যতটা আতংকে কেটেছে ঐ বন্ধের দিন গুলো। অবশ্য খেলাধূলা আর দুষ্টামির জন্য উনি আমাদের মার তো দুরের কথা বকাটিও দেননি কখনো। এই একটা ব্যাপারেই উনার ছিল দয়ার শরীর।


প্রতিবার ঈদ আসলেই দেখতাম উনি একটা ভাব নিতেন। সবার সাথে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছেন, কথায় কথায় ঝাড়ি দিচ্ছেন। ঘরের ভেতর কেমন একটা আতংক আতংক ভাব যেন যে কোনো মূহুর্তে সুনামি আসবে। এই ভাবটা নিতেন যেন ঈদে আমরা বেশী কিছু চেয়ে না বসি। সীমিত আয়ের সীমিত বাজেট কিন্তু ঐ কিশোর বয়সটা কি অত কিছু মানত না বুঝতে চাইত। ঠিকই জামা কাপড় বেশী বেশী আদায় করে ছাড়তাম। মা তখন বাবাকে বলত, ''এই কদিন কেন তাহলে ভং ধরলা। ঠিকই ত খরচ করলা, বরং বেশীই করলা। ঐ যে বলে না গাধায় পানি খায় ঘোলাইয়া।'' বাবা সবই বুঝেন কিন্তু একই ভুলটা পরের ঈদেও করেন।

আর বাবার কথাবার্তার ছিরিও মাশা‌ল্লাহ্‌। একটা উদাহরণ দেই। বন্ধু ও সহ ব্লগার (আহমেদ) রাকিব চাকরী সূত্রে ঢাকায় থাকে। ছুটিতে কলোনীতে এসেছে আর এসেই আমার বাসায়। হয়তো আব্বুর সামনে পড়ে গেছে।
- কি রে কি খবর তোর? কবে আসলি ঢাকা থেকে?
- জ্বী আঙ্কেল ভাল। গতকাল আসছি।
- এইখানে কি মনে কইরা? ( কথার ছিরি দেখেন )
রাকিব হয়ত একটু থতমত খেয়েছে, পরক্ষনেই হেসে দিয়ে বলেছে, এখানে আসলেও কি মনে করে আসতে হবে নাকি আঙ্কেল। চতুষ কই ?
- নবাব শুয়ে শুয়ে বই পড়ে। ভিতরে যা। রাকিব ভিতরে এসেই বলে, তোর বাপ একটা চিজ!! আমি শুধু বলি, এ আর নতুন কি!

আগেই বলেছি আমার বাবা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা তিনি রস কষ দয়ামায়াহীন হিটলার টাইপ একটা মানুষ। মনে হবে আমাদের জন্য উনার মনে কোনো ভালোবাসাই নেই। সেইদিন কুরবানি ঈদের সকালে ছোট ভাইয়ের ফোন এসেছে বিদেশ থেকে। ব্যাংক একাউন্ট খোলা, ভার্সিটির ঝামেলা, নতুন বাসায় উঠা সব মিলিয়ে বেশ কিছুদিন ফোনে-নেটে সময় দিতে পারেনি। সেই ফোন ধরে বাবার সে কী কান্না। শিশুর মতো কেঁদেছেন! কোনো কথাই বলতে পারেন নি। আমি অবাক হয়ে শুধু চেয়ে ছিলাম, সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মা দেখি তখন নিজের কষ্ট ভুলে গিয়ে বাবাকে সামলাতেই ব্যস্ত।

বোধহয় বাবারা তাদের সমস্ত আদর-ভালোবাসা, মায়া-মমতা সব বড় একটা পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রাখেন। কোনভাবে পাথরটা সরে গেলে সব আবেগ অনুভুতি ঝর্ণাধারার মতো বেরিয়ে আসে।



(লেখাটার শিরোনাম পাল্টে দিলাম)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৯
৫৮টি মন্তব্য ৫৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×