প্রিয় সন্তান,
অনেক আবেগ আর ভালবাসা নিয়ে তোমায় লিখছি আজ ।জানি না এই চিঠি, এই আকুল আকুতি তোমার জন্মদাতা পিতার এই প্রানের প্রার্থনা তোমার কাছে কোনো দিন পৌছাবে কিনা ।তুমি তো এখনও চোখ মেলোনি এই পৃথিবী্র আলোয় ।তুমি তোমার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছ তোমার মমতাময়ী মায়ের মধ্যে ।তার রুগ্ন শরীরের ভেতরে দিন দিন বেড়ে উঠছ তুমি ।আমি তোমার মায়ের পেটে হাত রেখে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করি ।তোমার নাড়াচড়া তোমার এক্কাদোক্কা – সব বুঝতে পারি আমি ।
প্রিয় সন্তান, ডাক্তারের হিসাব অনুযায়ী, আরও প্রায় দুই মাস সময় লাগবে তোমার আসতে ।সবাই তোমার আগমনের আশায় অপেক্ষমাণ ।তোমার দাদুমণি ,তোমার কাক্কু,তোমার খালামণিরা সবাই তোমার তুলতুলে গায়ে আদর দিতে অপেক্ষমাণ ।সবাই কানপেতে আছে তোমার প্রথম কান্নার পবিত্র সংগীত শুনতে ।ভালবাসার নকশি কাথা নিয়ে সবাই প্রস্তুত তোমাকে বরণ করতে ।তোমার আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন, প্রিয় ।
প্রিয় সন্তান আমার, ডাক্তার বলেছেন তুমি আমাদের কন্যাসন্তান ।দুইদিন ধরে কেবলই ভাবছি,তোমার একটা নাম দেয়া দরকার ।একটি সুন্দর কবিতার মতো নাম ।কিন্তু কিছুতেই মনে আসছে না সে রকম নাম ।ভারি বিপদ হল তো! তোমার জন্য একটা নাম খুজে পাচ্ছি না ।আচ্ছা ,তুমিই বলো,যেনতেন নাম হলে কি চলে ।আমার মেয়ের নাম হতে হবে কবিতার মতো সুন্দর ,তাই না! আচ্ছা পারমিতা নামটা সুন্দর না ? পছন্দ হয় তোমার? ঠিক আছে, তোমার নাম দিলাম পারমিতা ।পারমিতা মানে কি জানো? পারমিতা মানে হলো লক্ষী মেয়ে, যে তার আম্মুর কথা শোনে; নাড়াচাড়া করে না ।নাড়াচাড়া করলে যে আম্মুর ভারি কষ্ট হয়-তুমি বোঝনা কেন, সোনা ।
প্রিয় পারমিতা, তুমি দেখতে কেমন হবে-তোমার চোখ কেমন হবে,চুল কেমন হবে,আমি জানব না ।তুমি হাসলে তোমাকে কেমন দেখাবে,অভিমানে অশ্রু ঝরলে তোমাকে কেমন লাগবে, আমি দেখতে পাব না ।প্রতিবেশী কোনো পাজি ছেলে তোমায় কটুকথা বললে আমি এক ধমকে তার পিলে চমকে দিতে পারব না ।মৃত মানুষেরা ওসব পারে না,মা ।ডাক্তারের ধারাণা, তোমার মাদকাসক্ত মুমূর্ষু পিতা বড়জোর আর পনেরো দিন বাঁচবে ।পনেরো দিন বড় অল্প সময় । তোমার আসতে এত দেরি হছে কেন,সোনা ।
কাল কী হয়েছে জানো,পারু? মাঝরাত্তিরে তোমার মা যখন ঘুমিয়ে ছিলেন,আমি সন্তর্পণে তোমার মায়ের পেটে,যেখানে তুমি আছ, অজস্র চুমু খেয়েছি ।মনে হলো, আমি আমার সন্তানের শরীর জুড়ে মেখে দিয়েছি ভালবাসার চিহ্ন ।তুমি কি বুঝতে পেরেছ পারু, তোমার পরাজিত পিতার প্রথম এবং শেষ চুম্বন? টের পেয়েছ আমার স্পর্শ?
প্রিয় পারমিতা,হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তোমার মুমূর্ষু পিতা একটি সহজ সপ্ন দেখে, তুমি মানুষ হবে-অনেক বড় মানুষ ।রোকেয়ার মত নয়,জোয়ান অব আর্কের মতো নয়, মাদার তেরেসার মত নয়, তোমার মত- তোমার নিজের মতো করে মহৎ হবে তুমি । কখনো মাদক ছোবে না,প্রিয় ।তোমার পিতার মত পরিণতি যেন কারও না হয়, যেন একটি সন্তানও বঞ্ছিত না হয় পিতৃস্নেহের পুস্পমঞ্জরি থেকে ।আর... এই দেশটিকে ভালবেসো । আমাদের দেশটি বড় অভাগা,বড় দুঃখী ।তুমি তারে ভালবেসো,প্রিয় ।
তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি কাঠগোলাপের ঘ্রাণ ।আগামী বর্ষায়-যখন তুমি আসবে প্রতিক্ষারপ্রহর শেষে- তখন গাছভর্তি ফুল থাকবে তাতে ।সেই অনাগত ফুলের সমস্ত সৌন্দর্য দিলাম তোমার আগমনী উপহার ।ভালবাসা নাও ।
তোমার পরাজিত বাবা ।
লিখাটি প্রথমআলো’র ৭ মার্চ ২০০৯ তারিখের “ছুটিরদিনে” থেকে সংগৃহীত ।