somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভেঁদো বাঁশী বাজে

১৬ ই নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রামের ছেলে শহরে এলেই তার পেখম গজায়। ধরাকে সড়াজ্ঞান করে। পৌরুষ যেন মুহু-মুর্হু জেগে ওঠে।
আমি নিজে তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। লেজে পাখনা গজালো। কাক থেকে ময়ূর হয়েগেলাম।
যে পাড়ায় আমাদের কলেজের হস্টেলটা ছিল, সেখানকার পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। শুধু আমি নয় আরও অনেকের।
অবসর পেলেই হোস্টেলের রাস্তার সামনে ক্রিকেট ফুটবল খেলা হতো।
আমাদের হোস্টেলটা একমাত্র পাকা বাড়ি। রাস্তার ওপারে সব খোলার চালের বাড়ি বলতে গেলে বস্তি।
রবিবারের খেলাটা খুব জমতো। পাড়ার গুরুজনেরাও বাজার শেষে চা-টা খেয়ে আমাদের সঙ্গে একদান লেগে পরতো।
আমরা যেখানে খেলতাম তার সামনেই সর্বেশ্বর জ্যেঠুর রেশনের দোকান।
বল প্রায়ই জ্যেঠুর দোকানে ঢুকে পরতো। জ্যেঠু প্রথম রাগ করতো। একেবারে রেগে অগ্নিশর্মা পরে রাগ করতো না।
জ্যেঠুর দোকানে ভেঁদোদা বলে একটা গোলগাল কালো মতো লোক রেশনের জিনিষ-পত্র মাপামাপির কাজ করতো। মাঝে মাঝে লড়ি করে চাল গম তেল এলে মাথায় করে নামিয়ে দোকানে রাখতো।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোনদিন ভেঁদোদাকে আমি হাফ প্যান্ট আর একটা স্যান্ডো গেঞ্জির জায়গায় কিছু পরতে দেখি নি। খুব বেশি হলে শীতকালে একটা মেয়েদের ছোট চাদর জড়িয়ে নিতো।
আমার বয়সী ছেলে ছোকরারা প্রায়ই ভেঁদোদাকে বলতো “ভেঁদো বাঁশী বাজে”।
ভেঁদোদা খুব রেগে যেতো রাস্তা থেকে ঢিল তুলে মারতে তেরে আসতো।
আবার আমাদের সঙ্গে যখন ক্রিকেট খেলবে তখন ভেঁদোদা খালি ফিল্ডিং করবে। কোন দিন ব্যাট করবে না। যে যেদিকে বল মারবে ভেঁদোদা দৌড়ে সেই বল নিয়ে আসবে। ছুঁড়লে সেই বল নিয়ে আসার জন্য আবার দুজন লোকের দরকার পরতো। ভেঁদোদার এই রকম থ্রোয়িং।
আমিও মাঝে মাঝে পাল্লায় পরে ভেঁদোদাকে রাগাতাম, “ভেঁদো বাঁশী বাজে”।
ভেঁদোদা হাতের সামনে যা পেতো ছুঁড়ে মারতো।
আমরা হাসতে হাসতে যে যার এদিক ওদিক হাওয়া।
ভেঁদোদা কাঁদতে কাঁদতে সর্বেশ্বর জ্যেঠুকে গিয়ে নালিশ করতো।
আমরা আবার ভেঁদোদার পেছনে লাগতাম।
কিরে ভেঁদোদা সর্বেশ্বর জ্যেঠুকে নালিশ করে কটা বালিশ পেলি।
কেনো ও কথা বললি।
কি হয়েছে।
ভেঁদোদা মাথা নীচু করে চলে যেতো। কোন কথা বলতো না।
মাঝে মাঝেই সর্বেশ্বর জ্যেঠু যখন দোকান থেকে বাড়িতে চা খেতে যেতো। আমরা দল বেঁধে রেশন দোকানে হাজির হতাম।
ভেঁদোদা একটু চিনি দিবি।
না দেবো না।
আর কোন দিন বলবো না। একটু চিনি দে।
ঠিক আর বলবি না।
বলছিতো বলবো না।
ভেঁদোদা সবার হাতে বস্তা থেকে নিয়ে একটু একটু করে চিনি দিতো। মহা অনন্দে চিনি মুখে দিয়ে রাস্তার কলের একপেট জল খেয়ে আবার খেলতে আরম্ভ করতাম।
ঝুনে ওই পাড়াতেই থাকতো। কালো, রোগা ডিগডিগে কিন্তু অসম্ভব জোড়ে বল করতো। ক্যাম্বিশের বল একটু জলে ভিঁজিয়ে নিলে তার জোড় আরো বেড়ে যেতো। ঝুনের বল আমরা কেউই ভালো খেলতে পারতাম না।
আমিতো ওর বল প্রায়ই গায়ে খেলতাম। বেশ লাগতো।
মাঝে মাঝে যে দু’চারটে আলটপকা মারতাম না তা নয়। সে কচিৎ কদাচিৎ।
সেদিন দুপুরে ম্যাচ। আমাদের হস্টেলের ছেলেদের সঙ্গে ওই পাড়ার ছেলেদের। খেলা বেশ জমে উঠেছে। টান টান উত্তেজনা। আমরা একপ্রকার হারতে বসেছি। আমি ব্যাট করছি। বল করছে ঝুনে। সেদিন আমার কি হয়েচিল জানিনা। ঝুনেকে বেধড়ক মারছিলাম।
সেই ওভারটা ঝুনে বল করতে এসেছে। দৌড় শুরু করেছে। হঠাৎ দেখি ভেঁদোদা রাস্তায় নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। হেরো পার্টি হেরো পার্টি বলে।
কি জানি হঠাৎ মাথাটা কেমন গরম হয়েগেলো। স্টান্স থেকে সোজা দাঁড়িয়ে রাগের চোটে বলে বসলাম ভেঁদোদা এবার কিন্তু তোর বাঁশী বাজিয়ে দেবো।
ঝুনে কিন্তু দৌড় থামায় নি। বলটা করা মাত্রই বলটা লাফিয়ে উঠে আমার মুখে লাগলো। একবারে ঠিক ঠোঁটের ওপর। ঠোঁটটা ফুলে গেলো।
ঝুনেকে মারতে তেড়ে গেলাম। একটা হুলুস্থূলুস পরে গেলো। বড়রা সবাই এসে ধরা ধরি করে আটকে দিলো।
আবার বল করতে গেলো ঝুনে। পর পর তিনটে বল মারার পর আমি ফিফথ বলে বোল্ড হয়ে ফিরে এলাম।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হেরেও গেলাম। একটু খানি মাতা গারম করার জন্য একটা বিশ্রী কান্ড হয়ে গেলো। পাড়ার গুরুজনেরা কি ভাবলো।
হস্টেল থেকে আর বেরলাম না। চুপচাপ নিজের ঘরেই রইলাম।
বিকেল হয়ে গেছে সন্ধ্যে হয় হয়। খাটের মধ্যে শুয়েই আড়মোড়া খাচ্ছি। মাঝে মাঝে দুপুরের কথাটা মনে পরে গেলেই মনটা কেমন খচ খচ করে উঠছে। ইস কেনো ভেঁদোদাকে ওই সময় বলতে গেলাম। ঝুনেকে ঠিক মতো খেলে দিতে পারলেই ম্যাচটা জিতে যেতে পারতাম। আর কিছুই নয় কলেজ হস্টেলের একটা নাম হতো।
সাত-পাঁচ ভাবছি।
হঠাৎ দেখলাম ঝুনে আর পদু আমার ঘরে ঢুকলো।
কিরে অনি অন্ধকারে শুয়ে আছিস। পদু বললো।
আমি খাট থেকে নেমে আলোটা জালালাম।
আলো বলতে একটা একশো পাওয়ারের বাল্ব।
ঝুনেকে দেখেই মাতাটা আবার গরম হয়ে গেলো।
তোর কাছে ঝুনে ক্ষমা চাইতে এসেছে।
কেনো। ও তো ওর কাজ করেছে। তবে আমারই ভুল হয়েছে।
তুই ব্যাপারটা বোঝ।
বোঝা বুঝির কিছু নেই পদু। আমি তখন রেডি ছিলাম না। ওর বলটা না করাই উচিত ছিল। আমি হলেও তাই করতাম।
কিছু ওষুধ খেয়েছিস।
গ্রামের ছেলে, ওষুধের দরকার পরে না। ওটা তোদের শহরের ছেলেদের জন্য।
অতোটা রক্ত বেরোলো।
তাতে কি হয়েছে।
হঠাৎ ঝুনে আমার হাতটা চেপে ধরলো।
আমাকে ক্ষমা কর অনি।
ছাড় ফালতু কথা একবারে বলবি না। তোকে আমি এই পাড়ায় সবচেয়ে বশি ভালবাসতাম।
ঝুনের ধরা হাত থেকে আমার হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম।
ঝুনে মাথা নীচু করে বললো, তুই তখন ওই কথাটা বললি কেনো।
রাগে তখন আমার সারাটা শরীর জ্বলছে। একে হারের জ্বালা আর একদিকে ঝুনের এই ন্যাকামো।
কি কথা।
ভেঁদো এবার তোমার বাঁশী বাজিয়ে দেবো।
বেশ করেছি, সবাই বলে তাই বলেছি।
ঝুনে খুব নীচু স্বরে বললো।
ভেঁদো আমার দাদা, বাঁশী আমার বাবা।
কথাটা শোনার পর আমি হঠাৎ কেমন যেনো বোবা হয়ে গেলাম। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচর দিয়ে দিয়ে উঠলো। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে কাঁদতে পারছি না। ঝুনকে বুকের সঙ্গে জাপ্টে ধরলাম।
ঝুনে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
ভেঁদোদা আমার বড়দা। এ্যাবনর্মাল। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। কিছু হয় নি। তুই তো আমাদের অবস্থা জানিস না। আমাদের বাড়িতেও যাস নি। নয় বাই বোনের সংসার। বাবা-দাদা সর্বেশ্বর জ্যেঠুর দোকানে কাজ করে। যা পায় তাতেই সংসার চলে। আমি মেজদা, সেজদা, ছোটদা টিউসনি করে কতো পাই বল। দিদিরা ব্লাউজ সেলাই করে। তোর মুখ থেকে আগে কখনো ওই কথা শুনিনি। শোনার পর মাথাটা কেমন যেনো হয়ে গেলো।......
অনেকক্ষণ ঝুনেকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঝুনের মতো হয়তো কাঁদিনি। তবে চোখটা নিশ্চই ছল ছল করে উঠেছিল।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×