somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জুতা চোর

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কী ব্যাপার করিম সাহেব, মন খারাপ মনে হয়?

যাকে প্রশ্নটা করলাম তিনি আমাদের পাড়ার শ্রদ্ধাস্পদ একজন ব্যক্তি। অঢেল টাকা-পয়সা থাকা সত্বেও এলাকায় তাকে সবাই ভাল মানুষ বলেই জানে। আমার সাথে তার পরিচয় খুব বেশী দিনের না। দুমাস আগে এ পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে আসি। আমার মতো তিনিও মধ্যবয়সের। বয়সজনিত রোগবালাই এড়াবার জন্য প্রতিদিন ভোরে নিয়ম করে হাটতে বেরুই দুজন। এরকম এক প্রাতঃকালীন ভ্রমনেই তার সাথে আমার পরিচয়।

জ্বি জামাল সহেব। খুব টেনশনে আছি।

এমন অঢেল টাকাওয়ালা মানুষের কিসের টেনশন? তাই কৌতুহল হল কিছুটা। জিজ্ঞেস করলাম, কি বিষয়ে টেনশন। নেহাৎ ব্যক্তিগত না হলে আমাকে বলতে পারেন।

না, ব্যক্তিগত কিছু না।

তবে আমার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করেন। ভাল লাগবে আপনার। শুধু তো শরীর ফিট রাখলেই হবে না। পাশাপাশি মনটাকেও প্রফুল্ল রাখতে হবে।

হাটতে হাটতেই তিনি শুরু করলেন।

গতবছর শবে-বরাতের রাতের কথা। মিলাদ-মহফিল শেষে মসজিদ থেকে বের হয়েই চিৎকার শুনে পিছনে তাকালাম। মসজিদের দরজার সামনে ছোটখাটো একটা জটলা। কাছে গিয়ে জানলাম এক লোক জুতা চুরি করার সময় ধরা পড়েছে। সবাই খুব মারমুখী। একটু পর মেম্বার সাহেব বের হয়ে আসলেন। তিনি দেখি আরো ক্ষিপ্ত। পা থেকে জুতা খুলে চোরটিকে মারতে উদ্যত। হঠাৎ আমার খুব রাগ হল। তাকে আটকালাম। বল্লাম, শবে-বরাতের রাতে আপনারা এটা কি শুরু করলেন। তাদেরকে বুঝাতে চাইলাম, মারধর করে কোন লাভ হয় না। আমরা বরং চোরটিকে বুঝাই। নিশ্চয়ই সে অভাবের কারনে এটা করেছে। আমরা সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে তাকে এক জোড়া জুতা কিনে দিতে পারি। তবে হয়তোবা সে লজ্জা পেয়ে আর এমন করবে না। আমার কথা শুনে সবাই আবার হেই হেই করে উঠল। তাদের কথা, চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইমাম সাহেব এক ধাপ এগিয়ে বলে উঠলেন, তার হাত কেটে ফেললেই কেবল তার উপযুক্ত শাস্তি হবে। তবু আমি যখন আমার আগের কথাগুলোর উপর জোর দিলাম, তখন তারা আরো উত্তেজিত হয়ে আমাকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। বলল, আপনি চোরটাকে ভাল করে দেখান দেখি। আমরা প্রমান চাই।

আমার কেন জানি না খুব জেদ চেপে গেল। লোকটার অভাবের কথা শুনে কষ্ট হল। ভাবলাম এমন লোককে সাহায্য করলে বিফল হব না। সবার সামনে ঘোষনা দিলাম লোকটি পরদিন আমার বাসায় গেলে তার হাতে আমি একটা রিক্সা কেনার টাকা দেব। লোকটি এক বছর পর আগামী শবে-বরাতের রাতে মসজিদে এসে আমাদের সাথে দেখা করে টাকাটা ফেরত দিবে এবং জানাবে যে সে ভাল হয়ে গেছে। সবাই মুচকি হেসে যে যার পথ ধরল।

পরদিন লোকটা বাসায় আসলে তার হাতে টাকাগুলা দিয়ে বল্লাম, দেখো, অনেক আশা নিয়ে তোমাকে টাকাগুলা দিচ্ছি। তুমি সবার সামনে আমাকে লজ্জা দিয়ো না। লোকটি আমাকে সালাম করে চলে গেল।

এইটুক বলে করিম সাহেব কিছুক্ষণ থামলেন। তারপর বল্লেন, আজ শবে বরাতের রাত। হয়তোবা লোকটা আর আসবে না। সবার কাছে খুব ছোট হয়ে যাব তখন।

ঘটনাটা শুনে হাসি পেল। হাসতে হাসতে বল্লাম, এই মামুলি ব্যাপারটা নিয়ে এতো ভাবছেন! এক বছর আগের ঘটনা। এদ্দিনে সবাই নিশ্চয়ই ভুলে গেছে।

সবাই ভুলে গেলেও জামাল সাহেব, আমি তো নিজের কাছেই লজ্জা পেয়ে যাব। মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে।
আপনি কি এখনো আশা করছেন লোকটি আসবে?

চলেও তো আসতে পারে।

আমি আবার হাসলাম। আসবে না করিম সাহেব। যুগ পাল্টেছে। এখন মানুষজন আর আগের মতো সহজ সরল না।

তিনি হতাশ কণ্ঠে বল্লেন, আসবে না, তাই না?

এই আমাদের করিম সাহেব! তাকে শ্রদ্ধা না করে কি পারা যায়? আমি তাই কোন কথা না বলে হাটতে থাকলাম।

সেদিন রাতে মসজিদে তার কাছাকাছি বসলাম। তাকে ব্যাপারটা ভুলিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু না। মিলাদ শেষে ভরা মজলিসে মেম্বার সাহেবই কথাটা তুললেন।
কি খবর করিম সাহেব? আপনার জুতা চোর বুঝি এসেছে?

তার কথায় এতোটাই শ্লেষ মেশানো ছিল যে আমারও খারাপ লাগল। করিম সাহেব কোন উত্তর দিলেন না। মিলাদ শেষ। মেম্বার সাহেবের কথায় উপস্থিত সবার ঘটনাটা মনে পড়ে গেলে যে যার যার মতো করে এটা নিয়ে টিপ্পনি কাটতে কাটতে বের হল।

আমি করিম সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বল্লাম, ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নাই। আপনি চেষ্টা করেছেন এটাই সত্যি। আর কেউ তো আপনার মতো করে ভাবে নাই।

মসজিদের গেটে আসতে না আসতেই দেখি একটা রিক্সা ঘন্টা বাজাতে বাজাতে আমাদের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। রিক্সাটি কাছে আসতেই করিম সাহেবের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তুমি আসছো? তুমি আসছো? রিক্সাওলার দিকে তাকিয়ে তিনি জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলেন।

হ স্যার। আইতে দেরী হইয়া গেল। এই লন আপনের ট্যাকা। রিক্সাওয়ালা একটা কাপড়ের পুটলি এগিয়ে দিল। করিম সাহেব হাত বাড়িয়ে পুটলিটা নিলেন। তার মুখে যেন আর কথা সরে না। আমি সহ আশে পাশের লোকজনেরও একই অবস্থা।

রিক্সওলা বল্ল, উঠেন স্যার। আইজ আপনেরে লইয়া ঘুরুম।

করিম সাহেব উঠলেন। আমাকেও উঠতে বল্লেন।

আমরা দুজন রিক্সায়। রিক্সওলার চালানোর ঢঙে স্পষ্ট বুঝতে পারছি সে খুব আনন্দে আছে।

করিম সাহেব আমার ডান হাতটি ধরলেন। বল্লেন, ভাইসাহেব, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর, তাই না? তার চোখে তাকিয়ে দেখি তাতে অশ্রু। ওমা! আমার চোখও দেখি ভিজে আসছে!
১২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×