somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অচিন পাখি

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঠাণ্ডা মাটির মেঝের উপর খড়ের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত এই স্থানটিতে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে পুরোনো এই চালাঘরটির আদিম ছাতখানির প্রাগৈতিহাসিক কাঠের তক্তার পাশে জমাট বাঁধা অন্ধকারের নিভৃতে খড়কুটোর পাখির বাসাটা আবছা দৃষ্টিগোচর হয়।

ছোট এই চালাঘর। আর পাখির বাসাটা শূন্য। পাখিটা বাইরে গেছে। একটু আগেই।

খড়ের উষ্ণতা। খড়ের শুষ্কতা। আর স্যাঁতসেঁতে শীতল ছনকাঠের এই ছোট্ট চালাঘর। ছাতখানি বেশ উঁচু। চারপাশে জমা হয়ে আছে কাঠের তুষ, কাঠের স্তূপ, খড়ের গাদা। আছে মরচে-পরা টিনের দেয়াল, ছনের ছাউনি, বাঁশের স্তম্ভ, কাঠের পাটাতন। বড় চিলেকোঠার মতন বটে, কিন্তু ওটার মত আন্তরিক নয়। ঘরোয়া নয়। কাছে ডাকে না, দূরেও ঠেলে দেয় না, এমনই এক চালাঘর। পরিত্যক্ত এবং জরাজীর্ণ এক বাংলোর সাথেই সংযুক্ত এই চালাঘরটি। একসময় গম্ভীর ঐ বাংলোখানির অংশ ছিলো বুঝি, এখন আর নয়। নিজেই খুঁজে নিয়েছে নিজের এক ভঙ্গুর স্বরূপ। আত্মগ্লানিতে ভোগা এই চালাঘর। তার শীতল গর্ভে এখন শুধু ঠাঁই পায় কিছু ভগ্ন আসবাবপত্র, বিদীর্ণ কাঠ-সামগ্রী, জীর্ণ অকেজো এক ধানের গোলা, আর কিছু বোবা প্রাণী – একটি বাইরে গেছে, আরেকটি খড়ের গাদার উষ্ণতায়।

চারদিকে ঘন-জঙ্গল। পাহাড়ী জঙ্গল। পেছনে পাহাড়। সামনে পাহাড়। আর এই পাহাড়ের উপর এক পরিত্যক্ত বাংলোর পাশেই এক ছিন্ন চালাঘর। সময়টা মাঘ মাস। খড়ের গাদার উষ্ণতা বড় প্রয়োজন।

মাটির কাছাকাছি শুয়ে আছো তুমি। মাটি থেকে পাওয়া মাটি-গন্ধ খুব কাছ থেকেই পাচ্ছো তাই। নিশ্চয়ই জানো কেমন সেই অনুভূতি। ফিস্‌ফিসানি কত কথা ঐ ঘ্রাণের মাঝে। এ এক নেশাময় গন্ধ, এই মাটির গন্ধ। সেই গন্ধের সাথে আবার মিশে আছে তারই এক মহা-স্তুতিগান। তারই বীরত্ব-গাঁথা। সেই মাটির বিশালত্বের কাছে নিজের ভয়ানক সীমাবদ্ধতার প্রকাশে তোমার শরীর তাই শিরশির করতেই পারে। নাকি ঐ শিরশিরে ভাবখানি ছাতের উপরের ঐ কিঞ্চিত খোলা অংশ দিয়ে সুড়সুড়িয়ে ঢোকা রাতের ঐ হিমহিম বাতাসের শিরশিরানি? খড়ের গাদার ভেতর শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকা তুমি কিন্তু উষ্ণ। উষ্ণতায় উপভোগ করছো শীতলতা।

নানান নান্দনিক গন্ধের মাঝে ডুবে থাকা তুমি এবার হাত বাড়িয়ে তুলে নিলে পশমের চাদরখানি। এক পলক ফেলে তাকিয়ে দেখলে ছাতের দিকে। না, পাখিটা ফিরে আসেনি। বাসাটা শূন্য। পাখিটা বাইরে গেছে। একটু আগেই ডানা ঝাপ্‌টানোর শব্দ পেয়েছো তুমি। সেও কাটিয়েছে এক নির্ঘুম রাত, তোমার মত। জেগে ছিলে দুজনেই। একসাথে। ওর ডানা ঝাপ্‌টানোতেই ভেঙেছে এই চালাঘরে বিরাজমান সুনসান নীরবতা। মাটির কাছে খড়ের গাদার ভেতর আপাদমস্তক ডুবে থাকা তুমি রাতভর চুপচাপ দেখেছো পাখিটাকে। শুনেছো ওর নৈঃশব্দতা। অনুভব করেছো ওর সঙ্গ। তবে নিঃশব্দ ডানার প্রতিধ্বনি তুলে ভাঙা চালাঘরের ফুটো দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ও তো তুমি জানতেই পারলে না এ কোন পাখি! পাখিটা তোমার কাছে অচেনাই ছিলো। অচেনাই থাকলো। রাতভর জেগেও তুমি জানতে পারলে না পাখিটা দেখতে কেমন ছিলো। ওর ডানায় কয়টা পালক ছিলো। ওর ঠোঁটের ভেতর কি আকাঙ্ক্ষা ছিলো। ওর চোখে কি রহস্য ছিলো। তবে তুমি ঠিকই জানতে ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই তুমি শুধু শুনতে পাবে ওর ডানার প্রতিশব্দ। এতটুকুই। তুমি এতটুকুই জানবে। তুমি এতটুকুই শুনবে। পাখিটা তোমার কাছে অচেনাই থাকবে। তুমি শুধু শুনবে ওটার চলে যাওয়ার প্রতিধ্বনি। তুমি শুধু দেখবে ওটার প্রতিচ্ছায়া। তুমি শুধু চুপচাপ উষ্ণতায় উপভোগ করবে একাকী শীতলতা।

তুমি এবার উঠে দাঁড়ালে। গায়ে জড়িয়ে নিলে আরেক উষ্ণতা। পশম উষ্ণতা। তোমার চাদরের উষ্ণতা। তুমি এগিয়ে গেলে ভাঙা কাঠের দরজার দিকে, ভেজানো ছিলো সারারাত। তুমি দুয়ার বন্ধ করে রাখো না, ভেজানোই থাকে। তবুও বাইরের জগত মনে করে তোমার বদ্ধ-দুয়ার। তুমি ওদের ঘৃণা করো। তুমি এটাও জানো, যে ওদের কাছে তুমিও অপ্রত্যাশিত। তুমি এবার খোলা-দুয়ার দিয়ে বের হয়ে আসলে। শৈত্য-প্রবাহ তোমাকে জাপ্‌টে ধরলো। তুমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলে তোমার চাদরখানি – তোমার একমাত্র উষ্ণতা। তুমি এগিয়ে গেলে। এগিয়ে গেলে পাহাড়ের ঢালের দিকে। নামতে শুরু করলে সমতলে। তোমার শরীরে লেগে যাচ্ছে শেষরাতের চোরকাঁটা। তোমার পা দুটোকে পাহাড়ী লতাগুল্ম জড়িয়ে ধরছে পরম মমতায়। তোমার পায়ের আঙুলগুলোকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশিরকণা। তুমি এগিয়ে যাচ্ছো। তুমি সূর্যোদয় দেখবে। তুমি এক পাহাড়ের বাসিন্দা। কিন্তু তুমি সমতলে থেকে পাহাড়ের ফাঁকে দৃশ্যমান সূর্যোদয়ের নেশায় নেশাগ্রস্ত। তুমি জানো, পাহাড়ের ফাঁকের সূর্যোদয় দেখতে হলে পাহাড় থেকে নেমে আসতেই হয়। তুমি সবই জানো। তবু তুমি জানো না তোমার চালাঘরে রাতভর সঙ্গ দেয়া অচিন পাখিটি কোন পাখি।

এখনো আঁধার। এখনো সূর্যের দেখা নেই। এখনো আঁধার পৃথিবী। এখনো আঁধার এই জগত। এখনো আলো আসেনি। এখনো আলো আসেনি তোমার হৃদয়ে। তোমার হৃদয় এখনো পায়নি আলোর ছোঁয়া। তুমি অনেক সূর্যোদয় দেখেছো, কিন্তু তোমার হৃদয়-সূর্য সর্বদা অস্তমিতই থাকে। আজও তুমি ফিরে যাবে। ফিরে যাবে তোমার ঐ চালাঘরে। লাল টকটকে এক সূর্যকে তোমার চাদরের তলায় লুকিয়ে তুমি ফিরে যাবে তোমার ঐ ছোট্ট চালাঘরে। ফিরে যাবে খড়ের উষ্ণতায়। খড়ের শুষ্কতায়। তোমার পাশেই লাল সূর্যকে বন্দী করে রাখা এক পশমের চাদরকে ফেলে রাখবে তুমি। তোমার হৃদয় এখনো পায়নি আলোর ছোঁয়া। তুমি শুধু উষ্ণতায় উপভোগ করবে শীতলতা। আর শুনবে এক নিঃশব্দ ডানা ঝাপ্‌টানোর প্রতিধ্বনি।

এক অতিপ্রাকৃতিক খড়ের গাদায় নিজেকে লুকিয়ে রেখে তুমি আবার অপেক্ষার প্রহর গুনবে। নির্বাক তুমি নীরবে অপেক্ষায় থাকবে এক অচিন পাখির।

ছোট এই চালাঘর। আর পাখির বাসাটা শূন্য। পাখিটা বাইরে গেছে।
আর তুমি অপেক্ষায়।


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:৪৭
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×