somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“এবার আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভুলে যাবো”

১২ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“এবার আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভুলে যাবো”

অনুরাধা,

“এবার আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভুলে যাবো”- এই কথাটা তুমি আজকাল প্রতি চিঠিতেই লেখো। কেন লেখো তা আমি জানিনা। কখনো সেভাবে জানার আগ্রহ হয়নি। এটা কি তোমার অভিমানের কথা নাকি মনের কথা সেটাও বুঝতে পারিনা। আমি কখনো তোমার কাছে জানতে চাইনি। সত্যি বলতে কি তোমার মনের সব কথা আমি জানিনা। একটা মানুষ কখন কি ভাবে, কখন কি করে সেটা অনুমান করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ তিনটে বছর তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের প্রথম সূত্রপাত জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতিমূলক বিতর্কে অংশ নেয়া থেকে। তুমি আমি নিজ নিজ হলের দলপতি হয়ে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। সেই যে একসাথে দল বেঁধে ঢাকায় যাওয়া, নিজ নিজ হলের বিজয় নিশ্চিত করে আবার একই সাথে ফিরে আসা। এরপর সাহিত্য বার্ষিকীর প্রতিটি আসরে তোমার আমার নিয়মিত অংশগ্রহণ।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে লাইব্রেরী আর ক্লাশের সময়টুকু বাদে বাকি সময়টা আড্ডা দিয়েই কাটিয়েছি। তুমি বরাবরই কম কথা বলার মানুষ। আর আমি ঠিক তার উল্টো। বকবক করে সবাইকে অতিষ্ট করে তুলতাম। লীনা, রুবি, রুবা, তাহেরা সবাই নীরব শ্রোতা হয়ে আমার প্যাচাল শুনতো। তুমি শুধু মুখ টিপে হাসতে। বিরক্ত হতে কিনা বুঝতে পারতামনা। আমাদের নির্মল বন্ধুত্ব আর আড্ডা সম্পর্কে কাছের সবাই জানতো। একসময় মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলো। তুমি খুলনা চলে গেলে। রেজাল্ট হবার পরে যখন এসেছিল আমি তখন ঢাকায়। একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম। এরপর তোমার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। যোগাযোগ ছিল শুধু চিঠির মাধ্যমে। একদিন আবার হয়তো দেখা হবে এমন বিশ্বাস ছিল দুজনের মনেই।

খুলনায় ফিরে চলে যাবার পর আমার রাজশাহীর বাসার ঠিকানায় নিয়মিত তোমার চিঠি আসতো। গত তিন বছরে অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি। আমি বাড়ী থাকলে সরাসরি চিঠি আমার হাতে আসতো আর যদি না থাকতাম তখন ছোট ভাই সেই চিঠিগুলো ঢাকায় পাঠিয়ে দিতো অথবা নিজে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো। তুমি কখনোই আমাকে ঢাকার ঠিকানায় চিঠি লিখতেনা। বলেও কাজ হয়নি। ঢাকায় আমার স্থায়ী কোন ঠিকানা ছিলনা। মামার বাসায় থাকতাম। আর কার না কার হাতে সেই চিঠি পরে সেই ভয়ে তুমি লিখতেনা। অথচ চিঠিতে ভয় পাওয়ার মতো তেমন কিছু লেখা থাকতোনা। আমার বাসার সবাই তোমাকে চিনতো বলেই হয়তো ঐ ঠিকানায় চিঠি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে। আর আমার মা ছিল তোমার অনেক প্রিয় একজন মানুষ। মায়ের হাতের রান্না ও আচারের প্রশংসা তোমার মুখ থেকে সমগ্র ক্যাম্পাসে সেটা ছড়াতে বাকি থাকেনি। মা’ও তোমার চিঠি পেতো আর আমাকে লেখা চিঠিটা সযত্নে উঠিয়ে রেখে দিতো। বাসার সবাই জানতো তুমি আমার খুব ভাল একজন বন্ধু।

এবার মাস তিনেকের মধ্যে তোমার কোন চিঠি পাইনি। কেমন অস্থির লাগছিল মনটা। তুমি অসুস্থ কিনা কে জানে! মনে আছে তোমার- সেই যে বসন্তের এক পড়ন্ত বিকেলে তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা। বিতর্কের একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে। কিছু তথ্য ও যুক্তি গুছিয়ে লিখে দিতে বলেছিলে। মন্নুজান হলের গেট ছেড়ে একটু দূরে একটা আম গাছের নীচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলাম। কাকতলীয়ভাবে তোমার সাথে শেষ দেখাটাও ঐ আম গাছের নীচেই। পরীক্ষা শেষ তাই তোমার হল ছেড়ে দেশে চলে যাবার কথা। আর কখনো হয়তো এই ক্যাম্পাসে আসা হবে কিনা কে জানে! হয়তো আসতে হবে। সার্টিফিকেট, মার্কসীট কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে। বেড়াতে আর আসা হবেনা। ক্যাম্পাসের সবুজ গাছের লম্বা সারি আর রঙবেরঙের ফোটা ফুল আর তাকিয়ে দেখা হবেনা। লাইব্রেরীর সিঁড়িতে আর বসা হবেনা। টেবিলে বসে পড়ার ফাঁকে আর কখনো সেভাবে গল্প করা হবেনা। শেষ দিন তোমাকে বলেছিলাম দেখা না হোক, আমি যেন তোমার চিঠি পাই। তুমি কথা রেখেছিলে। তিনমাস না যেতেই প্রথম তোমার চিঠি পাই। এর পর প্রতি মাসেই তুমি লিখতে। আমিও সময় করে উত্তর দিয়েছি। প্রত্যাশিত প্রথম চিঠিটা পাই ঢাকায় চাকরি নিয়ে আসার মাস খানেক পর। সেই চিঠি পেয়ে স্বভাবতই আমার উচ্ছাস ছিল! তুমি যে আমাকে ভুলে যাওনি তার প্রমাণ পেলাম। সেই রাতেই তোমার চিঠির জবাব দিয়েছিলাম। লিখেছিলাম তুমি আমাকে ভুলে যাবেনা এমনটাই বিশ্বাস করি। আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি, ভুলবনা সেটাও ঠিক। আমি আশায় বুক বেঁধে থাকি- কখন তোমার চিঠি পাবো।

তুমি মনভুলো সেটা বলবোনা তবে তুমি যে অভিমানী সেটা আমি ভাল করেই জানি। তুমি আমি এই তিন বছরের বন্ধুত্ব জীবনে অনেকবার প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। কোন প্রতীজ্ঞাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এইকথা মনে করে দুজনেই খুব হাসতাম। যখন ছুটিতে তুমি বাড়ী যেতে, বলতে- চিঠি লিখবে, তুমি লিখলে আমি লিখবো। আমি বলতাম, তুমি আগে লিখবে। তুমি হেসে বলতে- "তাহলেই লবডঙ্কা! আমি কোন চিঠিই লিখবোনা"। আমি জানতাম তুমি মনের ভুলে হলেও আমাকে লিখবে। তুমি লিখেছো। ভার্সিটি পড়তে এমনটা অনেকবার হয়েছে। কথায় কথায় রাগ করে বেশ কিছুদিন কথা বন্ধ রাখতে। তরপর হঠাৎ একটা চিরকুট পাঠাতে। "কথা না বলে থাকতে পারছিনা, এবার তুমি কথা না বললে আমি মন্নুজানের পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেবো"”। তখন আমাকে বাধ্য হয়ে কথা বলতে হতো। তবে এটাও ঠিক মনে মনে তোমার মন্নুজানের পুকুরের জলে ঝাঁপ দেবার দৃশ্যটা দেখার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। কিন্তু তুমি সাঁতার জানতে কিনা এটা ভেবে ক্ষান্ত হয়েছি। বলা যায়না তুমি যা জেদী, হয়তো সত্যি সত্যি পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এভাবে একের পর এক তোমার চিরকুট পেয়েছি। আমি চিরকুটের বদলে চিঠিই লিখেছি তোমাকে। রাজশাহীর সেই প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে আমি অতিষ্ট হয়ে অপেক্ষা করেছি তোমার চিঠির। কখন তোমার লেখা একটা চিঠি এক পশলা বৃষ্টির মতো আমার মনের সমস্ত অস্থিরতা, সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেবে- সেই ভরষায় বসে থেকেছি। একদিন এক চিঠিতে লিখেই ফেললে- "তোমাকে ভুলে যেতে চাই, তোমাকে ভুলে যাওয়াই উচিৎ। কারণ তোমার কথা মনে করলেই আমি আর অন্য কারো কথা ভাবতে পারিনা"। সেই প্রথম আমি তোমাকে নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবতে শুরু করলাম। এভাবেই সময় কাটতে থাকলো। দেখতে দেখতে আরো একটা বসন্ত পেরিয়ে গেল। আমার মনে হলো আমি যেন কোথাও একটা ভুল করে ফেলেছি। ভুলটা ধরতে আমার সময় লেগেছিল। মনের কথাটা মনে চেপে রাখা ঠিক হয়নি।

এবার বর্ষায় আমার খুব মন খারাপ ছিল। সারাদিন রিমঝিম বৃষ্টি অথচ তোমার কোন খবর নেই। তোমার কোন চিঠি নেই। জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বৃষ্টি দেখতাম। বৃষ্টি হলেই তোমাকে মনে পড়তো। মনে আছে, ক্লাশ শেষে কতদিন তুমি আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি। গাছের নীচে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। একদিন শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়েছিলে, মনে আছে? সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। সন্ধ্যায় ভার্সিটির অডিটোরিয়ামে বর্ষাবরণ অনুষ্ঠান ছিল। আমরা তখন হলের ভেতরে। বাইরে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড় শেষে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি আর কিছুতেই থামেনা। অনুষ্ঠান শেষ। আমরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি একটা রিক্সার জন্য। কোনরকমে একটা রিক্সায় দুজনে কাক ভেজা হয়ে তোমাকে হলে নামিয়ে দিলাম। সেই প্রথম তোমার সাথে আমি রিক্সায় চড়লাম। আর কখনো দু'জনে এক রিক্সায় উঠিনি। আজকাল কেন জানি সেই পুরোনো স্মৃতিগুলো মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। পহেলা বৈশাখের সেই বৃষ্টিঝরা রাতের কথা মনে হলেই মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। আর এই সময়েই তুমি ভুলে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করে আমাকে চিঠি লিখলে। আমার মনের সুপ্ত এক আকাঙ্ক্ষা বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি বিশ্বাসে নড়েচড়ে উঠলাম। আমি জানি তুমি আমাকে ভুলতে চেয়েও কখনো ভুলতে পারবেনা। আমি তোমাকে কিছুতেই ভুলতে দেবোনা। ইতি-

আনন্দ,
যাকে তুমি “অনি” বলে ডাকো।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১:৪৮
১৭টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যারিস্টার সুমন দায়মুক্ত , চু্ন্নু সাহেব কি করবনে ?

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৭


দেশে প্রথম কোন সংসদ সদস্য তার বরাদ্ধের ব্যাপারে Facebook এ পোষ্ট দিয়ে জানিয়ে থাকেন তিনি কি পেলেন এবং কোথায় সে টাকা খরচ করা হবে বা হচ্ছে মানুষ এসব বিষয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৮










চিত্রকলার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোট বেলায় যেটুকু শিখেছিলেন গৃ্হশিক্ষকের কাছে আর পাঁচজন শিশু যেমন শেখে। সে ভাবে আঁকতেও চাননি কোন দিন। চাননি নিজে আর্টিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতা বনাম ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত বিবিধ দোষ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৪



জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতার বিবেচনায় মুমিন ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত দোষারোপ আমলে নেয় না। আমার ইসলাম সংক্রান্ত পোষ্ট সমূহে অমুসলিমগণ ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে বিবিধ দোষের কথা উপস্থাপন করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×