somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাশের বদলে লাশ

৩০ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"ইন এ ওয়ে ইট অনলি রিফলেক্টস ওয়ান সিঙ্গেল ফ্যাক্ট, সোসাইটি ডাজনট চেঞ্জ এ লট, ইয়্যু কুড ট্রান্সফর্ম ইট এ লিটল বাট ইয়্যু সিম্পলি ক্যান্ট ট্রান্সলেট ইট ইন টু এ হোল নিউ লেভেল। "

যুদ্ধের কোনো কারণ নেই, এরপরও সংঘাতে লিপ্ত হয় মানুষ, খুব সামান্য বিষয়েই জিঘাংসু হয়ে উঠা মানুষের এই সংঘবদ্ধ চরিত্র ভয়ানক। এই ধারা নতুন কিছু নয়, মারো কিংবা মরো, একসাথে লেপ্টে থাকো, প্রতিহত কর প্রতিকূলত, বেঁচে থাকো, যেকোনো প্রকারে এবং যেকোনো পন্থায়, শুধু নিজের জেনেটিক নক্সা পরে প্রজন্মে পাচার করে দাও, এটাই স্বার্থকতা এটাই জীবনের মোক্ষ।

অবেশেষে যেকোনো গর্ভে নিজের সন্তান উৎপাদন করা এটুকুই জীবনের মৌল উদ্দেশ্য, এর বাইরে মানুষ কিংবা প্রাণীতে ইতর বিশেষ নেই কোনো। গোত্রপতি, দলপতি, সম্রাট, নেতা, নবী, রসুল এবং অন্য সব নেতৃত্ববাচক শব্দ শুধুমাত্র একটা সাধারণ অস্তিত্বের লড়াইয়ে মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়। কোনো নেতার জৌলুসে আচ্ছন্ন হয়ে কিংবা অন্ধ হয়ে মানুষ স্থানীয় বিবাদ আর গোত্রগত সংঘাত ভুলে যায় সাময়িক, তবে তেমন নেতার মৃত্যুর সাথে সাথে পুনরায় পুরোনো মৎস্যনায়।

সভ্যতা খুব বেশী আগাতে পারে নি, সত্য এটাই। আমাদের বাইরে পোশাকে আচারে পরিপাটি হয়ে উঠার বাস্তবতাও আসলে এই স্যকে আড়াল করতে পারে না, আমরা গোত্র-গণ-বর্ণ এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্নতায় বৈরি হয়ে উঠি। যে দিন কোনো একটা জলের ছরার অধিকার নিয়ে দুটি গ্রামে কিংবা দুইটি গোত্রে রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছিলো, সেই সংঘাতের ধারাবাহিকতাই বয়ে নিয়ে আসছে রাস্তা দখলের লড়াই, একটা আহত হরিণকে ধাওয়া করা মাংসের লোভ কোনো এক দিন গো্ত্রের বিনাশের কারণ হয়েছিলো, তবুও মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়েছিলো, সামান্য এক টুকরো মাংসের জন্য নয়, হয়তো সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো না সে মুহূর্তে, মানুষ লড়েছিলো সম্মানের জন্য, গোত্র আর জ্ঞাতিবোধের লড়াইয়ে কোনো কিছুই তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে না। এমন ১০০ হরিণ হয়তো অনায়াসে মেরে ফেলা যেতো কিন্তু ও হরিণের হৃদপিন্ডে বিঁধে আছে আমার জ্ঞাতির তীর, এ হরিণ আমার, আমি এর দখলীসত্ত্ব চাই-

কি অদ্ভুত বৈরিতা, সংঘাত আর হনন।

রাজধানী হিসেবে ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি হবে। এই দীর্ঘ সময়ে শহরটা ব্যপ্তিতে বেড়েছে, স্থাপত্ব্যকলা বদলেছে, সেই সময়ে যখন শুধু বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে সারিসারি উঁচমহলের বসতভিটা, সম্রাটদের অনুচর এবং সেনাপতিদের সহচর এবং বণিকদের অট্টালিকার বাইরের শহরটুকু একই রকম রঙজ্বলা অস্তিত্ব নিয়ে টিকে ছিলো। উঠানের ফাঁক দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ, আর পথের দু'পাশে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের কুটির, খড় আর বিচলী ছাওয়া, বেড়ার বাসা। এই ছিলো আমাদের ঢাকা।

যখন শহরটা দৈর্ঘে ছিলো মাত্র ৪ মাইল আর প্রস্থে খুব বেশী হলে ২ মাইল, এই সংক্ষিপ্ত শহরের পশ্চিম সীমানা ছিলো লালবাগ কেল্লা, সেই বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষেই, হোসেনী দালান, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, এভাবে আগাতে আগাতে লালকুঠির একটু সামনে গিয়েই শেষ, আর এর ভেতরেই নবাবপুর, কাঠের পুল, লোহারপুল, পাগলার পুল, তার আশে পাশে ফুলবাড়িয়া আর নারানদিয়ায় গিয়ে শহরটা হারিয়ে যেতো অন্ধকারে।

সে সময় যখন তেজগাঁও ফরাসীদের সঁপে দিয়ে চলে যাচ্ছে ওলন্ডাজেরা, কিংবা কওরানবাজারে ছোটো একটা হাট জমে উঠছে, সেই দুরের মীরপুরে তখন মাজার সরগরম। আর মাঝের অংশটুকু ডোবানালা, রমনা, পল্টন, শান্তিনগর সিদ্ধেশ্বরী কিংবা সেগুনবাগিচা আর তার সামনে গিয়ে বাজার বাগ, এইসব ছোটোখাটো ব্যতিক্রম বাদ দিলে, তেমন প্রাণের স্পন্দন ছিলো না শহরে।

যে সময় ফুলবাড়িয়ায় গণিকার মেলা, সেখানেই মৌজ ফুর্তি করতে আসে বাইরের মানুষ, শহরে অনেক আমোদের বন্দোবস্ত আছে, ১ রুপিয়া দিলে সুন্দরী মাগি মিলতে পারে। সে সময়েই মহল্লা গড়ে উঠলো, ঢাকা আবাসিক হয়ে উঠছে, এবং স্থানীয় সমাজ গড়ে উঠছে, পেশাজীবি কলোনীতে নিজস্ব প্রয়োজনেই ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষেরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করলো, সে সময়ে ঢাকায় সর্দারদের প্রয়োজন ছিলো। যখন সলিমুল্লাহ নওয়াব আব্দুল গনির সুপূত্র এবং মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা, পিতা আহসান উল্লাহর কাছ থেকে ঢাকার নবাবি পেলেন, সে সময়ের ঢাকা সামান্য বেড়েছে কলেবরে। শহরটা একটু ছড়িয়েছে, ওয়ারী আর সায়েদাবাদ ঢুকেছে শরের ভেতরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিধি যতটুকু সে অংশটুকু জুড়ে নবাব বাগান, শাহবাগ আর রমনার পাশ ছাড়িয়ে সিদ্ধেশ্বরীর বাগানে তখন মা আনন্দময়ীর আশ্রম, শান্তিনগর তখন সৈনিকদের কুচকাওয়াজে ব্যতিব্যস্ত, সেই সময়েই পিলখানায় যাওয়ার জন্য একটা রাস্তা ছিলো , সিদ্ধেশ্বরী হয়ে পিলখানা যাওয়ার রাস্তাটা ছিলো বর্তমানের রমনা থানা আর ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলের মাঝ দিয়ে, এলিফ্যন্ট রোড।

সে সময়ে ঢাকায় মহল্লা ছিলো ১০০ টা। ১০০টা মহল্লার ১০০ সর্দার, তাদের কাজ ছিলো নবাবকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করে দেওয়া, স্থানীয় মহল্লার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, আন্তঃমহল্লা সংঘাতে অভিভাবকত্ব করা এবং প্রয়োজনে নির্দেশ দেওয়া। সর্দারদের নিজস্ব বোঝাপড়া ভালো ছিলো, কারণ সাংস্কৃতিক দাঙ্গার সময়েও ঢাকায় রক্তপাত হয় নি তেমন, যেমনটা হয়েছে পাকিস্তানের সময়ে কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ায়।

তবুও রক্তগরম যুবকেরা কোনো না কোনো সময়ে ভিন মহল্লায় আইয়াশি কিংবা রং দেখাতে গিয়ে পাল্টা বাড়ি খেয়ে আসতো, কখন রক্তপাতের ঘটনা ঘটতো, এবং সর্দার মহল্লার সম্মান রক্ষায় সমঝোতায় যেতো প্রয়োজনে আক্রমণের নির্দেশ দিতো। একেবারে আদিম সমাজ, চোখের বদলে চোখ, লাশের বদলে লাশ- যে কয়টা লাশ পড়বে মহল্লায় অন্য মহল্লায় ঠিক সে কটাই লাশ পড়া চাই।

তবে আমি নিশ্চিত জানি, সমাজ বদলায় না, খুব বেশী বদলায় না, মাঝে সময় গিয়েছে ১০০ বছর, তবুও ঢাকার মহল্লার চরিত্র বদলায় নি, এখনও সর্দার রয়েছে মহল্লায়, নিজ গুনে কিংবা বিচক্ষনতার নির্বাচিত সর্দারগণ এবং তাদের বংশধরেরা এখনও জীবিত- মহল্লার মানুষ এখনও একই রকম ভাবেই মেনে নেয়, মহল্লার জন্য যেকোনো সময় যেকোনো মায়ের কোল খালি হতে পারে, মহল্লার গৌরবের জন্য এমন কি প্রাণ খোঁয়ানোও বড় সম্মানের, এলাকায় সম্মান বাড়ে, আর এভাবেই গড়ে উঠে অস্বীকৃতির সংস্কৃতি, কোনো মৃত্যুই তখন খুব বড় কোনো শোক সংবাদ নয়,

কি কইলি, কয়টা ফেলাইছে উরা, ৩টা? কুন মহল্লার পুলা আছিলো, কইতে পারবি? আইচ্ছা যা ঠিক আছে আমি দেখুম নে।
ঐ শুন, গিয়া গুইন্যা গুইন্যা ৩টা ফেলায়া আইবি, আমার মহল্লায় আয়া রংবাজি কইরা যাইবো এমুন বান্দির পুত কইত্তন আইলো? কইলাম তো বাকিটা আমি দেখুম নে।

এই সংস্কৃতির কোনো সংবাদই জানতো না হয়তো ছেলেটা, কিংবা ঢাকার এই মহল্লা সংস্কৃতির কোনো ধারণাই তার নেই, এই সর্দার প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে তাও ৬০ বছর, তবুও অতীতের সংস্কৃতির দায় বহন করে যায় মানুষ। এবং ছেলেটার ঠোঁটের দু পাশ দিয়ে পড়িয়ে পড়া রক্তে কামড় বসানো পিঁপড়ারাও জানতো না এই মানুষের সামজ তাদের সমাজের মতোই খুব বেশি বদলায় নি।

তাই দরজার আড়াল থেকে লাশটা তুলে কোনো জায়গায় ফেলে আসবার সময়ও সমস্ত মহল্লার কেউই জানে না কিভাবে খুন হলো ছেলেটা, কাউকে না কাউকে পিটি্যে তার পাঁজরের হাড় ভাঙতে হয়েছে, কারো না কারো কানে পৌঁছেছিলো সেই আর্তনাদ কিংবা গোঙানী, মৃত্যু খুব সহজ বিষয় নয়, একটা দীর্ঘ সময় ধরে পিটিয়ে খুন করা ছেলেটা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হলো কোনো এক বাসার পেছনের দরজায় আর সে লাশটার ঠিকানা করতে ছুটে গেলো আরও কয়েকজন।

এরা সবাই সমাজ কর্মী, মহল্লার প্রয়োজনে , ভিন মহল্লার লাশটাকে কোথাও ফেলে আসলো, আর পড়ে থাকা ছেলেটার নিস্প্রাণ দেহ, তার ঠোঁটের পাশে জমে থাকা রক্ত আর সেই রক্ত আর লালায় আটকা পড়া পিঁপড়ারাও জানতো না, আমাদের ঢাকা শহরের মহল্লাগুলোর সংস্কৃতি বদলায় নি। এখানে এখনও লাশের বদলে লাশ আর দাঁতের বদলে দাঁত।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি অজ্ঞ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫২


ভাবতে পারো
৮০ টুকরো হতে হয়;
ভাবতে পারো
জ্বলে পুড়ে মরতে হয়!
ভাবতে পারো
কতটুকু লোভ লালসা
থাকলে পরে
এমন হবে বলো দেখি;
ভাবতে পারো
কেমন জন্ম মৃত্যুর খেলা;
জানি আমি
তুমি কিছু ভাবতে পারবে না
কারণ তুমি অজ্ঞ
মৃত্যুর পরে একা... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×