somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হলিউডের চলচ্চিত্রে ইতিহাস-বিকৃতি

০২ রা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত কয়েক দশক ধরেই বিশ্বজুড়ে প্রচার-মাধ্যমের যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে এক-মেরুকেন্দ্রীক করতে ও বিশ্বের অন্য সমাজগুলোকে মার্কিনীকরণ করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই কর্মসূচী ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মার্কিন গণমাধ্যম ও বিশেষ করে হলিউডের চলচ্চিত্র।
মার্কিন সরকার ও রাজনীতিবিদরা তাদের এসব লক্ষ্য বা কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়নের জন্য অকাট্য ঐতিহাসিক সত্য বা বাস্তবতাকে বিকৃত করছে এবং অনেকে ক্ষেত্রে সত্যের পুরো উল্টো চিত্র তুলে ধরছে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য সাজিয়ে। হলিউডের চলচ্চিত্রে কিভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে সে বিষয়ে তথ্য ও প্রমাণ-ভিত্তিক কিছু বক্তব্য তুলে ধরবো আজকের এই আলোচনায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক বিভিন্ন সংস্থার নির্দেশে হলিউডের চলচ্চিত্রে যেভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে তাতে পাশ্চাত্যেরই অনেক গবেষক ও গণমাধ্যম ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সম্প্রতি বৃটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফও এই প্রতিবাদে শরীক হয়েছে। দৈনিকটি হলিউডের এ তৎপরতার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে হলিউডের চলচ্চিত্রে এত ব্যাপক মাত্রায় ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে যে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে বাস্তব তথ্য জানার পরও প্রায়ই ভুল করছে এবং দিশাহারা হয়ে পড়ছে। চলচ্চিত্র বা ছায়াছবি এত শক্তিশালী যে শিক্ষার্থীরা বই-পুস্তকের লেখা ও শিক্ষকদের বক্তব্য জনার পরও ছায়াছবিতে যা দেখেছে সেটাই বেশি বিশ্বাস করছে।
ওয়াশিংটনের সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক এ্যান্ড্রু বাটলার ইতিহাস শিক্ষায় চলচ্চিত্রের প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন, গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা যদি বই-পুস্তক পড়ার পাশাপাশি শিক্ষার জন্য ছায়াছবিও পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে তাদের শিক্ষার লেভেল বা মনে রাখার মাত্রা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। তিনি আরো বলেছেন, দুঃখজনক ব্যাপার হল, হলিউডের তারকারা প্রায়ই ইতিহাস বিষয়ক নির্জলা মিথ্যা বা বিকৃত তথ্যের ছায়াছবিতে অভিনয় করছেন। আর এ বিষয়টি শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীসহ শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়।

একদল মার্কিন নাগরিকের সহায়তায় গত কয়েক দশক ধরে হলিউডের চলচ্চিত্র ইহুদিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হলিউডে নির্মিত ঐতিহাসিক ও ধর্ম বিষয়ক অনেক ছায়াছবি ইহুদিবাদী ও বর্ণবাদী চিন্তাধারা প্রচারের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। সত্য-গোপন এবং মিথ্যার বেসাতি এসব ছায়াছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থলোভী ইহুদিবাদীরা হলিউড প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের পুঁজিবাদী স্বার্থ সিদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী ইহুদিবাদী চিন্তাধারা প্রচারের লাভজনক বা মোক্ষম মাধ্যমে রূপান্তরিত করার টার্গেট নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিবাদীরা এ ব্যাপারে তাদের তৎপরতা জোরদার করে।
"১৯৮৪" শীর্ষক বইয়ে জর্জ অরওয়েল লিখেছেন, বর্তমানের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতকে হাতের মুঠোয় আনতে হবে। এই নীতির আলোকে হলিউডের অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা বিশেষ দৃষ্টিকোন বা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য ছায়াছবির মাধ্যমে ইতিহাসের মন-গড়া তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা করে। এ ধরনের একটি ছায়াছবির দৃষ্টান্ত হল "লাইভস অব জিউস ইন দ্যা প্রমিজড ল্যান্ড" বা প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের জীবন শীর্ষক ছায়াছবি। ১৯১২ সালে এ ছায়াছবি নির্মিত হয়। ১৯২৩ সালে নির্মিত হয় এ ধরনের ছায়াছবি আর্মিস অব জিউস বা ইহুদি বাহিনী। এ দুটি ছায়াছবিতে অত্যন্ত ঔদ্ধত্য দেখিয়ে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ইহুদিরাই ছিল ফিলিস্তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। অথচ ঐতিহাসিক বই-পুস্তকে দেখা যায় সে সময় ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ ছিল ইহুদি। ইহুদি বাহিনী বলতে চিত্র নির্মাতা ফিলিস্তিনের কতিপয় ইহুদিদেরকে বুঝিয়েছেন যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের পক্ষ নিয়ে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু আসলে এই ইহুদি বাহিনী ছিল কয়েকটি সক্রিয় সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী দল। ফিলিস্তিনীদের প্রতি হুমকি দেয়ার জন্য এই সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।

ইহুদিবাদীদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বিংশ শতকের প্রথমার্ধে আরো অনেক ছায়াছবি নির্মাণ করা হয়েছিল। এসবের মধ্যে ১৯৩২ সালে নির্মিত এটা তোমার ভূমি বা দিস ইজ ইয়োর ল্যান্ড ও ১৯৩৩ সালে নির্মিত সাবেরা নামের ছায়াছবির কথা উল্লেখ করা যায়। ইহুদিবাদের পক্ষে প্রচারণার জন্য নির্মিত এ ধরনের অধিকাংশ ছায়াছবির নির্মাতা ছিলেন আলেক্সান্ডার ফোর্ড নামের এক ব্যক্তি। ফোর্ড ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে আরবদের পরাজয়ের পর অধিকৃত ফিলিস্তিনে অভিবাসন করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আসতে উৎসাহিত করার জন্য ছায়াছবি নির্মাণ করতে থাকেন। এ সময় ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের পিতৃপুরুষের আবাসস্থল ও প্রতিশ্রুত ভূমি হিসেবে উল্লেখ করে সেখানে তাদের অভিবাসনকে যৌক্তিক বলে দেখানোর উদ্দেশ্যে স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ প্রায় ১৫০ টি ছায়াছবি নির্মিত হয়েছিল ।

ইহুদিবাদী ইসরাইল গঠনের পর হলিউডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী ইহুদিবাদীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মোকাবেলা করা। এ ছাড়াও দখলদার ইসরাইলের সমর্থনে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকে হলিউড। এ সময় হলিউড ইড্ডিশ নামের এক ধরনের বিশেষ চলচ্চিত্র শিল্প বা ধারা গড়ে তোলে। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে প্রায় এক হাজার বছর ধরে প্রচলিত ইহুদিদের ভাষাকে ইড্ডিশ বলা হয়। এসব ছায়াছবিতে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে যৌক্তিক ও বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে এবং ফিলিস্তিনীদেরকে ঐ অঞ্চলকে থেকে বহিস্কারের জন্য তথ্য বা যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। এসব ছায়াছবিতে ইহুদিবাদীদেরকে বীর ও ন্যায়কামী এবং মুসলমান ও আরবদেরকে বিশ্বাসঘাতক বা বর্বর হিসেবে দেখানো হয়। কেবল ১৯৬০ সালেই হলিউড এ ধরনের দশটি ছায়াছবি নির্মাণ করে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জ্যাক জি শাহীনের মতে, এ ধরনের ছায়াছবি মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষের ধারণায়ও পরিবর্তন আনছে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মার্কিন টেলিভিশন ও হলিউডের ওপর ইহুদিবাদীদের কর্তৃত্ব থাকায় এ জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে অ-ইহুদিদেরকে। তারা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে মানুষের মধ্যে কৃত্রিম অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করছে। হলিউড মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ঘৃণা উশকে দেয়ার যে প্রথা বা রীতি চালু করেছে লক্ষ লক্ষ মার্কিন নাগরিক তাতে প্রভাবিত হচ্ছে এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সরলমনা মানুষকেও প্রভাবিত করছে।
হলিউড ইরানের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও মিথ্যা তথ্য প্রচার এবং ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছে। নেভার উইদআউট মাই ডটার, আলেক্সান্ডার ও থ্রি হান্ড্রেড শীর্ষক ছায়াছবিই এর দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ ধরনের ছায়াছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য সফল হয় নি। কারণ, সচেতন জাতি ও নাগরিকরা এ ধরনের প্রচারণা বিশ্বাস করছে না। থ্রি হান্ড্রেড শীর্ষক ছায়াছবির সমালোচনা করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, " এটা নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ছায়াছবি। এ ছায়াছবিতে কেবল বাহ্যিক দিকের ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং অত্যন্ত অর্বাচীনের মত ইরান ও গ্রীসের সেনাদের শক্তিকে পরস্পরের সমতুল্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু এতে সত্যতার লেশমাত্র নেই। "

একজন দর্শক এই ছায়াছবি দেখে বলেছেন, " রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ছায়াছবিতে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। এ ছায়াছবিতে গ্রীক সেনাদের খুব বুদ্ধিমান ও দৈহিক দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ইরানী সম্রাট খাশাইয়ার শাহ বা এক্সারেক্সেসের সেনাদেরকে অত্যন্ত নির্দয় দেখানো হয়েছে। "
আসলে ইতিহাস সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞ তারা জানেন যে, বিশ্ব সভ্যতায় ইরানী জাতি ও মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল এবং অনন্য অবদান কিছু মিথ্যা প্রচারের ফলে কখনও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।#
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×