somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ বিস্রস্ত

১৭ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক

বারান্দার টবের নীচে কয়েকটা তেলাপোকা লুকিয়ে ছিল। শারমিন নাহারকে দেখেই ওগুলো ছুটল, যে যেখানে পারে। এতক্ষণে শারমিন নাহারের দাপাদাপি শুরু করার কথা। কিন্তু আজ তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলেন পোকাগুলোকে। পেঁয়াজের খোঁসার মতো, কালচে লাল- কাফকার তেলাপোকা।

সফুরার মা ঝাড়ু হাতে ছুটে এল। শারমিন নাহার বললেন, ‘বুয়া, উল্টো হয়ে যেটা পড়ে আছে- তাকে মারবে না, প্লিজ।’ সফুরার মা হুঙ্কার ছাড়ল, ‘আইজ খাইছি।’ শারমিন নাহার তার ঝিয়ের পোকানিধন দেখছিলেন। তিনি বললেন, ‘বুয়া, বাজে কথা বল কেন?’ সফুরার মা চট করে কথাটির মানে বুঝতে পারল না, গৃহকর্ত্রীকে খুশী করার ইচ্ছে ছিল তার, সে সবেগে মেঝেতে বাড়ি দিতে দিতে বলল, ‘এক্কেরে পাড়ায়া মারা উচিত।’ শারমিন নাহার নাকে আঁচল চেপে চিৎকার করে উঠলেন, ‘দূর হও!’ সফুরার মা ‘দূর হও’- কথাটির সাথে পরিচিত। এই বাড়ীর আম্মাজান খুব রেগে গেল তাকে দূর হয়ে যেতে বলেন। শুরুতে সফুরার মা ভয় পেত; ভাবত এই বুঝি চাকরী শেষ, সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে বাড়ী ফেরার লঞ্চ ধরতে হবে তার! এখন আর ভয় করেনা, দিনে বেশ কয়েকবার কথাটি তাকে শুনতে হয়।
- ‘তোমার নোংরা হাত কোনো খাবারে দেবেনা, মনে থাকবে?’
- ‘আইচ্ছা।’
- ‘ইউ আর সো ডিসগাস্টিং বুয়া!’
- ‘তেলাচুরা মারা সোয়াবের কাজ।’
- ‘তেলাপোকা মারলে কী হয়? ইউ ক্যান নট এলিমিনেট দেম, ক্যান ইউ? বুয়া, ইউ আর সো মিন। ইউ আর সো-’
- ‘ঠিক আছে।’
- ‘বুয়া, ইউ আর সো ব্যাড। ইউ আর সো-’

শারমিন নাহার সফুরার মায়ের উপযুক্ত কোনো বিশেষণ খুঁজে না পেয়ে ‘ইউ আর সো’তে এসে আটকে গেলেন। সফুরার মা ভাবল, ইংরেজীর মতো তেরি-মেরি কিছু জানলে আজ খুব ভাল হতো, এই বাড়ীর আম্মাজানের এত কষ্ট হতো না। শারমিন নাহারকে ‘ইউ আর সো’ বাক্যটি শেষ করার সুযোগ দিতেই সফুরার মা মাছ কুটতে বসে গেল। তিনি রাগী গলায় বললেন, ‘বুয়া, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নাও।’ সফুরার মা বলল, ‘ধুইছি, আম্মা। তেলাচুরা মারার পর- সবসময় আমি হাত কচলায়ে ধোই।’ শারমিন নাহার অবিশ্বাস নিয়ে সফুরার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন; কাউকেই বিশ্বাস করেন না তিনি। তিনি কড়াগলায় বললেন, ‘বুয়া কাপড় ঠিক করে বসো।’ সফুরার মা সবকিছু সহ্য করতে পারে, কিন্তু তার শালীনতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মুনকার নাকিরকে হাজির-নাজির জেনেই সে আব্রু করে, ইংরেজী জানা কোনো আম্মাজানের জন্য নয়। শারমিন নাহারের কথা শেষ না হতেই- সে ‘এই রইল আপনের মির্কামাছ’, বলে উঠে দাঁড়াল এবং আঁশটে মাখানো হাতে কোমরে আঁচল গুঁজতে গুঁজতে বলল, ‘পাগলের সংসারে আমি আর নাই।’ শারমিন নাহার বললেন, ‘আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নাও।’
- ‘রাখেন আপনের সাবান! যেই ঘরে ইজ্জত নাই, সেইখানে আমিও নাই। লাখ টাকা দিলেও নাই।’
- ‘সেদিন ঘর মোছার সময় তোমার বুকের কাপড় কোথায় ছিল, জানতে পারি?’
- ‘বুকের কাপড় আমি আসমানে শুকাইতে দিছিলাম।’
- ‘বাজে কথা বলবে না!’
- ‘আমি বুইড়া মানুষ; আমার নাতী-নাতনীর বিয়ার বয়স হইছে-’
- ‘বুয়া, শালীনতার জন্য বয়স কোনো অজুহাত নয়। সেদিন আসাদ ঐ ঘরে বসে পেপার পড়ছিল। ইউ ডিড ইট ইন্টেনশনালি; ডিডিন্ট ইউ?’
- ‘ছিঃ ছিঃ, বয়সকালে মানুষ আমারে যে অপবাদ দেয় নাই-’
- ‘ঠিক আছে, এরপর থেকে আসদের সামনে যাবে না, মনে থাকবে?’
- ‘মনে থাকব না আর! পাগলের সংসারে আমি আর নাই! আমার সাধ মিটা গেছে! ছিঃ! ছিঃ!’
- ‘বুয়া, সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে নাও; তোমার হাতে মৃগেলমাছের আঁশ লেগে আছে। ছিঃ ছিঃ করলেই নোংরা পরিষ্কার হয়ে যায়না।’
- ‘মাথায় বেইজ্জতি নিয়া হাতে সাবান ঘষলে কোনো ফয়দা নাই। ইয়া মাবুদ! তুমার কাছে বিচার দিলাম।’

সফুরার মা না খেয়ে মরে যাবে, তবুও চরিত্র নিয়ে খোঁটা সহ্য করবে না। সে ‘ছিঃ! ছিঃ!’ করতে করতে ব্যাগ গোছাতে লাগল। শারমিন নাহার বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ সফুরার মা এ কথার কোনো জবাব দিল না। পাগলের সব কথা উত্তর দিতে নাই। শারমিন নাহার অধৈর্য গলায় বললেন, ‘তাহলে মাছ কুটবে কে?’ সফুরার মা বলল, ‘সৌদি থিকা একজন পর্দানশীন আইনা লন!’ শারমিন নাহার বললেন, ‘বাজে কথা বলবে না।’

সফুরার মা আরো বারকয়েক ছিঃছিঃ বলে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে গেল। রান্না ঘরে আঁশ ছাড়ানো একটি মৃগেলমাছ, তার পাশে কাত হয়ে পড়ে থাকা বটি এবং মাথার ওপর সিলিংফ্যানের একটানা ঘড়ঘড় শব্দ নিয়ে শারমিন নাহার চুপ করে বসে রইলেন। তার একবার মনে হল, সফুরার মাকে কথাটি না বললেই ভাল হতো। কাউকে বিশ্বাস নেই-ভাবলেন আরেকবার।

কিছুক্ষণ পরে তিনি আসাদ সাহেবের অফিসে ফোন দিলেন। ওপাশ থেকে কেউ একজন জানালো, স্যার মিটিংয়ে আছেন।

সারাদিন কিসের এত মিটিং থাকে আসাদের, শারমিন নাহার ভেবে পায়না। বোয়াল মাছের মতো বিশ্রী মহিলারা আশেপাশে ঘুরঘুর না করলে বুঝি ভাল লাগেনা! আসাদের ওপর তার খুব রাগ হল, ‘আই হেইট ইউ, আসাদ!’ রাস্তায় দু’টি মেয়ে রিক্সার খোঁজে দাঁড়িয়েছিল। শারমিন নাহার বারান্দা থেকে তাদের দেখেই রেগে গেলেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘আই ডোন্ট বিলিভ ইউ বিচ।’ মেয়ে দু’টো চলে গেলে- তার রাগ সফুরার মায়ের ওপর জমল, তিনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আসাদকে দেখলেই বুকের আঁচল আসমানে শুকাতে দাও বুড়ি?’ শারমিন নাহারের চিৎকার শুনে সানশেডে রোদ পোহাতে থাকা কয়েকটা পাখি ভয় পেয়ে উড়াল দিল। তিনি মনে মনে বললেন, ‘তোরা যাসনে পাখি। প্লিজ।’

আসাদ সাহেব দুপুরের পর শারমিন নাহারকে ফোন করলেন, ‘কী ব্যাপার বলতো, তুমি নাকি বেশ ক’বার কল করেছ?’ শারমিন নাহার চুপ করে রইলেন। ওপাশ থেকে আসাদ সাহেব বললেন, ‘হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো?’ শারমিন নাহার তখনো চুপ।
- ‘কী হয়েছে? কিছু বলার না থাকলে অফিসে ফোন কর কেন?’
- ‘একা একা ভাল লাগেনা।’
- ‘ওষুধ খেয়েছো?’
- ‘কী এত কাজ তোমার!’
- ‘আমার কী কাজ তুমি জাননা? শোন, ওষুধ খেয়ে নাও, মাথা ঠাণ্ডা হবে।’
- ‘বুয়া চলে গেছে!’
- ‘কোথায় চলে গেছে?’
- ‘জানিনা!’
- ‘আবার কী বলেছ তাকে?’
- ‘তুমি বাসায় চলে এসো।’
- ‘ইদ্রিসকে বল বুয়াকে খুঁজে আনতে।’
- ‘তুমি আসনা!’
- ‘বুয়া খোঁজার সময় নেই আমার। আই অ্যাম ইন দ্য মিডল অব অ্যা মিটিং।’
- ‘আমার একা একা ভয় করে।’
- ‘বললাম তো, পারব না! আর ভয়ের কী আছে?’
- ‘ইজ দ্যাট বিচ উইথ ইউ নাও?’
- ‘শারমিন, বাজে কথা বল না!’
- ‘ইজ দ্যাট ডার্টি হোর সিটিং বিসাইড ইউ?’

শারমিন নাহারের কথা শেষ হওয়ার আগেই আসাদ সাহেব ফোন নামিয়ে রাখলেন।


দুই

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল; সন্ধ্যা ঝুলে রইল রাতের গায়ে। আর শারমিন নাহার বসে রইলেন আঁশ ছাড়ানো একটা মৃত মাছের পাশে। দু’টো আরশোলা ঘুরে বেড়ালো মিটসেফের গায়ে।

শারমিন নাহার পোকাগুলোর সাথে কথা বললেন, ‘তোদের ছানাপোনা আছেরে? সফুরার মায়ের মতো! সফুরা, তফুরা, হনুফা, মদিনা বিবি, এলাচী খাতুন, আর শুক্কুর আলী। আরো নাকি তিনজন ছিল। আতুর ঘরে মারা গেছে। আমার বাচ্চাকাচ্চা নেই। ইনফার্টাইল। বেশ মজার না! একটু বেশী বয়সে বিয়ে হয়েছেতো, তাই। এই ব্যাটা আরশোলা, বউয়ের যত্ন নিবি কিন্তু! নিবি তো?’

আরশোলাদের সাথে কথা শেষ করে শারমিন নাহার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনেক কাজ তার। তিনি ডাইনিং টেবিলের ছ’খনা চেয়ারের বিয়ে দিয়ে দিলেন। গণবিবাহ। খুব উপদেশ দিলেন ছেলে চেয়ারদের, বউদের যত্ন নিতে বললেন। আর মেয়ে চেয়ারদের কানে কানে বললেন- তাড়াতাড়ি ছেলেপুলে নিয়ে নিতে। বয়স বাড়লে বাচ্চা নিতে নাকি নানান সমস্যা তৈরী হয়। ইনভোল্যুশন! তারপর কী একটা অশ্লীল রসিকতা মনে পড়ায়- একটা মেয়ে চেয়ারের গায়ে চিমটি কেটে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে শারমিন নাহারের গলার কাছে কান্না জমে উঠল। তিনি মেয়ে চেয়ারগুলোকে একদিকে টেনে আনলেন, তারপর ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘তোরা পারবি, পারবি না?’ চেয়ারগুলোকে শ্বশুড়বাড়ী পাঠিয়ে তিনি কাঁদলেন। সফুরার মা যেমন মৃত সন্তানদের কথা মনে করে বিলাপ করে, শারমিন নাহারও তেমন করে কাঁদতে চাইলেন।

ড্রয়িংরুমের ডিভানের সাথে সফুরার মায়ের চৌকির বিয়ে হয়ে রাত আটটা নাগাদ। এরপর শারমিন নাহার ভ্রু নাচিয়ে কথা বলতে লাগলেন সোফা-কুশনের সাথে, ‘বিয়েটা কেমন হলো? একটু বেমানান, কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবে। ওরা সুখী হলেই হল, তাই না!’ তারপর সোফা-কুশনদের জন্য পাত্রের খোঁজে বেরুলেন তিনি। অনেক বলে-কয়ে বালিশদের রাজি করালেন বিয়েতে। শারমিন নাহার বালিশগুলোকে নানান কিছু বোঝালেন; আবার বকলেনও একবার, ‘এত খারাপ তোরা! দেখে কিন্তু ভদ্রলোকই মনে হয়, আসলে তো লোভী! এত লোভ নিয়ে সুখী হওয়া যায় নারে!’ অনেক কথা খরচের পর বালিশ আর সোফা-কুশনের বিয়ে হল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘বিয়েতে ওসব একটু-আধটু হয়ই! এই যে আমার প্রেমকরে বিয়ে, তাতেই কী কম ঝামেলা হয়েছে?’ সোফা-কুশনদের স্বাত্বনা দিলেও তার মনটা কেমন যেন করতে লাগল। বিয়েটা ভাল হয়নি। মেয়েগুলো একদল ইতরের হাতে পড়ল বোধহয়!

শারমিন নাহার আবার আসাদ সাহেবকে ফোন করলেন। ফোন বাজল- একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার- বেজেই চলল। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরল না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘আই শ্যুড কিল দ্যট বিচ।’ তারপর মাছকোটার বটি হাতে নিয়ে সোফায় বসে রইলেন কিছুক্ষণ এবং একসময় ঘরের আসবাবপত্র, সিলিং ফ্যান, রান্নাঘরের আরশোলা আর দেয়ালের টিকটিকিদের চমকে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘একদম শেষ করে ফেলব!’

মাঝরাতের কিছু আগে সফুরার মা ফিরে এলো। ইদ্রিস তাকে খুঁজে এনেছে।
- ‘স্যার আমারে ফোন দিয়া সফুরার মায়েরে আনতে কইলেন। সে তো আসব না! পরে বেতন বাড়ানোর কথা কইয়া আনছি।’
- ‘ডু ইউ নো, তোমার স্যার বাড়ীতে ফিরছেনা কেন?’
- ‘নীচে টেক্সি খাঁড়া, ভাড়া দিয়া হয় নাই।’
- ‘ডিড আই আক্স ইউ সামথিং?’

মৃগেল মাছ তখনও রান্নাঘরে পড়েছিল। ঘরের ভেতর আঁশটে গন্ধ। এ-রুমের চেয়ার ও-রুমের কাঁথা-বালিশ এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ইদ্রিস সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মা, আইজ মনে হয় অনেক বিয়া-শাদি হইছে বাড়ীতে?’ শারমিন নাহার লজ্জা পেলেন, ভয়ও কিছুটা। ইদ্রিস কি পাগল ভাবছে তাকে? তিনি চান না- কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা করুক। স্বাভাবিক হতেই বোধহয় তিনি সফুরার মাকে ধমক দিলেন, ‘বুয়া, তোমার মাথায় কাপড় নেই কেন?’ সফুরার মা মাথায় আঁচল টানতে টানতে বলল, ‘এইখানেতো বাইরের কেউ নাই!’
- ‘ইদ্রিসকে তুমি পুরুষ মনে করনা?’
- ‘ইদ্রিস আমার নাতীর বয়সী! ইয়া মাবুদ, আমারে কই নিয়া আসলা?’
- ‘বুয়া, তোমাকে কোনো মাবুদ এখানে টেনে আনেনি, তুমি নিজে এসেছো। এন্ড ইদ্রিস হেল্পড ইউ টু গেট ইওর জব ব্যাক!’
- ‘ও ইদ্রিস, আমি এইখানে থাকলে পাগল হয়া যাব রে! আমারে তুই কই আনলি?’

ইদ্রিস প্রসঙ্গ বদলাতে শারমিন নাহারকে আবার ট্যাক্সির ভাড়ার কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘নীচে ট্যাক্সি খাড়া!’ শারমিন নাহার সোফায় চোখ বুজে বসে থাকেন, যেন তিনি কিছু শোনেননি। সফুরার মা শ্যেন চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘ইদ্রিস, আর ইউ ম্যারিড? তোমার স্ত্রী কি শেক্সপিয়ার জানেন? ইবসেন? ইজ শি প্রিটিয়ার দ্যান মি?’ সফুরার মা- ‘ইয়া মাবুদ’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়; ইদ্রিস বলল, ‘খালা, ছারের সাথে কথা বইলা যাও।’ সফুরার মা বলল, ‘গরীবের ইজ্জত গেলে আর থাকল কী! লাখ টাকা দিলেও এই বাড়ীতে আমি থাকুম না।’ ইদ্রিস সফুরার মাকে হাত জোড় করে, ‘খালি ছার আসা পর্যন্ত থাক। আমারে বেইজ্জত কইরনা।’ শরীরের অযত্ন আর মানসিক চাপে শারমিন নাহার ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবু তার ঘুম নেই। তিনি লাল চোখে সফুরার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সফুরার মা এলোমেলো ড্রয়িং-রুমের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শারমিন নাহার প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘ইউ আর সো রুড বুয়া!’

সে রাতে আসাদ সাহেব বাড়ী ফেরেননি।


তিন

ইদ্রিসের পিড়াপিড়িতে সফুরার মা রাতটা এখানে থেকে গেল। কাল আসাদ সাহেব বাড়ী ফিরলে সবকিছুর ফয়সালা হবে। তার চৌকি এখনো ড্রইংরুমে ডিভানের পাশে পড়ে আছে। ‘পাগলের গোবী-আনন্দ’, সফুরার মা ভাবে, ‘নিজের বিয়া টিকাইতে পারনা, খাট-পালঙ্কের বিয়া দেও!’ এই সব বড়লোকি রোগ ঝুল-ঝাড়ুর হাতা দিয়ে পিঠে কয়েকটা দিলেই ভাল হয়ে যায় বলে তার ধারণা। একটু ঝিমুনি আসার আগপর্যন্ত শারমিন নাহারের নামে সে খোদার কাছে বিচার দিল।

শেষরাতে সফুরার মায়ের ঘুম ভাঙল; শারমিন নাহার তাকে ডাকছে, ‘ও বুয়া, ভয় করে।’ সফুরার মা তাড়াতাড়ি উঠে দরজার খিল শক্ত করে এঁটে দিল, পাগল-ছাগলরে কোনো বিশ্বাস নাই। শারমিন নাহার বললেন, ‘বুয়া দরজা খোল। আমার একলা ভয় করে।’ ‘ঢ্যামনামি দেখ! রাইতের বেলায় পাগলরে কোলে নিয়া নাচ-গান কর!’, সফুরার মা চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে।

শারমিন নাহার কাঁদলেন। কয়েকটা তেলাপোকা দরজার আড়াল থেকে তাকে দেখল। ‘ও বুয়া, আসাদ বাড়ী ফেরেনি কেন? ও বুয়া, অ্যাম আই দ্যাট ব্যাড?’
- ‘আম্মা, আপনে ঘুমান।’
- ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডাই, বুয়া!’
- ‘আপনের ঘুম দরকার।’
- ‘ও বুয়া, আসাদ কেন বাড়ী ফেরেনা?’
- ‘আম্মা, এইটা হয়। সংসারে একসাথে থাকতে গেলে এইসব হয়।’
- ‘বুয়া, প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর। আই’ম সো স্কেয়ার্ড। ও বুয়া, দরজা খোল। উপেক্ষা সইতে পারিনা!’
- ‘আম্মা, আপনে কিছু খান। সারাদিনে শইলে দানাপানি দ্যান নাই।’

সফুরার মা দরজা খোলেনি। শারমিন নাহার একটানা কথা বলেছে, ‘ছোটবেলায় একবার চড়ুইয়ের বাসা থেকে ডিম চুরি করেছিলাম বলে- কে যেন অভিশাপ দিয়েছিল- তোর কোনোদিন বাচ্চা হবেনা। ও বুয়া, ডাক্তারও বলেছে, আমার বাচ্চা হবেনা। এত অভিশাপ লাগল আমার! তোমার সফুরা কোনোদিন পাখির ডিম চুরি করেনি, তাই না? তুমিও না! বুয়া, বলনা!’ কথা বলতে বলতে তিনি কাঁদলেনও কিছুক্ষণ। হাসলেনও বোধহয়। এলোমেলো কথাও বললেন বার কয়েক। দুর্বিসহ প্রলাপ। তারপর কোনো সারাশব্দ নেই। সফুরার মা দরজায় কান পেতে রইল। তার মনে হল, সব মানুষকেই হয়তো এমন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অবহেলার পরীক্ষা, টিকে থাকার পরীক্ষা। এ পরীক্ষা সে নিজে দিয়েছে, সফুরা দিয়েছে, ইদ্রিসের বউ দেবে, শারমিন নাহার দিচ্ছে।

সকালে সফুরার মা দরজা খুলে দেখল শারমিন নাহার মেঝেতে পড়ে আছেন। সে শারমিন নাহারকে দেখেই ভয় পেয়েছে। মাথাখারাপ মানুষেরে বিশ্বাস নাই। শারমিন নাহারের ঘুমানোর ভঙ্গীটি অস্বাভাবিক ছিল বলেই তার মনে হয়, মেয়েটি খুব অভাগা। সে ইদ্রিসকে ডাকল, ‘ও ইদ্রিস, ও ইদ্রিস’; তারপর শারমিন নাহারের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আম্মা, কী হইছে আপনের?’ শারমিন নাহার জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘আমার খালি ঘুম পায় বুয়া।’ সফুরার মা কী করবে ভেবে পায়না। সে আবার ইদ্রিসকে ডাকে। শারমিন নাহার বলেন, ‘তোমার আঁচল দিয়ে আমাকে ঢেকে দেবে বুয়া? আমার খুব শীত করে।’ ‘আপনের কোনো ভয় নাই আম্মা; আমরা আছি না!’, সফুরার মা শারমিন নাহারকে বুকে চেপে রাখেন।


চার

আসাদ সাহেব আবার বিয়ে করেছিলেন। এই বউটি শারমিন নাহারের মতো খুব বেশী সুন্দরী না হলেও এদের বংশে কারো পাগলামি ছিল না। এই তথ্যটি আসাদ সাহেব বিশেষ আগ্রহ নিয়ে সংগ্রহ করেছেন।

সফুরার মাও এ বাড়ীর নতুন বউকে নিয়ে বেশ খুশী। এই বউটি খুব বুদ্ধিমতি। নিজের হাতে আসাদ সাহেবকে রান্নাবান্না করে খাওয়ান। ঝামেলাও কম করেন। কথায় কথায় ইংরেজী বলেন না। তার ইচ্ছা হনুফার সাথে ইদ্রিসের বিয়ের কথাটা একদিন নতুন বউকে বলবে। নতুন বউ রাজি হইলেই বিয়ের খরচাপাতি নিয়ে আর কোনো চিন্তা করতে হবেনা।

একদিন ফ্রিজ থেকে মৃগেলমাছ বের করতেই নতুন বউ দেখল মাছের গায়ে লাল রঙ লেগে আছে। সফুরার মা তাড়াতাড়ি নতুন বউকে বলল, ‘এইটা আগেরজনের কাজ। ওই যে গল্প করছি না- সেই বেটি বালিশ-তোষকের বিয়া দিত, মুরগীর ঠ্যাং নেল-পালিশ দিয়া সাজাইতো!’

নতুন বউ লিপিস্টিক মাখানো মৃগেলমাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আঁশ ছাড়ানো মাছের চোখের সাথে মানুষের দৃষ্টির এত মিল!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৩১
৬২টি মন্তব্য ৫৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভ্রমণ স্মৃতি - ছাংশা, হুনান প্রদেশ, চীন ২০১৮ সাল

লিখেছেন নাঈম আহমেদ, ২৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৪২


জায়গাটির নাম ইউয়েলু শান বা 岳麓山 বা Yuelu Mountain. দক্ষিণ-মধ্য চীনের হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরে অবস্থিত। পাহারটি শহরের মাঝে বয়ে চলা শিয়াং নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত, ছবিতে আমার পেছনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সহেলিয়া তার নাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪১

সহেলিয়া তার নাম
ধাপারিয়া ছিল তার গ্রাম
আমার বাড়ির সামনে দিয়ে
আসতো যেতো প্রতিদিনই সে
জানালাটা খুলে আমি
তার দিকে চেয়ে তার
হেঁটে যাওয়া দেখতাম



মাথায় দুটি বেণি ছিল
দু পাশে দুটি লাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্যতার কলঙ্ক ইজরাইল

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৮

ইহুদিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম তোরাহ। এটি ৫ টি পুস্তকের সমন্বয়ে গঠিত। ইহুদি এবং সকল একেশ্বরবাদীরা বিশ্বাস করে তোরাহ হচ্ছে প্রফেট Moses ( মুসা নবী ) এর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক থেকে ভালোবাসার পথে: আমার এবং মীমের গল্প

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ৩০ শে মে, ২০২৪ রাত ২:৩৭

## প্রথম অধ্যায়: অনলাইন থেকে অফলাইনে

ফেসবুকের পাতায় একটি সাধারণ দিন। আমি তখন নিউইয়র্কের ব্যস্ত শহরে বসে থাকি, চারপাশে মানুষের কোলাহল আর কাজের চাপ। হঠাৎ করেই ফেসবুকে একটি পোস্টে কমেন্ট করতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মোছাব্বিরুল হক, ৩০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫৮



শত মমতার গল্প গাঁথুনি পৃথিবীর ভাঁজে ভাঁজে
কিছু নয় তার মাতৃতুল্য মা তাঁর তুলনা নিজে।
কত প্রিয়জন বন্ধু-স্বজন প্রাণপ্রিয় সন্তান
হতে পারে পর এলে কভু ঝড়
ভুলে শত অবদান।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×