somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসমতা - মুহাম্মাদ সারফারাজ হুসাইন

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় কবি বসেছিলেন শোবার ঘরের লাগোয়া ঝুল বারান্দায়, বারান্দার রেলিংয়ের অপর পড়া বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন তার হৃদয়ের মাঝে এক অচেনা সুরের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। কাছেই একটা গাছে নাম না জানা একটি পাখি তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে, বোধহয় সে বলতে চায়, ‘আমি তোমার প্রকৃতির নির্মলতা চাইনা, যা আমাকে শুধু কষ্ট দেয়!’ দুপুর থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি, নীলাকাশ যেন হঠাৎ করেই তার স্বরুপ বদলে হিংস্রতার বেশ ধারণ করেছে, চেনা ধরিত্রীর এই রুপে যেন প্রকৃতিও বিরুপ ভাবে তাল মিলাচ্ছে, যার ফল এই মুষলধারে বৃষ্টি।

কবি তন্ময় চৌধুরী, তরুণ ও অসম্ভব প্রতিভাবান কবি। জীবনে যতটুকু চাওয়া তার সবটুকু যখন কোন মানুষকে স্পর্শ করে ফেলে, তখন তিনি কেমন যেন একা হয়ে যান, তন্ময় চৌধুরীর আজ সেই দশা। সকাল থেকে ২/৩ জায়গায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েও শুধু প্রকৃতির নিমর্লতা উপভোগের কথা ভেবে সব জায়গায় যাওয়া বাতিল করে দিলেন। এক কাপ কফি নিয়ে কবি বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে সামনের মাঠের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। সেখানে কয়েকটি কিশোর ছেলে প্রবল বৃষ্টিতে ফুটবল খেলায় মত্ত রয়েছে, চোখ বুজে কবি তার ছেলেবেলায় ফিরে গেলেন, কতইনা রঙ্গীন ছিলো সবকিছু! বর্ষার দিনে গাঁয়ের পাশের ছোট্ট মাঠটিতে সদলবলে ফুটবল, হা-ডু-ডু খেলা, ছোট্ট নদীটিতে মাছ ধরা, সূযার্স্তের পর কদর্মাক্ত হয়ে বাড়ী ফেরা, সবকিছুই আজ খুব চেপে ধরেছে, খুব মনে পড়ছে। চেতনার গভীরে কবি নিমগ্ন, এমনি সময়ে বেডরুম থেকে টেলিফোনের আওয়াজ। উঠে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলেন কবি,

- হ্যালো। -স্বভাবজাত রাশভারি গলায় কবির সম্ভাষণ।

- আ...আ...আপনি কি কবি তন্ময় চৌধুরী? -ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে থতমত হয়ে কারো একজনের প্রশ্ন।

- জ্বি, আমিই তন্ময় বলছি, আপনি কে বলছেন?

- আমি কি সত্যিই কবির সাথে কথা বলছি, আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা! -কন্ঠে তার বিস্ময়ের স্ফূরণ।

- ব্যাপারটা সত্যিই, কিন্তু আপনার পরিচয়?

- আমার নাম পুষ্প, আসল নাম ফারাহ্ ইসলাম। আমি আপনার সব কয়টা বই-ই পড়েছি, সবগুলোই খুব ভালো, আপনি এতো ভালো লিখেন কি করে? –তার কন্ঠ এখনো উচ্ছ্বসিত।

এক সাথে অনেকগুলো কথা শুনে কবি অবাক, একই সাথে মেয়েটির বয়সও তার চপলতার মধ্যে প্রস্ফূটিত।

- আপনার দুটো নামই খুব সুন্দর, আর আমার সব বই পড়ে ফেলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, আমার লেখা কেমন হয় জানিনা, তবে সবসময়ই ভালো লেখার চেষ্টা করি।

- আপনি এতো বিনয়ি!

- বিনয় মানুষের ধর্ম, মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণির এই প্রবৃত্তি আছে বলে আমার জানা নেই।

- আপনি এতো সুন্দর করে কথা বলেন! আমি বিশ্বাসই করতে পারছিনা! সত্যিই অসাধারণ, আমি আপনার খুব ভক্ত, বিশেষ করে আমি আপনার ‘মৃত্যুর পরে’ বইটা ভুলতে পারিনা।

- এখন আমাকে কি আপনার ভুলে থাকাতে সাহায্য করতে হবে! - মৃদু দুষ্টুমির ইঙ্গিত কবির কথায়।

- না, না এটা বলছেন কেন?

- ঠাট্টা করলাম, যাই হোক, আপনার কন্ঠ শুনে মনে হয় আপনার বয়স খুব বেশি না, কিন্তু চেতনার গভীরে পৌঁছানোর মত দার্শনিকতা ভালো লাগে কিভাবে?

- ভালো না বুঝলেও এটুকু বুঝি, মৃত্যু একটা অতি-সত্য ঘটনা, আর এ নিয়ে লেখা আপনার বইটা অসাধারণ!

- আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।

- যদি কিছু মনে না করেন, আপনি আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন জানতে পারি কি?

- ও আচ্ছা এই কথা, কিছু মনে করবো কেন, আসল ব্যপারটা হলো, নাম প্রকাশ না করে বলি, আমার এক মামা সাংবাদিক। তার মোবাইলে আপনার টি এন্ড টি নাম্বারটা ছিলো, সেখান থেকেই পেয়েছি।

- আপনি পড়াশোনা করেন কি?

- জ্বি।

- কোথায়?

- আনন্দমাতা কলেজে, ইন্টারমিডিয়েট ২য় বর্ষে।

- তাহলে তো তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট, তুমি করে বললাম, এভাবেও তুমি বয়সে আমার ছোট হবে। বয়সে ছোট কাউকে আপনি করে বলাতে আমার একটু সমস্যা আছে।

- না, না, ঠিক আছে, তুমি করেই বলবেন, আমি খুব খুশি হব।

- ধন্যবাদ, তোমার সাথে পরে কথা বলবো, আজ রাখি, তোমার প্রতি শুভ কামনা রইলো।

- ঠিক আছে, ভালো থাকবেন আর আমার জন্য দোয়া করবেন।

- তুমিও ভালো থেকো।


কথা শেষ করে কবি আবার ঝুল বারান্দাটায় বসলেন। প্রকৃতির নির্মলতার সাথে কোন আপোষ করা চলেনা। চোখ বুজে অনেক কিছুই ভাবা যায়, যা উন্মুক্ত চোখে কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। অনেক ভাবনা মাথায় ভীড় করে আছে। পরবর্তী বইয়ের ছাপার কাজ প্রায় শেষ, সেটাকে এখন ঠিকঠাক মত এখন পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে পারলেই বাঁচা যায়। কত শত ভাবনার ভীড়ে হঠাৎ একটি মুখ তার সকল ভাবনার স্তরকে এলোমেলো করে দিল, না এ মুখ কোন কল্পনা না, এ মুখ চির অম্লান, এ মুখ তাকে বাঁচতে শিখিয়েছে, এ মুখ প্রতিনিয়ত তাকে নতুন ভাবে সব কিছু চিনতে শিখিয়েছে; তবুও তার কল্পনা তাকে খুব পীড়া দেয়, অজানা এক অপরাধবোধ তাকে সহসাই ঘিরে ফেললো। একজন মানুষ হিসেবে একজন মানুষকে ভালোবাসার যে তীব্র অপরাধবোধ থাকতে পারে সেটা কবি ছাড়া আর কে ভালো বুঝবে?

আধো ঘুমন্ত অবস্থা, কিন্তু চৈতন্যের মাঝে কবির মনে পড়ে যায় পূর্ণর কথা। সেই কালোত্তীর্ণ রূপের অধিকারীনি মেয়েটির কথা মনে পড়তেই তার বুকটা কেমন যেন খা খা করে উঠে। জীবনে যা কিছু শেখা বা লক্ষ্য তৈরি করা সব কিছুতেই যেন ঐ হঠাৎ করে চলে আসা মেয়েটি সর্বাঙ্গীন ভাবে জড়িত। কত সুখ-স্বপ্ন, কত শত কবিতা লিখা, কত সাঁঝে নদীর পাড়ে বসে শুধুই তার কথা ভাবা; এসবই এখন তার কাছে শুধু স্বপ্ন, যে স্বপ্ন তাকে কেবলই ফাঁকি দিয়েছে। সফল একজন ব্যক্তির জীবনে যা কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকা দরকার সে সবই এখন তার আছে, শুধু নেই, সে মায়াভরা চোখের অধিকারিনী তন্বীটি। পূর্ণর শূন্যতা এখন কেবলই তাকে বাঁচতে শেখায়, কে যেন কবির কানে কানে নৈঃশব্দের মধ্য দিয়ে বলে যায়, তোমাকে অনেক বড় হতে হবে, এমন উচ্চতায় তোমাকে পৌঁছতে হবে যেখান থেকে তুমি আমাকে ছুঁতে পারবে, আমার কাছে তোমাকে আসতেই হবে। সে কি পারবে তাকে ছুঁতে, তার দৈব দেহের হঠাৎ আলিঙ্গন কি তাকে নিয়ে যাবে সপ্ত-সুখের চেতনায়?

হঠাৎ করে কবির বদ্ধ চোখের আয়নায় চলে আসে এক অজানা সদ্য কৈশোর অতিক্রম করা নবাগত-যৌবনা মেয়ের মুখ; চঞ্চলা সেই মেয়েটির প্রতিটি কথা যেন তার কানে পিয়ানোর কোন মায়াবী সুরের মত বাজে। ছটফটে এক নির্মল মেয়ের কথাই ভাবতে থাকে সে। পরক্ষণেই এক অপরাধবোধে সে কুঁকড়ে ওঠে। যে চোখে সে পূর্ণকে দেখেছে, সেই চোখে সে কিভাবে আরেকজনের কথা ভাবে? না! না! এ মতি-ভ্রম অবশ্যই, নিজেকে নিজেই প্রবোধ দেয়। না সে কিছুতেই দূর্বল হবেনা, এটা তার ভালোবাসার প্রতি এক প্রকার প্ররোচনা করা হবে, সে তার ভালোবাসাকে দুঃখ দিতে পারেনা, সে অধিকারও তার নেই। উপরন্তু মনস্ত্বাত্বিক দোটানায় এক অপরাধবোধ তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে জীবনভর।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৩০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×