somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১২ই নভম্বরে ১৯৭০

১৩ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ১২ই নভেম্বর, ইতিহাসের ভয়াল দিন
মোল্লা বাহাউদ্দিন

এই দিন ইতিহাসের একটি ভয়াল দিন। ১৯৭০ সালের এ দিনে শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছাস লন্ড ভন্ড করে দিয়েছিল পাটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালি, লক্ষীপুর, সন্দ্বীপসহ দক্ষিন উপক’লের বিশাল জনপদ। এই জলোচ্ছাসে উপক’লের প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রানহানি ঘটেছিল। তার সাথে অগনিত লক্ষ লক্ষ গবাধিপশু ও অন্যান্য জীব জন্তুু। এই তান্ডবলীলার ভয়াবহতা সচক্ষে না দেখলে অনুমান করা যায় না কেমন ছিল তার ভয়ঙ্কর রুপ। আজ ৩৯ বছর পর স্মৃতির পাতায় যা চিরতরে আঁকা হয়ে আছে তা নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হল।
তখন ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, ঢাকা অফিসে চাকরি করি। প্রলয়ের খবর জানার পরই ব্যাংক কতৃপক্ষ সমস্ত কর্মচারির দুদিনের বেতন নিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করে ফেলে। উপক’লে রিলিফ পাঠানো হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারন তান্ডবের পর যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য পাকিস্তান সরকার নীরব। তাহলে বাংলার মানুষকেই মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। অফিসে একটা নোটিশ দেয়া হল যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রিলিফ নিয়ে উপক’লে যেতে আগ্রহী তারা যেন কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে। একটা বড় লঞ্চ ভাড়া করা হল। ভর্তি করা হল কাপড়চোপর আর হাড়িপাতিল দিয়ে। কিন্তু যাবে কে? দুদিন চলে গেছে কেউ যাবার আগ্রহ দেখায়নি। আমি ছিলাম এক সপ্তাহের ছুটিতে। কাজে যোগ দিয়েই শুনলাম কেউ যেতে রাজি নয়। সবাইর ভয়, ওখানে এখন রোগের প্রাদুর্ভাব হবে। পানি বিষ হয়ে গেছে, কোন খাবার নেই ইত্যাদি অনেক কারন। আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, আমার নামটা লিখুন। কেউ না গেলেও আমি একা যাব। এই দেখে এগিয়ে এল সাত্তার। এসে বলল, তুই গেলে আমিও যাব। এই সাত্তার নাটক করে, সিনেমাও করে। একজন প্রথম সারির অভিনেতা। পরে নিজে একটা সিনেমা করতে গিয়ে পথে বসেছে। নিজের বাড়ী বিক্রি করে এখন সেই বাড়ীতেই ভাড়া থাকে। তারপর এগিয়ে এল মুজিবর। সেও একজন ভাল অভিনেতা। বেশিরভাগ নাটকে তাকে দেখা যায়। এমনি করে দেখা গেল সাত জনের একটা টিম হয়ে গেছে। ভীরু, সরল স্বভাবের মাখনও যোগ দিল। যোগ দিল মাহমুদ আলী বেগ। টিমের প্রধান হলেন মনজুর রশিদ। তিনি একজন লেখকও। সহকারি টিম প্রধান হলেন বরিশালের মফিজ মিয়া।
১৫ই নভেম্বর সকাল সাতটায় আমরা রওয়ানা দিলাম বরিশালের উদ্দেশ্যে। সাথে নিলাম যথেষ্ট পরিমান পানীয় জল, শুকনো খেজুর আর নানারকম বিস্কুট। এই খেয়ে আমাদের কাটাতে হবে সাতদিন বা তারও বেশি। দিনে তিনবার ভাত খেয়ে যার অভ্যেস তার দ্বারা ভাত না খেয়ে চলবে কিনা কে জানে। কিন্তু যেতে হবে। সন্ধ্যার দিকে পৌছলাম বরিশাল শহরে। এখানে মানুষ দেখে বুঝার উপায় নেই কোথায়ও কিছু ঘটেছে। এখানে প্রলয়ের কোন ছাপ নেই। ভোরে রওয়ানা দিলাম প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিকে। আগুনের মত জ্বলজ্বলে সূর্যোদয় দেখলাম আগুনমুখী নদীতে বসে। বিকেলে লঞ্চ থামল একটা গ্রাম্য বাজারের ঘাটে। নাম মনে নেই। ঘাটে থামতেই আমি আর সাত্তার নেমে পড়লাম। একটা খেতের আল ধরে এগিয়ে গেলাম। কোন ঘরবাড়ী চোখে পড়ল না। কতগুলো নারকেল গাছ দাড়িয়ে আছে। আর একটু যেতেই চোখে পড়ল একটা ছাউনি। বেড়া নেই। একটা লোক বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এখানে কি কোন সাহায্য এসেছে? লোকটা বলল, সাহায্য আইিছল। মানুষ নাই, সাহায্য কারে দিব? তারপর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখেন। দেখলাম পথের পাশে কবর আর কবর। অনেক দূর পর্যন্ত। লোকটা বলল এখন আমার কামই অইল কবর দেয়া। রেড ক্রস আইছিল, চাউল ডাউল দিয়া গেছে কাল। আমরা ফিরে এলাম। যে খেতের আইল ধরে গিয়েছিলাম সে আইলে এসে আমার চোখ গেল খেতের দিকে। কাদা পানি একাকার হয়ে পানি আটকে আছে। তার মাঝে একটু দূরে দূরে যেন কেউ কিছু সাজিয়ে রেখেছে এমন কিছু কালো বস্ত পড়ে আছে। কৌতুহরবশত ভাল করে তাকালাম। জিনিষগুলো কি! আরো কাছে গিয়ে দেখলাম মানুষের চুল দেখা যায়। সাত্তারকে বললাম, তুই তাকিয়ে দেখ তো এগুলি কি? সেও আর একটু কাছে গিয়ে বলল, আরে এ যে মানুষের মাথা! বুঝলাম সবকটি কালো বস্তুু মানুষের মৃতদেহ। দেহটা পানি কাদার নীচে কিন্তু মাথাটা কিছু উপরে। আমরা ফিরে এলাম লঞ্চে।
মফিজ সাহেব বরিশালের মানুষ। এসব এলাকা সম্মন্ধে তার ভাল ধারনা আছে । তিনি স্দ্ধিান্ত দিলেন আমরা অফ সোরে মানে একবারে সমুদ্রের পাড়ের মানুষের কাছে যাব। লঞ্চ আবার রওয়ানা দিল। পরের দিন ১৭ তারিখ সকালে একটা নদীর পাড়ে নোঙ্গর করল আমাদের লঞ্চ। কাছাকাছি গ্রাম নেই। আধা মাইল দূরে দেখা যায় গ্রাম। আমরা চারজন নেমে পড়লাম চারদিকে। আদেশ রইল ফিরে আসতে হবে তিনটার মাঝে। তিন জন রইল লঞ্চে। তারা সরবরাহ করবে। আমরা গ্রামে গ্রামে প্রতিটি ঘরে গিয়ে দেখব কার কি প্রয়োজন। তারপর স্লিপ দিয়ে দিব। তারা এসে নিয়ে যাবে লঞ্চ থেকে। আমি গেলাম দক্ষিনে। সাত্তার উত্তরে, মজিবুর পূবে আর বেগ পশ্চিমে। সকাল থেকে তিনটা পর্যন্ত অনেক পথ হেটে, কত মাইল হেটেছি তা ভাবলে এখন আৎকে উঠি, অনেক ভীবৎস দৃশ্য দেখে, অনেক কাহিনী শুনে কাজ করে গেলাম। সেসব দৃশ্য আর কাহিনী বলতে গেলে একটা বড় উপাখ্যান হয়ে যাবে। সংক্ষেপে দুএকটা বিবৃত করব।
এখানে কিছু মানুষ এখনও জীবিত আছে। কারও চোখে জল নেই। হয়ত শুকিয়ে গেছে। যারা বেচে আছে তারা বাচতে চায়। চায় তাদের বেচে থাকার জন্য সামান্য আশ্রয় আর কিছু খাদ্য। প্রায় প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ মারা গেছে। কোন কোন পরিবার নিশ্চহ্ন হয়ে গেছে। তার চিহ্ন দেখা যায় খালি ভিটে। ভিটের চারদিকে কলাগাছের চিহ্ন। ঝড়ে কলাগাছ মাটির উপর থেকে এমনভাবে উঠে গেছে দেখলে মনে হয় কেউ বুজি কাঁচি দিয়ে সমান করে কেটে নিয়ে গেছে। সেই কলাগাছের গুড়ি থেকে নতুন পাতার কলি বেড়িয়েছে। একটি মেঠো পথ। বড় একটা গাছ পড়ে আছে। গাছের গুড়ি টপকাতে গিয়ে দেখি গাছের নীচে মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। তার পাশে একটা মরা বক। একটু দূরে একটা মরা সাপ।(এই ছবিটা দৈনিক সংবাদে ছাপা হয়েছিল) এ যেন মহা মিলন। মরার পর। একটা ডুবার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। ডুবার দিকে চোখ গেল। দেখি দুটি শিশুর মৃতদেহ ফুলে ডোল হয়ে আছে। পাশে একটা মহিষের মৃতদেহ। পথের দুধারে যেখানে সেখানে লাশ আর লাশ। মানুষের মৃতদেহ, গবাধিপশু আর পাখীর মৃতদেহ পড়ে আছে। মৃতদেহের সৎকার হয়নি। কারন যারা জীবিত আছে তারা নিজেদের আতœীয়স্বজনের মৃতদেহই কবর দিয়েছে। যারা অচেনা তাদের দেহ কবর দেবার কেউ নেই। তার মানে এসব মৃতদেহ অন্য কোন জায়গা থেকে এসেছে। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখলাম একটা বাড়ীও অক্ষত নেই। যা আছে তা ভাংগা বাড়ীর ঘরের চালা দিয়ে মাথা গুজার ঠাই করেছে। কোন কোন বাড়ীতে সবাই মরে গেছে, অলৌকিকভাবে বেচে গেছে শিশু। সেই সব শিশুদের দেখার কেউ নেই। প্রতিবেশিরা স্বজন হারিয়ে কেউ কেউ সেই শিশুদের কোলে নিয়েছে। যারা বেচে আছে তারা অনেকেই আহত বা অসুস্থ। চিকীৎসার ব্যবস্থা নেই। শুধু পানি পড়া। বাতাসে পচাঁ গন্ধ, পানিতে লাশের ছড়াছড়ি। সেই পানি থেকেও পচাঁ গন্ধ বেরিয়ে আসছে।
বিকালে লঞ্চ ছেড়ে দিল। অন্য এলাকায়। মফিজ সাহেব পরিচালনা করছে। মাঝরাতে লঞ্চ কোথাও থামল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। এমন জায়গায় থামল যেখানে কোন দুর্গন্ধ নেই। ফজরের আগেই আবার রওয়ানা দিল। সকাল হবার পরই দেখলাম সামনে লোকালয়। এখানে সমুদ্র লোকালয়ের সাথে একটা চিত্র এঁকেছে। একটা অর্ধ চন্দ্র আকার ধারন করেছে। বিরাট এলাকা নিয়ে। তার পাড়ের কিছুদূর থেকেই গ্রামের শুরু। এখনও দুএকটা গাছ দেখা যায় দূর থেকে। লঞ্চ আর একটু এগুতেই দেখি সমুদ্রের বাঁকে শবদেহের পাহাড়! হাজার হাজার শবদেহ এসে জড়ো হয়েছে এই বাঁকে। সমুদ্রের ঢেউ সব জড়ো করেছে এখানে। মানুষ, গবাধিপশু, পাখি আর ভাঙ্গা বাড়ীঘরের অংশ। বেশিরভাগই মহিষের মৃতদেহ ফুলে ডুল হয়ে আছে। ঢেউএর সাথে সাথে শবদেহ দুলছে, শবদেহের পাহাড় দুলছে। অনেক দূর পর্যন্ত। প্রায় তিন মাইল। সাত্তার বলল, এখানে না হলেও পাঁচ লাখের কম হবে না সব মিলিয়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বলতে পারলাম না। মৃতদেহের পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে লঞ্চ চলল আরও সামনে। এক জায়গায় লঞ্চ থামল। আমরা নেমে পড়লাম। বেশ দূর হাটার পর গ্রাম পেলাম। এখানে পাতলা বাড়ীঘর ছিল। খালি ভিটা দেখলেই বুঝা যায়। খুব কম মানুষের দেখা পেলাম। গ্রামের শেষ মাথায় দেখি এক জায়গায় খেজুরের পাতা মাটির উপর গেথে বেড়া তৈরি করেছে। ভেড়ার ভিতর কোন ঘর নেই। তবে আরও কতগুলো পাতা দিয়ে একটা খুপরি মত করেছে। এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম, কেউ আছেন কি এখানে?
উত্তর এল, হ আছি।
বুঝা গেল তিনি একজন মহিলা। আপনারা কয়জন আছেন।
আমি একলাই।
আপনার কি লাগবে? আমরা কিছু কাপরচোপড় নিয়ে এসেছি বলে আমি আরও কাছে যেতেই তিনি বললেন, ভিতরে আইয়েন না। আমার কাপড় নাই।
আমি থমকে গেলাম। তাইত! মহিলাকে এখন যদি স্লিপ দেই তাহলে তার জন্য আনবে কে? লঞ্চ বেশি দূরে নয়। আমি আবার ফিরে চললাম লঞ্চের দিকে। আমাকে দেখে মফিস সাহেব বললেন, এখনই ফিরে এলে যে? তাকে সব বললাম। বললাম একজন মানুষের যা প্রাপ্য সব আমাকে দিন। একটা শাড়ি বেশি দিবেন। আমি নিজে নিয়ে পৌছে দিব। ফিরে গেলাম খেজুর বাড়ীতে। বেড়ার পাশে রেখে বললাম, আপনার জন্য এখানে রেখে গেলাম। নিয়ে নিবেন।
আবার চলতে লাগলাম। বেশ দূর যাবার পর দেখি একটা গাছের মাথায় এক মহিলার লাশ। গাছের কান্ড এবং ডালা আছে। কোন পাতা নেই। মনে হল একটা হাত একটা ডালে এখনও আকড়ে ধরে আছে। বেচেঁ থাকার আপ্রান চেষ্টার নমুনা। একটু দাড়ালাম। (এই ছবিটা শিল্পী গোলাম মুস্তফা নিজে এঁেকছিলেন এবং কোন এক দৈনিকে ছাপা হয়েছিল)। মনে হল কোন এক পিতার আদরের দুলালি। বয়স বড়জোর সতের আঠার হবে। আবার চলতে লাগলাম। একটা বাড়ীতে এক বৃদ্ধকে পেলাম। একটা ভাংগা ঘরের চালা দিয়ে কয়েকটা বাঁশের উপর খাড়া করে মাথা গুজার ঠাঁই করেছে। জিজ্ঞেস করলাম, চাচা আপনার কি লাগবে? বৃদ্ব বললেন, আর কোন প্রয়োজন নাই। সবই তো গেল। কার জন্য আর বেচেঁ থাকব। আমি মরলামনা কেন? এই যে দেখছেন সব ভিটা খালি। আমার এই চার ভিটায় চারটা বড় বড় ঘর ছিল। ছেলে মেয়ে বউ নাতি নাতনী নিয়ে বাড়ী সব সময় গম গম করত। আজ কেউ নাই। এমন কি তাদের লাশও পেলাম না কোথাও। বৃদ্বকে শান্তনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। বললাম, এই যে চাচা, আপনার জন্য কিছু কাপড় আর হাড়ি পাতিলের ব্যবস্থা করছি। আপনি লঞ্চ থেকে নিয়ে আসবেন এবং আজ সন্ধ্যার আগে।
আর একটা গ্রামে গেলাম। এখানে মানুষ আরও কম। এক জায়গায় দেখলাম সাতটা গরু মরে পড়ে আছে। তখনও এক দড়িতে সব কয়টা বাধা। মনে হল কোন গোয়ালে এগুলো বাধা ছিল। আরও কয়েকটা গ্রাম ঘুরে ফিরে এলাম লঞ্চে। রাতে লঞ্চ ছেড়ে দিল। অন্য কোন খানে। ২১ তারিখে বারটার মধ্যেই আমাদের রসদ ফুরিয়ে গেল। আমাদের কাজ শেষ। আর সেই দিনই মজিবর খবর নিয়ে এল। প্রলয়ে কালে এক শিশুর জন্ম। সে গ্রামের নাম নিয়ে এসেছে এবং বাড়ীটাও চিনবে। গ্রামের নাম নেতাখালি। ফৈযুদ্দির বাড়ী। শুনে মনজুর রশিদ সাহেব বললেন, এ শিশুকে দেখতে যাব। চল দেখে আসি। সবাই গেলাম দেখতে। বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম কয়েক টুকরা টিন দিয়ে একটা ছোট খুপড়ি করেছে। তার পেছনে বিরাট একটা গাব গাছ। সম্পুর্ন অক্ষত। ডাক দিতেই ফৈজুদ্দি বেরিয়ে এল। মনজুর রশিদ সাহেব বললেন, আমরা স্বেচ্চাসেবক দল। আপনার শিশুটিকে দেখতে এলাম। শিশুটি নিয়ে এল। দেখতে ফুটফুটে। মফিজ সাহেব বলল, দেখতে তো বাপের মতই হয়েছে। মনজুর রশিদ সাহেব যে উদ্দেশ্যে গেলেন তা আমি অনুমান করতে পারি। তিনি গেছেন শিশুটির জন্মকাহিনী জন্মদাতার মুখ থেকে শুনতে। হয়ত একটা গল্প লিখে ফেলবেন। তিনি ফৈজুদ্দিকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে এই শিশুর জন্ম হল? ফৈজুদ্দি বলল, যখন হঠাৎ ঢেউ আসল তার আগে থেকেই আমি আর আমার স্ত্রী ঐযে গাব গাছটা দেখছের তার নীচে কাজ করছিলাম। প্রথম ঢেউ আসার পরই বুঝলাম ঘরে গিয়ে বাচা যাবে না। আমরা জানি গাব গাছের ডালা খুব শক্ত। সহজে ভাঙ্গেনা। তখন আমার মাথায় বুদ্বি এল, গাব গাছে উঠে যাই। আমার স্ত্রী পোয়াতি। তাকেও গাছে উঠতে সাহায্য করলাম। আমরা গাছে উঠার সাথে সাথেই আর একটা খুব বড় ঢেউ সবকিছু তছনছ করে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। দেখলাম আমাদের ঘরগুলো কিভাবে উড়ে গেল। তার ভিতর আমার মা বাবা দুটা ছোট ভাই সবাই ছিল। ঘরের ভিতর ছিল। ঘরের সাথে তারাও মুহুর্তে ভেসে গেল। গাছের অর্ধেক পানিতে ডুবে গেল। তারপর পানি বাড়ে আমরা আরও উপরে উঠি। ঝরের গতি বাড়ছে। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, খুব শক্ত করে ডালা ধরে রাকতে। এক সময় আমার স্ত্রী বলল, তার ব্যাথা উঠেছে। বুঝলাম বাচ্চার জন্ম হবে। আমরা তখন গাছের মগডালে। আমার স্ত্রীকে ভাল করে বসতে সাহায্য করলাম। এক সময় বাচ্চা হল। আমি আমার লুঙ্গিতে বাচ্চা ধরলাম। সকালে ঝড় কিছু থামল। গাছ থেকে নেমে এলাম।
সব শুনে আমরা আমাদের পকেট অনুযায়ী বাচ্চাকে উপহার দিলাম। মনজুর রশিদ সাহেব পকেটে হাত দিয়ে যা ছিল সবই দিয়ে দিলেন।
আমাদের কাজ শেষ। ফিরে চললাম। অনেক রাতে এসে পৌছলাম বরিশাল ঘাটে। সকালে ঢাকা রওয়ানার প্রস্তুতি চলল। এমন সময় একজন মানুষ এসে আমাদের সাথে ঢাকা যাবার আবদার করল। অনুমতি পেয়ে তিনি উঠলেন লঞ্চে। পরিচয় দিলেন নাম গোলাম মুস্তফা। লঞ্চ ছেড়ে দিচ্ছে এমন সময় রেড ক্রসের একটি বোট এসে থামল আমাদের লঞ্চের পাশে। জিজ্ঞেস করল আমরা ঢাকা যাচ্ছি কিনা। মনজুর রশিদ সাহেব বললেন, হ্যা, ঢাকা যাচ্ছি। তখন ভদ্রলোক বললেন, তোমাদের সাতে দুজন লোক নিয়ে যেতে হবে। এবং ঢাকায় অবস্থিত রেড ক্রস অফিসে পৌছে দিতে হবে। কারা এ দুজন?
তারা স্বামীস্ত্রী। নাম আজাহার এবং ফাতেমা। তাদের বাড়ী সন্দীপ। প্রলয়ের রাতে বিশ ফুট উচু প্রথম ঢেউ তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ঢেউয়ের পর তাদের আর কিছু মনে নেই। দুদিন পর আজহার চোখ মেলে দেখল সে একটা কাঠের খুটি ধরে আছে। নীচে পানি আর পানি, উপরে আকাশ। চারদিক তাকিয়ে দেখল তীরের কোন চিহ্ন নেই। বুঝল সে এখন অথৈই জলের মাঝখানে। ভাবতে লাগল কিভাবে বাচা যায়। দিন গেল, রাত গেল। পরের দিন দেখল তার পাশ দিয়ে মহিষের মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। ফুলে ডুল হয়ে আছ্।ে তার মাথায় বুদ্বি এল। দুটা মহিষকে এক সাথে বাধলে কেমন হয়। সে দুটা মহিষ টেনে এস সাথে করল। তার পরনে তখনও লুঙ্গিটা ছিল, গায়ে গেঞ্জি। লুঙ্গি ছিড়ে সে দুটি মহিষের পা এক সাথে বাধল। তারপর একটা কাঠ মহিষের উপর রাখল। তার উপর সে উঠে বসল। বেশ হয়েছে। অন্তত পানিতে ডুবে থাকতে হবে না। দুর্গন্ধ সহ্য করতে হবে। এভাবে কেটে গেল একদিন। পরের দিন সে দেখল একটু দূরে একটা বাঁশ ভেসে যাচ্ছে। বাঁেশর মাঝামাঝি কালোমত কি একটা জিনিষ। কালো জিনিষটা কি তা দেখার তার কৌতুহল হল। এর মাঝে সে এক টুকরা কাঠ যোগার করেছে। বৈঠা হিসেবে ব্যবহার করে। বৈঠা দিয়ে তার মহিষের নৌকা বেয়ে বাঁশের কাছাকাছি গেল। কালো জিনিষটা মনে হয় মানুষের চুল। আরও কাছে গিয়ে নিশ্চিন্ত হল, হা, এটা মানুষের মাথা। সে চুল ধরে টান দিয়ে উপরে উঠাল। আতকে উঠল! একি! এ যে তার স্ত্রী ফাতেমা! জীবিত আছে। কিন্তু অর্ধমৃত। মিলন। অলৌকিক মিলন! মহিষের উপর তোলে আজহার ব্যাকুল হয়ে পড়ল কিভাবে তার হুশ ফেরানো যায়। এখন দুপুর। আকাশে মেঘের ফাকে রোদের খেলা। বিকেলের দিকে ফাতেমা চোখ মেলে দেখে পাশে আজহার। সে তখনও বুঝতে পারেনি এখন কোথায় আছে। আজহারকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তারপর সব বুঝল। এখন তাদের বাচতে হবে। কিন্তু কিভাবে। এখন তারা কোথায় কিছুই অনুমান করতে পারে না।
আজহার আবার বুদ্বি বের করল। সে তার গায়ের গেঞ্জি খুলে তার বৈঠার মাথায় বাধল। মহিষের উপর দাড়িয়ে এটা আকাশের দিকে নাড়তে লাগল। সারাদিন কোন ফলাফল হল না। রাত গেল। আজহার আশা ছাড়বে না। পরের দিন সকাল থেকেই সে তার ঝ্ন্ডা উড়াতে লাগল। এক সময় কাজ হল। একটা স্পীড বোট এসে কাছে দাড়াল। বলল, উঠে এস। এরা রেড ক্রসের লোক। তারা এখন এই যুগলকে আমাদের কাছে পৌছে দিল। আমরা ঢাকায় পৌছে দিলাম। ঢাকার রেড ক্রস পৌছে দেবে তাদের ঠিকানায়। কি জানি আজ তারা কেমন আছে! প্রলয় শিশু আজ চল্লিমে পা দিল। কেমন আছে সে? কেমন আছে উপক’লের স্বজনহারানো মানুষ! তিন যুগ পেরিয়ে গেলেও তারা কি ভুলতে পেরেছে তাদের হারানো স্বজনের কথা! দু:সহ স্মৃতির কথা?



২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×