স্রেব্রেনিৎসার অসহায় এবং নিঃস্ব মায়েরা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বসনিয়া হ্যারৎজেগোভিনার যুদ্ধে ঠিক কত মানুষ মারা গেছে তার সঠিক হিসাব এখনো মেলেনি। স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমান পুরুষ এবং অল্প বয়স্ক ছেলে প্রাণ হারিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই আকারে গণহত্যা সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় সংঘটিত হয়েছে। ১৫ বছর এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে। কিন্তু যে সব মহিলা হারিয়েছেন স্বামী, ভাই বা সন্তানকে তাদের অবস্থা আজ কেমন ? তারা কিভাবে আছেন ?
সম্প্রতি বসনিয়া যুদ্ধের আরেক নেতা রাদোভান কারাদিচকে হাজির করা হয়েছে ডেন হাগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারী আদালতে। কিন্তু তিনি আদালতে হাজির হচ্ছেন না। তিনি সময় চাইছেন। গত সপ্তাহেই তাঁর আদালতে প্রথমবারের মত হাজির হওয়ার কথা ছিল। মামলার প্রথম শুনানি। কিন্তু রাদোভান কারাদিচ ছিলেন অনুপস্থিত। আদালতের বিজ্ঞ কৌঁসুলিরা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যার জন্য কারাদিচকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আদালতে তা প্রমাণ করা হবে। কিন্তু কারাদিচ কোথায় ? মিলোসোভিচের মত তিনিও কি আইনকে ফাঁকি দিতে পারবেন ? আমরা কি সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি ?
ডেন হাগের আদালতে বিচারপতি ওগোন কোন্ শুরু করেন বিচারকার্য কারাদিচের অনুপস্থিতিতে। ২০ মিনিট এভাবেই চলে। এরপর আদালত মুলতবি ঘোষণা করা হয়। কারাদিচ ঠিকই আদালত থেকে দূরে ছিলেন, কিন্তু খুব কাছেই ছিলেন স্রেব্রেনিৎসার সেসব মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যা- যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, যারা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাদের বলা হচ্ছে ‘স্রেব্রেনিৎসার মায়েরা'। বসনিয়া হ্যারৎসেগোভিনা থেকে তারা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তারা সবাই বিচার চান। তারা দেখতে চান রাদোভান কারাদিচের শাস্তি হোক।
ফেরিদা নিসিচ বসনিয়ার নাগরিক। তিনি এসেছেন ডেন হাগে। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি জানান, বিচারকার্য যেভাবে চলছে তা একেবারেই ঠিক নয়। কারাদিচকে সময় দেয়া হচ্ছে। শাস্তি নয় সে সময় পাচ্ছে। গণহত্যার পর বেশ কয়েক বছর সে খুব ভাল ছিল। সে সুখে সময় কাটিয়েছে।
যে সব মহিলা ডেন হাগে উপস্থিত ছিলেন ১৯৯৫ সালের স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যায় তারা তাদের বাবা, স্বামী, সন্তান এবং ভাইকে হারিয়েছেন৷ শুরুতেই বলা হয়েছে স্রেব্রেনিৎসায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমান পুরুষ এলং ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। সবাই প্রাণ হারিয়েছেন সার্বিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে। কারাদিচ সে দোষে দোষী। রাটকো ম্লাদিচ স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার নীল নক্সা আঁকেন। কারাদিচ সেই অনুযায়ী কাজ করেন। রাটকো ম্লাদিচ এখনো পলাতক।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সার্ব সেনারা প্রায় প্রিতিদিনই বসনিয়ার মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম এবং শহরগুলোতে হানা দিত। বসনিয়ার মহিলা এবং শিশুদের তারা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়েছে। সার্বরা কখনোই স্রেব্রেনিৎসা ছেড়ে চলে যায়নি। তারা সবসময়ই আশে পাশে থাকতো। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সার্ব সেনারা গণহত্যা চালায়। প্রায় ৩০ হাজার বসনীয় নারী-পুরুষ-শিশুকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। তাদের দোষ ছিল একটাই - তারা ধর্মে মুসলমান। এই ৩০ হাজারের মধ্যে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়।
জার্মান মহিলা আইনজীবি হিলডেগ্রাড উরটস রেট্সলাফ৷ ৫৮ বছর বয়স্কা উরটস-রেট্সলাফ ১৯৯৫ সাল থেকে ডেন হাগে আইনজীবি হিসেবে কাজ করছেন। মিলোসোভিচের বিপক্ষে তিনি লড়েছিলেন। কিন্তু মিলোসোভিচের পরিণতি কি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। ১৯৯৬ সালে তিনি বসনিয়ার গোরাসেতে যান প্রমাণাদি যোগাড় করার জন্য। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে, নদির মধ্যে, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি মাসের পর মাস সেখানে প্রমাণ খুঁজেছেন। বেশ কিছুদিন গোরাসদেতে তাঁকে থাকতেও হয়েছে। এরপর আরো কিছুদিন থাকতে হয়েছিল শানস্কিতে। তিনি বললেন, তখন আমাদের নানা রকম হোটেলে থাকতে হয়েছিল। সেখানে সবাই হোটেল বলে। কোন হোটেলেরই কোন নাম নেই। সে হোটেলগুলোতে কোন হিটিং সিস্টেম নেই। দেয়ালগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গোরাসেদের চেয়ে ভয়ানক অবস্থা ছিল। শীতকালে আমরা সারাটা সময়ই ঠান্ডায় জমে ছিলাম।
বসনিয়ায় যুদ্ধের সময় সার্ব সেনারা মেয়েদের গণহারে ধর্ষণ করেছিল। ধর্ষণের পর হত্যা। তিনজন উচ্চপদস্থ সেনার সে জন্য সাজা হয়েছিল। সবাই শাস্তি হিসেবে পেয়েছিলেন ২৮ বছরের কারাদন্ড। বসনিয়ার যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল যে ধর্ষণের জন্য এদের আটক করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধে তাদের সাজা হয়েছে। মানবাধিকার লংঘনের জন্য আজ তারা সাজা ভোগ করছে। এই প্রথম বারের মত এধরনের ঘটনা ঘটছে।
রাদোভান কারাদিচের গ্রেপ্তার, তাঁর শাস্তি এবং রাটকো ম্লাদিচের পালিয়ে বেড়ানো প্রসঙ্গে উরটস রেট্সলাফ জানান, আমি অনেক সময় ভেবেছি, নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি আমি এখানে কি করছি ? কার কি হল তাতে কিছুই এসে যায় না। এদের সবার বিরুদ্ধে মামাল দায়ের করা হয়েছে। সবাই তাদের খুঁজছে এবং তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, নাহ্, অনেক হয়েছে এবার সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেই। এখানে শুধু শুধু সময় নষ্ট। আমার স্বামী প্রায়ই আমাকে বলেন, এতগুলো আসামীর মধ্যে থেকে যখন অন্তত একজন ধরা পড়ে এবং তাঁকে শাস্তি দেয়া হয় তখন তা নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি সাফল্য৷ এটিই বিচার!
তথ্যসূত্রঃ
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম
আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!
এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন