somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Buddha Collapsed Out of Shame 2007 - Hana Makhmalbaf

২১ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবি দেখার সময় সাধারণত আমি আবেগী হয়ে পড়িনা। যদি কখনো হয়েও যাই, তবে চেষ্টা করি সেই অংশটাকে মনের উপর তার প্রভাব ফেলা থেকে বিরত রাখতে। জীবনে প্রথম ও শেষবার ছবি দেখে কেঁদেছিলাম, তাও বছর দশেক আগে, আলমগীর-শাবানা অভিনীত ’মরণের পরে’ নামে একটি বাংলা ছবি দেখে। আর গত ষোল-সতের বছর ধরে দেখা ছবিগুলোর মধ্যে, যে দৃশ্য আমাকে সবচে’ বেশি আবেগে আপ্লুত করেছিল, সেটা ছিল ’কাস্ট এ্যাওয়ে’ ছবিতে নির্জন দ্বীপ থেকে ঘরে ফেরার সময়, চারবছর ধরে সাথে থাকা বলটি সমুদ্রের জলে ভেসে যাওয়ায় টম হ্যাঙ্কসের আকুল কান্না দেখে। অথচ সম্প্রতি ইরানি এই ছবির যে দৃশ্য দেখে আমি শুধু আবেগী নয়, বরং বিমূঢ়তায় আচ্ছন্ন হয়ে বসেছিলাম ছবি দেখা বন্ধ করে, সেটা ছিল এক কিশোরীর বাজারে ডিম বিক্রি করার দৃশ্য, যে স্কুলে যাবার জন্য নোটবুক কিনবে বলে, বাড়ি থেকে চুপ করে চারটি ডিম নিয়ে বাজারে এসে, ’ডিম কিনবে, ডিম কিনবে’ বলে সবার কাছে যাচ্ছে, কারণ সে জানেনা, ডিম কার কাছে বিক্রি করতে হয় ও কত দামে। ফলে সে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সাধারণ লোকজন, কশাইখানা, ঘড়ি মেরামতের দোকান, কামারশালা সবখানেই যাচ্ছে, আর ’ডিম কিনবে, ডিম কিনবে’, বলে হাকাচ্ছে। এরপর যখন সে একটা দোকানের সামনে এসে, হাতে ডিম উঁচিয়ে ধরে বলতে লাগল, ’ডিম কিনবে, ডিম’, অথচ দোকানি ও খদ্দের কেউ-ই ওর দিকে লক্ষ্য না করে, নিজেদের হাতে ধরে রাখা বান্ডিল বান্ডিল টাকা গুনতে থাকল, তখন মেয়েটির এই প্রশ্ন সত্যিই আমাকে বাধ্য করেছিল ছবি দেখা বন্ধ করতে; ”তোমরা অত টাকা দিয়ে কি করবে? একটা ডিম তো মাত্র পাঁচটাকা। আমাকে স্কুলের জন্য খাতা কিনতে হবে!”

ইরানি ছবিগুলো আমার দেখা হয়নি, কারণ ’আব্বাস কিরোস্তামি’ ও ’মাজিদ মাজিদির’ কয়েকটা ছাড়া অন্যান্য ছবিগুলো পারিনি সংগ্রহ করতে। যদিও ’চিলন্ড্রেন অব হেভেন’ দেখার পর খুব ইচ্ছে হয়েছিল ইরানি ছবিগুলো দেখার, যা এতদিন পর পুনরায় জেগে উঠেছে, ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ’হানা মাখলবাফ’-এর ’বুদ্ধা কোলাপস্ আউট অব শেম’ নামে ৮১ মিনিটের এই ছবিটি দেখে। এটা সত্যি যে, ছবিটি বিশ্বসিনেমার তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কাজ নয়, তবুও সেটা দেখার পর মনে হয়েছে, বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীদের উপর সমাজিক নির্যাতন ও নিপীড়নের এমন চমৎকার সেলুলয়েড নির্মাণ গত কয়েক বছরে দুটো হয়নি। যদিও কিছুদিন আগে সিদ্দিক বারমাকের আফগান নারীদের নির্মম বাস্তবতা নিয়ে বানানো ’ওসামা’ নামের অনুরুপ একটি ছবি দেখেছিলাম, কিন্তু সেটা আমাকে এতটা নাড়া দেয়নি। কৌশল ও গুণগতমানের বিচারে ’ওসামা’ এগিয়ে থাকলেও, হানা মাখলবাফের এই ছবিটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির এমন একটা জাগায় আঘাত করে, যে সেটি দেখামাত্রই তাৎক্ষণিক ভাললাগা তৈরী হয়ে যায়। তছাড়া ছবিটির যে তথ্য সবাইকে চমকে দিতে পারে, তা হল, ছবিটি পরিচালনা করেছে ১৯বছর বয়সী এক তরুণী, এবং এটিই তার প্রথম ছবি।

ছবিটি শুরু ও শেষ হয় ২০০১ সালের একটি ডকুমেন্টারির ফুটেজের মাধ্যমে, যেখানে দেখা যায়, আফগানিস্তানের বাহমিয়ান গ্রামের দু’হাজার বছর পুরনো বুদ্ধের বিশাল মূর্তিটি তালেবান যোদ্ধারা কিভাবে বোমা মেরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ছবিটি সেখানেই শুট করা, যেখানে দেখানো হয়েছে, পাহাড়ের গুহায় বসবাসকারী একটি পরিবারের ’বাখ্তা’ নামের পাঁচ-ছয় বছরের কিশোরী, তার প্রতিবেশী বালক ’আব্বাসের’ বই পড়া দেখে কিভাবে উজ্জীবিত হয়, এবং তার কথামত স্কুলে যাবার নোটবুক ও পেন্সিল কেনার জন্য, নিজের অবুঝ ভাইটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে, ঘর থেকে চারটি ডিম নিয়ে দোকানে যায়। দোকানদার তাকে জানায় যে ডিমের বদলে সে নোটবুক, পেন্সিল বিক্রি করেনা, বরং তাকে বাজারে গিয়ে ডিম বিক্রি করে টাকা আনতে বলে। সাথে এও বলে দেয়, যেন সে প্রতারিত না হয়, আর একেকটা ডিম পাঁচ টাকার কমে বিক্রি না করে। এভাবেই শুরু হয় বাখতার ডিম বিক্রি করা, নোটবুক কেনা, আব্বাসের সাথে ছেলেদের স্কুলে যাওয়া, এবং সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে, নদীর ওপারে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অনেকগুলো বালকদের দ্বারা বন্দি হওয়া, যারা তালেবান ও আমেরিকান সেজে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল।

ছবির কয়েকটা দৃশ্য দেখে আমি বেশ তাজ্জব হয়েছি ইরানি চলচ্চিত্রের সর্বকনিষ্ঠ এই পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতার কথা ভেবে। যেমন বাখতা যখন ডিম নিয়ে বাজারে যায়, আর সেখানে কারো ধাক্কায় হাত থেকে পড়ে একটি ডিম ভেঙে যায়, তখন ভেঙে যাওয়া ডিমের খোসা হাতে তার অসহায় মুখোভঙ্গি আমাদের বাকরুদ্ধ করে। কিংবা নোটবুক কেনার পর যখন সে আব্বাসের সাথে ছেলেদের স্কুলে যায়, আর শিক্ষক তাকে জানায় যে এটা ছেলেদের স্কুল, এখানে মেয়েদের পড়ানো হয়না, বরং নদীর ওপারে মেয়েদের যে স্কুল সেখানে যেতে। তখন কিছুদুর গিয়ে বারবার শিক্ষকের কাছে ফিরে এসে, ওর জানানো বিভিন্ন অনুরোধ আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় অসহায় এক বোধের সামনে। অথবা তালেবান ও আমেরিকান সেজে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় বালকেরা যখন তাকে স্কুল যাওয়া, সাথে লিপিষ্টিক রাখা ইত্যাদি অপরাধে বন্দী করে দাঁড় করিয়ে, তার চারপাশে ধুলোর বৃত্ত এঁকে বলে, ’এটা স্রষ্টার বিধিরেখা, এর বাইরে যেয়োনা’, তারপর সবাই মিলে ওকে মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করে, তখন কোন কিছু না ভেবেই সে বৃত্তের বাইরে চলে আসে। এভাবে কয়েকবার সে বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসে, আর বালকদের নেতা প্রতিবারই নতুন আরেকটা বৃত্ত এঁকে তা লঙ্ঘন করতে বারণ করে। অথচ সে প্রতিবারই বেরিয়ে আসে, আর একসময় ধুলোয় আঁকা বৃত্তের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা শুরু করে, তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা সন্দিহান হয়ে পড়ি তথাকথিত ধর্মীয় বিধি-নিষেধের অস্তিত্বে।

এসব ছাড়াও ছবিটিতে এমন আরও অনেক দৃশ্য আছে যেগুলো অনায়াসেই দর্শকের মনে গেঁথে যাবে। যেমন বালকদের দ্বারা গুহায় বন্দী অবস্থায়, কয়েকটি কিশোরীর সাথে বাখ্তার কথোপকথন ও একটি ছোট্ট কিশোরীকে লিপিষ্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়া, যা সে পেন্সিল কিনতে পারেনি বলে মাকে না জানিয়ে ঘর থেকে নিয়ে এসেছিল, তা দিয়ে লিখবে বলে। কিংবা নদীর ওপারে স্কুলে গিয়ে ক্লাসরুমের সমবয়সী অন্যান্য মেয়েদের সেই লিপিস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার চমৎকার দৃশ্যায়ন। পুরো ছবিতে পরিচালক যেভাবে তুলে এনেছেন আফগান নারীদের বাস্তবচিত্র, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। সেই সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গিরও, যেখানে তিনি পুরো ছবিটাই নির্মাণ করেছেন শিশুদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এমনকি আফগান-আমেরিকানদের যুদ্ধকেও দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন শিশুসুলভ খেলার মাধ্যমে, চরমভাবে, বিন্দুমাত্র বাস্তব যৃদ্ধদৃশ্যের নির্মমতা না দেখিয়েই।

পরিশেষে বলতে চাই বিশ্বচলচ্চিত্রে শিশুরা যে কত বড় অবদান রাখছে, এবং কী অসাধারণ ও সাবলীল অভিনয় উপহার দিয়ে যাচ্ছে আমাদের, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে হানা মাখলবাফের এই ছবিটি। বিশেষ করে এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা ’বাখ্তা’ নামে ’নিবাখত্ নওরোজের’ অভিনয় আমাদের মুগ্ধ না করে পারেনা। ধন্যবাদ হানাকে, এরকম একটি অনবদ্য ছবি চলচ্চিত্রপ্রেমিদের উপহার দেয়ার জন্য, যেখানে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন, কিভাবে নারীরা রোজ রোজ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা থেকে মুক্তির জন্য শেষ পর্যন্ত তারা বেছে নিচ্ছে বাখ্তার মত স্বেচ্ছা মৃত্যুকে। ছবির শেষে বালকদের খেলাচ্ছলে করা গুলিতে বাখ্তার মিথ্যে মৃত্যুদৃশ্য অনন্ত সেই বার্তায় পৌঁছে দেয় আমাদের ঘুণে ধরা মানবতার কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৯
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি অজ্ঞ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫২


ভাবতে পারো
৮০ টুকরো হতে হয়;
ভাবতে পারো
জ্বলে পুড়ে মরতে হয়!
ভাবতে পারো
কতটুকু লোভ লালসা
থাকলে পরে
এমন হবে বলো দেখি;
ভাবতে পারো
কেমন জন্ম মৃত্যুর খেলা;
জানি আমি
তুমি কিছু ভাবতে পারবে না
কারণ তুমি অজ্ঞ
মৃত্যুর পরে একা... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×